পাহাড়ি ও দুর্গম এলাকায় বিদ্যুতের সরবরাহ লাইন টানা কঠিন ও ব্যয়বহুল। এসব এলাকায় মূলত সৌরবিদ্যুৎ বেশি কার্যকর। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কোম্পানি লিমিটেডের (ইডকল) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) মাহমুদ মালিক বলেন, গত মার্চে তারা সোলার হোম সিস্টেমের (এসএইচএস) ৪০ লাখের মাইলফলক অতিক্রম করেছেন।
সরকারি এ সংস্থা ২০০৩ সাল থেকে দেশে সৌরবিদ্যুতের প্রসারে কাজ করে যাচ্ছে। দেশের সঞ্চালন গ্রিড বিদ্যুতের সুবিধাবঞ্চিত দুর্গম এলাকার জনগোষ্ঠীর জন্য সৌরবিদ্যুতের প্রচলন শুরু হয় নব্বইয়ের দশকে। তবে ইডকলের যাত্রা শুরুর পর এ
কার্যক্রম দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে।
এ বিষয়ে ইডকলের নবায়নযোগ্য জ্বালানিবিষয়ক প্রধান কর্মকর্তা ইনামুল করিম পাভেল বলেন, এখন ৫৬টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাসে প্রায় ৭০ হাজার এসএইচএস বসছে। তিনি জানান, ২০১৮ সালের মধ্যে ৬০ লাখ বাড়ি সৌরবিদ্যুতের আওতায় আনা হবে।
পরিকল্পনা অনুসারে ২০২১ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে তিন হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় সরকার। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ (এক হাজার ৭৩৯ মেগাওয়ট) সৌরবিদ্যুৎ। সৌরশক্তি থেকে বর্তমানে ১৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। এর মধ্যে ১৬৭ মেগাওয়াটই হচ্ছে সোলার হোম সিস্টেম।
ইডকলের সহায়তায় স্থাপিত সোলার প্যানেল ছাড়াও সরকারি-বেসরকারি অফিসের ছাদে বসানো প্যানেল থেকেও সৌরবিদ্যুৎ পাওয়া যাচ্ছে। ইডকলের এসএইচএস থেকে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ১৫২ মেগাওয়াট। সরকারি-বেসরকারি অফিস ও শহরের কিছু বিল্ডিংয়ের ছাদে অবস্থিত সোলার প্যানেল থেকে পাওয়া যাচ্ছে ১৫ মেগাওয়াটের মতো সৌরবিদ্যুৎ। এ ছাড়া সৌরশক্তিচালিত পাম্প ও ছোট ছোট মিনি গ্রিড থেকে বাকি সৌরবিদ্যুৎ আসছে।
ইডকলের বিনিয়োগ :সৌরবিদ্যুতের প্রসারে এ পর্যন্ত ইডকল প্রায় ৬০ কোটি ডলার বিনিয়োগ করেছে। বিভিন্ন এনজিও ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঋণ হিসেবে এ অর্থ বিনিয়োগ করা হয়েছে। এর মধ্যে অর্ধেক ফেরত এসেছে, যা আবার বিনিয়োগ করা হচ্ছে। ইডকল তার অংশীদার প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগের ৮০ শতাংশ অর্থ ৬ থেকে ৯ শতাংশ সুদে পাঁচ বছরের জন্য ঋণ দেয়। ইডকলের তহবিলের অর্থ আসে সরকার ও বিভিন্ন দাতাগোষ্ঠীর ঋণ ও অনুদান থেকে। ইনামুল করিম পাভেল জানান, এসএইচএস প্রকল্পের মাধ্যমে গত ১৩ বছরে ৭৫ হাজার লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে। বছরে দুই লাখ ৪২ হাজার টন কেরোসিন সাশ্রয় হচ্ছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান রহিমআফরোজ রিনিউঅ্যাবল এনার্জির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুনোয়ার মিসবাহ মঈন জানান, গ্রাহক সাধারণত ২০ থেকে ১৩০ ওয়াটের সোলার প্যানেল বেশি কিনে থাকেন। ৩০ ওয়াটের একটা সিস্টেমে দুটি বাতি, একটি বৈদ্যুতিক পাখা ও একটি সাদাকালো টেলিভিশন চলে।
সেচে সৌরপাম্প :দেশে এখন ৩৮০টির মতো সৌরপাম্প চলছে। একটি পাম্পে গড়ে পাঁচ হেক্টর জমিতে সেচ সুবিধা দেওয়া যায়। ইনামুল করিম পাভেল জানান, ইডকল বসিয়েছে ৩১৪টি, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (আরইবি) ২০টি। এ ছাড়া অন্য প্রতিষ্ঠান আরও ৪০টির মতো সোলার পাম্প বসিয়েছে। এতে বছরে প্রায় কয়েক লাখ টন ডিজেলের সাশ্রয় হচ্ছে।
সোলার পাম্পের মোট বিনিয়োগের ৫০ শতাংশ অনুদান হিসেবে দেওয়া হয়। বাকি ব্যয়ের ১৫ শতাংশ গ্রাহকের বিনিয়োগ আর ৩৫ শতাংশ বাস্তবায়নকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণ। মুনোয়ার মিসবাহ মঈন জানান, তার প্রতিষ্ঠান দুই শতাধিক সোলার পাম্প বসিয়েছে। ইডকল জানিয়েছে, বর্তমানে ২৩৫টি পাম্প নির্মাণাধীন রয়েছে। আরও ৪০০ পাম্প বসানোর কার্যক্রম শুরু হতে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি ২০১৮ সালের মধ্যে এক হাজার ৫০০ সৌরচালিত সেচপাম্প বসাতে চায়।
বড় গ্রিডভিত্তিক কেন্দ্র :নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে সরকার কয়েকটি মেগা প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এর মধ্যে গত ফেব্রুয়ারিতে ৩২ মেগাওয়াটের একটি সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের কাজ কোরিয়া-বাংলাদেশের একটি যৌথ কনসোর্টিয়ামকে দেওয়া হয়েছে। সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় নির্মিতব্য এ কেন্দ্র থেকে ১৩ টাকা ৬০ পয়সায় বিদ্যুৎ কিনবে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)। এ ছাড়া চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া ৬০ মেগাওয়াট, কাপ্তাই ৭ দশমিক ৫ মেগাওয়াট, ধরলা নদীর চরে ৩০ মেগাওয়াট, ময়মনসিংহের সরিষাবাড়ী, ঈশ্বরদী ও সিরাজগঞ্জে তিন মেগাওয়াট, রংপুরের গঙ্গাচড়ায় ৫৫ মেগাওয়াটের প্রকল্প প্রক্রিয়াধীন।
সম্ভাবনা কম বায়ু বিদ্যুতের :নবায়নযোগ্য জ্বালানি পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, ২০২১ সালের মধ্যে এক হাজার ৩৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ বাসবে বায়ুশক্তি থেকে। তবে এ লক্ষ্য অর্জন নিয়ে সংশয়ে রয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্তৃপক্ষের (স্রেডা) সদস্য ও যুগ্ম সচিব সিদ্দিক যুবায়ের এ বিষয়ে বলেন, এখন পর্যন্ত দেশের বায়ুপ্রবাহের ওপর পরিচালিত সমীক্ষায় প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর আশানুরূপ পাওয়া যায়নি। প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর দিয়ে কেন্দ্রের স্থাপিত ক্ষমতার কতটুকু বিদ্যুৎ পাওয়া সম্ভব, তা বোঝানো হয়। আন্তর্জাতিক মান অনুসারে প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ২৩ শতাংশের কম হলে তা বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক হয় না। এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত জরিপের তথ্য অনুসারে বাংলাদেশে বায়ু বিদ্যুতের প্ল্যান্ট লোড ফ্যাক্টর ১৯ থেকে ২০ শতাংশ। ফলে এখানে বায়ু বিদ্যুতের সম্ভাবনা খুব বেশি নেই বলে মনে করা হচ্ছে।