বিচারকদের অভিশংসনে আইন হচ্ছে

Slider জাতীয়
pairlament_208248
সংবিধান সংশোধনের প্রায় দেড় বছর পর সুপ্রিম কোর্টের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা প্রয়োগে আইন হচ্ছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে সংসদ এ ক্ষমতা পেলেও আইনের অভাবে তা প্রয়োগ করা হয়নি। বিচারকদের কী কী কারণে অভিশংসন করা যাবে- তা নির্ধারণ করা হয়েছে এ আইনে। ‘সুপ্রিম কোর্টের বিচারকগণের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যতা (তদন্ত ও দায় নির্ধারণ) আইন, ২০১৬’-এর খসড়া তৈরি করেছে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়। আজ সোমবার সচিবালয়ে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে তা অনুমোদনের জন্য উপস্থাপনের কথা রয়েছে।

বিচারকদের সুরক্ষাও নিশ্চিত করা হচ্ছে আইনে। এর খসড়ায় বলা হয়েছে, কেউ যদি কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন, হয়রানিমূলক বা অসত্য অভিযোগ আনেন, তবে তার দুই বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড এবং অনূর্ধ্ব পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা করা হবে। বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে আনতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীতে ৭২-এর মূল সংবিধানের বিধান হুবহু প্রতিস্থাপন করা হলেও ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়নি। এ ধারা অনুযায়ী কী কী অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের কারণে বিচারকদের অভিশংসন করা যাবে তা নির্ধারণে আইন করতে হবে। তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতিও আইনের দ্বারা নির্ধারিত হতে হবে। আইন কমিশন ও আইন মন্ত্রণালয় দুটি খসড়া প্রণয়ন করে। পরে নানা পর্যালোচনা শেষে আইনটির খসড়া চূড়ান্ত করেছে আইন মন্ত্রণালয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে আইন সচিব আবু সালেহ শেখ মোহাম্মদ জহিরুল হক সমকালকে বলেন, আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে তা উপস্থাপন করা হবে।

আইন বিশেষজ্ঞরা জানান, ভারত, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে রয়েছে। বাংলাদেশেও জাতীয় সংসদের হাতে বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা দিতে আইনটি করা হচ্ছে। এতে বিচারকদের জবাবদিহি নিশ্চিত হবে এবং আদালতের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বাড়বে। সংবিধানের ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বিচারকদের অপসারণের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৭২ সালের প্রণীত মূল সংবিধানের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই আইনটি করা হচ্ছে বলে জানান তারা।

যেসব কাজকর্মে অসদাচরণ হবে: প্রস্তাবিত খসড়া আইনে বিচারকদের অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের সংজ্ঞা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে। বিষয় বা প্রসঙ্গের সঙ্গে কোনো কিছু না থাকলে এই আইনে ‘অসদাচরণ অর্থ- কোন বিচারক কর্তৃক ভীতি বা অনুগ্রহ, অনুরাগ বা বিরাগের বশবর্তী হয়ে বিচার পরিচালনা বা রায় দেওয়া; পদমর্যাদা বা কার্যালয়ের অপব্যবহার করে আর্থিক, বস্তুগত কিংবা অন্য কোন সুবিধা নেওয়া; নৈতিক স্খলনজনিত অপরাধ; বিচারকাজে প্রভাবিত হওয়া বা অন্যকে প্রভাবিত করা।’ ইচ্ছাকৃত ও ক্রমাগত বিচারিক কর্তব্য পালনে ব্যর্থতা, জীবনবৃত্তান্তে ইচ্ছাকৃতভাবে প্রাসঙ্গিক কোনো তথ্য গোপন করলেও অপসারণের উদ্যোগ নেওয়া যাবে বলে প্রস্তাবিত আইনে বলা হয়েছে। এতে ‘অসামর্থ্য’ বলতে কোনো বিচারকের স্থায়ী শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যতাকে বোঝানো হয়েছে।

অপসারণ করা যাবে যেভাবে: প্রস্তাবিত খসড়ায় বলা হয়েছে, কোনো সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি সংসদের স্পিকারের কাছে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে অসদাচরণ ও অসামর্থ্যের অভিযোগ আনতে পারেন। সংক্ষুব্ধ ওই ব্যক্তির অভিযোগ প্রাথমিক বিবেচনার জন্য স্পিকার দশজন সংসদ সদস্য নিয়ে গঠিত কমিটির কাছে পাঠাবেন। কমিটি যদি মনে করে, প্রাথমিকভাবে অভিযোগটির সত্যতা রয়েছে তাহলে তারা স্পিকারকে লিখিতভাবে জানাবেন। কমিটির প্রতিবেদন পাওয়ার পর স্পিকার সংসদে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বিষয়টি উত্থাপন করবেন। সংসদ যদি মনে করে ওই অভিযোগ তদন্ত করা প্রয়োজন, তাহলে তা তদন্ত কমিটির কাছে পাঠাবে। অভিযুক্ত বিচারক আত্মপক্ষ সমর্থন করে কমিটির চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত বক্তব্য রাখতে পারবেন বলেও খসড়ায় বলা হয়েছে। প্রস্তাবে কোনো বিচারকের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ তদন্তে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। একজন সাবেক প্রধান বিচারপতি অথবা আপিল বিভাগের সাবেক একজন বিচারপতিকে কমিটির চেয়ারম্যান করা হবে। সদস্য থাকবেন একজন সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এবং একজন সম্ভ্রান্ত নাগরিক। তবে কোনোভাবেই কমিটির কোনো সদস্যের বয়স ৬৭ বছরের কম হবে না।

অসদাচরণ বা অসামর্থ্য যদি প্রমাণ হয়, তাহলে ওই বিচারককে সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করে লিখিত বা মৌখিক বক্তব্য দেওয়ার বিধান প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। এরপর দুই-তৃতীয়াংশ সদস্য যদি ওই বিচারকের অসামর্থ্য বা অসদাচরণের জন্য অপসারণের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে ওই প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠানো হবে। রাষ্ট্রপতি তাকে অপসারণ করবেন।

১৯৭২ সালের মূল সংবিধানে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা ছিল সংসদের হাতে। ওই সংবিধানের ৯৬(২) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘প্রমাণিত অসদাচরণ বা অসামর্থ্যের জন্য দুই-তৃতীয়াংশ সাংসদের ভোটে সমর্থিত প্রস্তাব রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের মাধ্যমে বিচারপতিদের অপসারণ করা যাবে।’ ৯৬(৩) অনুচ্ছেদে বলা ছিল, ‘অপসারণের প্রস্তাব সম্পর্কিত পদ্ধতি এবং বিচারকের অসদাচরণ বা অসামর্থ্য সম্পর্কে তদন্ত ও প্রমাণের পদ্ধতি সংসদ আইনের দ্বারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে।’ কিন্তু সংবিধানের এই বিধানের আলোকে কোনো আইন প্রণয়ন করতে পারেনি তৎকালীন সংসদ। এর মধ্যেই দু’বার সংশোধন হয়েছে সংবিধান। ১৯৭৫ সালে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীতে ৯৬(২) অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা সংসদের পরিবর্তে সরাসরি রাষ্ট্রপতির হাতে দেওয়ার পাশাপাশি ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ বিলোপ করা হয়।

১৯৭৭ সালে বিচারকদের অপসারণের পদ্ধতিতে আবারও পরিবর্তন আসে। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান সামরিক আদেশে বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাত থেকে সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের কাছে দিয়ে দেন। পরে ১৯৭৯ সালে পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে এ বিধান সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ২০১০ সালে আপিল বিভাগ পঞ্চম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলকে অনুমোদন দিয়েছিলেন। ২০১১ সালে পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানের অনেক বিষয় ফিরিয়ে আনা হলেও সুপ্রিম জুডিসিয়াল কাউন্সিলের বিধানটি বহাল রাখা হয়। তিন বছর পর সরকারের নীতিনির্ধারকরা এ ক্ষমতা পুনরায় সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়ার তাগিদ অনুভব করেন। এ নিয়ে সংসদে আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যদের সোচ্চার হতে দেখা যায়।

পরে ২০১৪ সালে ষোড়শ সংশোধনীর মাধ্যমে পুনরায় বিচারকদের অপসারণ ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। একইসঙ্গে ‘৭২-এর মূল সংবিধানের বিধান হুবহু প্রতিস্থাপন করা হলেও ৯৬(৩) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী এ সংক্রান্ত আইন প্রণয়ন করা হয়নি। চলতি বছরের শুরুর দিকে আইনমন্ত্রী প্রধান বিচারপতির সঙ্গে দেখা করে বিলের খসড়াটি তার হাতে দেন। খসড়া সম্পর্কে বিচারকদের অভিমতও জানতে চান আইনমন্ত্রী। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কোনো মতামত জানাননি। সুপ্রিম কোর্টের সংশিল্গষ্ট সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে একটি মামলা হয়েছে। একটি বৃহত্তর বেঞ্চে মামলার শুনানিও হয়েছে। আগামী ৫ মে রায়ের জন্যও বিষয়টি ধার্য রয়েছে। মামলা বিচারাধীন থাকায় সুপ্রিম কোর্ট এ বিষয়ে কোনো মতামত পাঠানো থেকে বিরত থাকেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *