সংকট কাটিয়ে উঠছে তৈরি পোশাক খাত

Slider অর্থ ও বাণিজ্য
untitled-5_208029
রানা প্লাজা ধসের কারণে সৃষ্টি হওয়া নেতিবাচক ভাবমূর্তি থেকে অনেকটাই বেরিয়ে এসেছে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত। সাভারে ভয়াবহ এ দুর্ঘটনার পর কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রমিকদের অধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিকভাবে বড় ধরনের সমালোচনা শুরু হয়। সংকটে পড়ে বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের বৃহত্তম এ খাত। তবে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ব্যাপক সংস্কারকাজ বাস্তবায়িত হওয়ায় এ সংকট কাটিয়ে উঠছে পোশাক খাত। তিন বছরে বৃহত্তম এ শিল্প খাতের প্রায় পাঁচ হাজার কারখানার আমূল সংস্কার হওয়ায় বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে দৃষ্টান্ত। বদলে যাওয়া পোশাক খাতের বার্তা পাওয়ার পর ক্রেতারা আরও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন। এক বছর ধরে প্রতি মাসেই বাড়ছে পোশাক রফতানি।

তবে এখনও কিছু বিষয়ে দুর্বলতা রয়ে গেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। আর সংস্কারে টিকে থাকতে না পেরে কিছু কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে।

রানা প্লাজা ধসের পরপরই সংস্কার শুরু করে বাংলাদেশ। তিন বছর ধরে সরকার, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও), ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সরকার, ডিএফআইডি, জাইকা, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকসহ কয়েকটি দাতা সংস্থা এবং পোশাক খাতের দুই সংগঠন বিজিএমইএ ও বিকেএমইএর অংশগ্রহণ ও তত্ত্বাবধানে সংস্কারকাজ চলছে। তৈরি পোশাক রফতানিও বাড়ছে ধারাবাহিকভাবে। চলতি অর্থবছরের প্রথম নয় মাসে (জুলাই-মার্চ) পোশাক খাতের রফতানি আয় লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে বেশি হয়েছে ২ দশমিক ৫০ শতাংশ। আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় রফতানি বেশি হয়েছে ১০ শতাংশ।

উদ্যোক্তারা জানান, শ্রমিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও পরিবেশসম্মত উৎপাদনের কারণে আন্তর্জাতিক পর্যায়ের গ্রিন সনদ পেয়েছে অনেক কারখানা। এ সনদ পাওয়ার অপেক্ষায় আছে আরও অন্তত একশ’ কারখানা। ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি এক কথায় ‘অসাধারণ’। শ্রমিক নিরাপত্তার বিষয়টি এগিয়ে নিতে কল-কারখানার পরিবেশ উন্নয়নে সারাবিশ্বে সবচেয়ে ভালোভাবে কাজ করছে বাংলাদেশ।

বিজিএমইএ সভাপতি সিদ্দিকুর রহমান সমকালকে বলেন, রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ছিল উদ্যোক্তাদের জন্য জেগে ওঠার বার্তা। উদ্যোক্তারা সতর্ক হয়েছেন। সেভাবেই কাজ এগোচ্ছে। সংস্কারের ফলে গত তিন বছরে উল্লেখ করার মতো কোনো দুর্ঘটনা হয়নি পোশাক খাতে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির অতিরিক্ত গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, রানা প্লাজা ধসের পর পোশাক খাতের সংস্কারে ছোট-বড় অনেক ভালো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এগুলো এখন ফল দিচ্ছে।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৯টায় সাভারের রানা প্লাজা ভবন ধসে পড়ে। এ দুর্ঘটনায় ভবনে থাকা পাঁচটি পোশাক কারখানার অন্তত ১ হাজার ১৩৮ শ্রমিক নিহত হন। আহত ও পঙ্গু হয়ে পড়েন অন্তত আড়াই হাজার শ্রমিক। দুর্ঘটনার পর জিএসপি সুবিধা স্থগিত করে যুক্তরাষ্ট্র। জেনেভায় ‘ইইউ সাসটেনেবিলিটি কমপ্যাক্ট’ নামে বাংলাদেশের সঙ্গে অন্য একটি চুক্তি হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়নের নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) সমন্বয়ে এ চুক্তিতে পরে যুক্তরাষ্ট্রও অংশ নেয়।

উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি: সরকারের পক্ষ থেকে শ্রম আইন সংশোধন, বিধিমালা প্রণয়ন এবং ইপিজেডে ট্রেড ইউনিয়ন করার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে ৭৭ শতাংশ হারে মজুরি বাড়ানো হয়েছে। ইউরোপের ক্রেতাদের জোট ‘অ্যাকর্ড অন ফায়ার অ্যান্ড বিল্ডিং সেফটি ইন বাংলাদেশ’ এবং উত্তর আমেরিকার ক্রেতাজোট ‘অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি’ নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করছে। যেসব কারখানা থেকে এই জোটের ক্রেতারা পোশাক নেন, সেসব কারখানা ভবনের কাঠামো, অগি্ন ও বৈদ্যুতিক মান সংক্রান্ত প্রাথমিক পরিদর্শন শেষ করা হয়েছে। পরিদর্শনে চিহ্নিত ত্রুটি সংশোধন চলছে এখন। জোটের সরাসরি তত্ত্বাবধানে এরই মধ্যে ৪৪ শতাংশ ত্রুটি সংশোধন করেছেন উদ্যোক্তারা। দুই জোটের বাইরে থাকা জাতীয় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের আওতায় দেড় হাজার কারখানা পরিদর্শনের কাজ শেষ করেছে কলকারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর (ডিআইএফই)। তবে এসব কারখানার সংস্কার কিছুটা ধীরগতিতে চলছে। এ প্রসঙ্গে ডিআইএফইর মহাপরিদর্শক সৈয়দ আহম্মেদ সমকালকে বলেন, দেরির কারণ খতিয়ে দেখছেন তারা।

ক্ষতিপূরণ: দুর্ঘটনার আড়াই বছরের মধ্যে ক্ষত্রিগস্তদের সফলভাবে ক্ষতিপূরণ দেওয়া সম্ভব হয়েছে। মোট ২৪০ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। এর বাইরে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ১৫ কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে বিজিএমইএর পক্ষ থেকে। ক্ষতিগ্রস্তদের প্রকৃত তালিকা তৈরি করতে গঠিত কমিটি রানা প্লাজা ক্লেইম অ্যাডমিনেস্ট্রেশনের কাছে ৫ হাজার ১০৯টি দাবিনামা জমা পড়ে। এর মধ্যে আহত দুই হাজার ২৭ এবং নিহত ও নিখোঁজ শ্রমিকদের পরিবারের পক্ষ থেকে দেওয়া তিন হাজার ৮২টি আবেদন যাচাই-বাছাই শেষে ক্ষতিগ্রস্তদের পৃথক ব্যাংক হিসাবে গত আগস্টে ক্ষতিপূরণের অর্থ পরিশোধ করা হয়েছে। রানা প্লাজা কো-অর্ডিনেশন কমিটির (আরপিসিসি) সদস্য বাংলাদেশ লেবার স্টাডিজের সহকারী নির্বাহী পরিচালক সৈয়দ সুলতান উদ্দিন আহমেদ সমকালকে বলেন, ক্ষতিপূরণের অর্থ দেওয়ার পর ঠিকানা স্পষ্ট না হওয়ায় নিহত দুই শ্রমিকের ক্ষতিপূরণের ২০ লাখ টাকা কমিটির ফান্ডে এখনও পড়ে আছে। তবে ক্ষতিপূরণের একটি জাতীয় নীতিমালা এতদিনেও না হওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেন তিনি।

শর্ত পূরণ হলেও জিএসপি পুনর্বহাল হয়নি: পোশাক খাতের অগ্রগতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা প্রশংসা করলেও জিএসপি পুনর্বহাল করা হয়নি। জিএসপি স্থগিত করার সময় কর্মপরিবেশ, শ্রমিক নিরাপত্তা ও তাদের অধিকার রক্ষায় মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয় (ইউএসটিআর) থেকে ১৬টি শর্তের কর্মপরিকল্পনা বাংলাদেশকে দেওয়া হয়। এসব শর্ত পূরণ করেছে বাংলাদেশ। তবে জিএসপি স্থগিতের আদেশ এখনও বহাল রাখা হয়েছে।

ক্রেতারা যা বলছেন: ক্রেতাদের জোট অ্যালায়েন্সের নির্বাহী পরিচালক মেসবাহ রবিন সমকালকে বলেন, গত তিন বছরের পোশাক খাতের সার্বিক অগ্রগতি মোটামুটি ভালো। বিশেষ করে অ্যালায়েন্সের প্রাথমিক পরিদর্শনে চিহ্নিত ত্রুটির প্রায় অর্ধেক সংশোধনের কাজ শেষ হয়েছে। সংস্কারের বাকি কাজও এগিয়ে চলছে। তবে জাতীয় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের (এনপিএ) আওতায় থাকা দেড় হাজার কারখানায় এখনও সংস্কার কাজ শুরুই হয়নি। তাই গোটা শিল্পকে এখনও নিরাপদ বলা যায় না। অন্যদিকে অ্যাকর্ডের প্রধান নির্বাহী পরিচালক রব ওয়েজের মতে, তিন বছর আগের তুলনায় পোশাক কারখানা এখন অনেক নিরাপদ। বিবিসিকে তিনি বলেছেন, কারখানা ভবনগুলোর নিরাপত্তা, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং অগি্ননির্বাপণ ব্যবস্থা আগের চেয়ে ভালো।

শ্রম অধিকার ইস্যুতে বিতর্ক: রানা প্লাজা ধসের পর কারখানার নিরাপত্তা ও শ্রম অধিকার- এ দুই ইস্যুতে সংস্কার চলছে। ক্রেতা এবং শ্রমিক সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, শ্রমিকদের অধিকার বিশেষত ট্রেড ইউনিয়ন ইস্যুতে আশানুরূপ অগ্রগতি হয়নি। ট্রেড ইউনিয়ন গঠন নিয়ে হয়রানির অভিযোগ আসছে মাঝে মধ্যে। ইপিজেডে প্রকৃত অর্থে ট্রেড ইউনিয়ন চর্চা হচ্ছে না বলে অনেকেই মনে করছেন। তবে সংস্কার শুরুর পর বড় ধরনের কোনো শ্রমিক অসন্তোষ দেখা যায়নি। পোশাক শ্রমিক কর্মচারী লীগের সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রনী বলেন, কর্মপরিবেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। শ্রমিকরা নিরাপদে কাজ করছে। আরও উন্নতির প্রত্যাশা তাদের। সম্মিলিত গার্মেন্টস শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি নাজমা আক্তার বলেন, শ্রম অধিকারের বিষয়টি এখনও অবহেলিতই রয়ে গেছে। কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন করতে ৩০ শতাংশের স্বাক্ষর বাধ্যতামূলক করে একটা জটিলতা তৈরি করা হয়েছে। সেফটি কমিটি গঠনের আইনগত বাধ্যবাধকতা থাকলেও অনেক কারখানায় এ কমিটি নেই।

আরও যা করতে হবে: তিন বছরে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি সত্ত্বেও পরিচ্ছন্ন পোশাক খাত নিশ্চিত করতে এখনও বেশ কিছু কাজ বাকি রয়েছে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মতে, সাব-কন্ট্রাক্ট্র কারখানা পোশাক খাতের এখনও একটা বড় সমস্যা হয়ে রয়ে গেছে। পশ্চাৎসংযোগ শিল্পকেও সংস্কারের আওতায় আনা হয়নি। সিপিডির খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, স্বাধীন শ্রম অধিকার চর্চার ক্ষেত্রে এখনও দুর্বলতা রয়ে গেছে। শ্রমিকের স্বাধীন অধিকার চর্চার সুযোগ থাকলে গোটা খাতে স্বচ্ছতা বাড়বে। এ ছাড়া সংস্কার প্রক্রিয়ার সব উদ্যোগ সমভাবে এগোচ্ছে না। সংস্কার কাজে গতি আনা প্রয়োজন। অ্যাকর্ডের নির্বাহী পরিচালক মনে করেন, জাতীয় ত্রিপক্ষীয় উদ্যোগের (এনপিএ) আওতায় থাকা দেড় হাজার কারখানার সংস্কার কাজ দ্রুত শেষ করা প্রয়োজন। কারখানা স্থানান্তর প্রক্রিয়া সহজ করার জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমির দর নির্ধারণে একটা সমন্বিত নীতিমালা প্রণয়নের পরামর্শ দেন তিনি।

বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক কারখানা: পরিদর্শন ও সংস্কার প্রক্রিয়ার সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে বন্ধ হয়ে গেছে শতাধিক কারখানা। প্রাথমিক পরিদর্শনে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের ৩৬টি কারখানা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সংস্কার চালিয়ে যেতে ব্যর্থ আরও ৮৪টি কারখানার সঙ্গে সব সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন অ্যাকর্ড এবং অ্যালায়েন্সের ক্রেতারা। এসব কারখানা এখন কার্যত বন্ধ। – See more at: http://bangla.samakal.net/2016/04/24/208029#sthash.V7EF5exc.dpuf

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *