‘স্বামীটাক বাঁচি রাখি মোর নিয়া গেইনেন না কেন’

Slider জাতীয়

 

untitled-8_207405

 

 

 

 

 

 

মোর আর বাঁচি থাকি কী হইবে। মুই আর বাঁচপার চাওনা। আল্লাহ মোর স্বামীটাক বাঁচি রাখি মোর নিয়া গেইনেন না কেন?’ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের মেঝেতে বসে কথাগুলো বলে বিলাপ করছিলেন ফেন্সি বেগম। তার দুই চোখ দিয়ে অবিরাম গড়িয়ে পড়ছিল অশ্রু। তার স্বামী কথা দিয়েছিলেন, কাজ করে যে টাকা পাবেন, তা দিয়ে তার জন্য একটা লাল শাড়ি নিয়ে আসবেন। আর ছেলেমেয়েদের জন্যও আনবেন নতুন জামা। কিন্তু দুর্ঘটনায় তার সবকিছুই হারিয়ে গেল। তিনি বলেন, ‘মোর স্বামী ধন তোমরা মোক ছাড়ি কোনটে গেইনেন। মুই এলা কাকে নিয়া বাঁচিম।’ সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত সৈয়দপুরের মোহাম্মদ আলী কালার স্ত্রী ফেন্সি বেগমই নন, গতকাল বুধবার দুপুরে নিহত-আহতদের স্বজনের কান্নার আওয়াজ আর আহাজারি ছিল হাসপাতালজুড়ে। আহতদের কান্নায় ব্যস্ত চিকিৎসকরাও চোখের পানি ধরে রাখতে পারেননি। তাদের দেখা যায় হাত দিয়ে চোখ মুছতে।
গতকাল বেলা ১১টায় রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার তেরমাথা এলাকার রংপুর-সৈয়দপুর মহাসড়কে দুটি বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষে চালক-হেলপারসহ ১৩ জন নিহত হন। এতে আরও অন্তত ৬৫ জন আহত হন। তাদের চিকিৎসা চলছে রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। এর মধ্যে ১০ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের পরিচালক ডা. আ স ম বরকতুল্লাহ। হতাহতদের বেশির ভাগই ধান কাটতে ও নানা কাজের জন্য রংপুর থেকে অন্য জেলায় যাচ্ছিলেন। হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহত যাত্রীদের অনেকেই বলেছেন, একটি বিকট শব্দের পরই দুটি বাস একেবারে মুখোমুখি এসে পড়ে। গরমে গাড়ির চাকা ফেটে যাওয়ায় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে তারা উল্লেখ করেন। কেউ কেউ অবশ্য একটি গাড়ির চালক ঘুমাচ্ছিলেন বলে জানান।

দুর্ঘটনার পরপরই রংপুর জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার, পুলিশ সুপার আবদুর রাজ্জাকসহ প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে যান। তারা হাসপাতালে গিয়ে আহত ও নিহতদের খোঁজখবর নেন। জেলা প্রশাসক তাৎক্ষণিকভাবে নিহতের পরিবারকে পাঁচ হাজার টাকা ও আহতদের প্রত্যেককে দুই হাজার করে সহায়তা দেন। এ ছাড়া তারাগঞ্জ উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জিলুফা সুলতানা নিহতদের

পরিবারকে চার হাজার টাকা ও আহতদের এক হাজার টাকা প্রদান করেন।

ঘটনা তদন্তে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তিন সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছে। রংপুরের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এ কে এম মারুফ হাসান কমিটির প্রধান। ওই কমিটিকে সাত দিনের মধ্যে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। এর পরই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানা যাবে বলে জানিয়েছেন জেলা প্রশাসক রাহাত আনোয়ার।

হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, নিহতদের মধ্যে ১১ পুরুষ ও দুই নারী রয়েছেন। তাদের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় মিলেছে। তারা হলেন_ দুর্ঘটনাকবলিত তৃপ্তি পরিবহনের চালক তৈয়ব মিয়া (৪০), একই গাড়ির হেলপার দিনাজপুরের ভুষিরবন্দরের অতুুল রায়ের ছেলে চন্দন রায় (২৮), নীলফামারীর সৈয়দপুরের পাশারীপাড়ার ইউনুছ আলীর ছেলে মোহাম্মদ আলী কালা (৩৮), একই এলাকার ছাবেদ আলীর ছেলে আবদুল মতিন (৩৫), তারাগঞ্জ উপজেলার ইকরচালি মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক জিনাত আরা (৩৫), নীলফামারীর কিশোরগঞ্জ উপজেলার পুঁটিমারী এলাকার ছকমল মিয়ার ছেলে লিটন মিয়া (২৮), জলঢাকা উপজেলার আবু বকরের ছেলে মিজানুর রহমান (৪০), রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার আকুল মিয়া (৪০), সুবোধ চন্দ্র রায় (৩৭) ও মমদেল মিয়া (৫৫)। নিহত তিনজনের লাশ রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে রাখা হয়েছে। বাকি ১০ জনের লাশ স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে।

পুলিশ, এলাকাবাসী ও আহত যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সৈয়দপুর থেকে তৃপ্তি পরিবহনের একটি বাস রংপুরে যাচ্ছিল। বাসটি তারাগঞ্জের তেরমাইল এলাকায় পেঁৗছালে একই স্থানে কুমিল্লা থেকে রংপুর হয়ে সৈয়দপুরগামী সায়মুন পরিবহনের অপর বাসের সামনের চাকা ফেটে যায়। এ সময় সায়মুন পরিবহনের বাসচালক নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললে দুই বাসের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। এতে বাস দুটি দুমড়ে-মুচড়ে যায় এবং একটি আরেকটির ভেতর ঢুকে পড়ে। প্রথমে স্থানীয়রা এসে উদ্ধারকাজ শুরু করেন। পরে রংপুর ও সৈয়দপুর থেকে দমকল বাহিনীর কর্মী, তারাগঞ্জ থানা পুলিশ ও রংপুর জেলা থেকে পুলিশ সদস্যরা গিয়ে উদ্ধারকাজ চালান। ঘটনাস্থল থেকেই সাতজনের লাশ উদ্ধার করা হয়। আহতদের তারাগঞ্জ স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। হাসপাতালে নেওয়ার পর আরও পাঁচজনের মৃত্যু হয়।

রংপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ছালামত মিয়া ও রফিক মিয়া বলেন, ‘আমরা ঘটনাস্থলের পাশের জমিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মা রে, বাবা রে, তোমরা কে কোথায় আছো বাঁচাও, মরে যাচ্ছি চিৎকার শুনতে পাই। আমরা দৌড়ে বাসের কাছে গিয়ে থমকে যাই। কারও হাত নেই, মাথা ফেটে রক্ত ঝরছে, আবার কেউ দুই বাসের সঙ্গে চাপা পড়ে আছেন। এমন দৃশ্য দেখে কী করব, বুঝতে পারছিলাম না। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকি। এরপর উদ্ধারকাজ শুরু করি।’

উদ্ধারকারী তারাগঞ্জ এলাকার মোসলেম উদ্দিন ও জাকির হোসেন বলেন, ‘আমরা মহাসড়কের ধারে জমিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ করে শব্দ শুনতে পাই। বাস দুটি এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে গিয়েছিল যে যাত্রীরা অনেকে তার মধ্যে চাপা পড়েন।’ বাস কেটে যাত্রীদের বের করতে হয় বলে জানিয়েছেন রংপুর ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্সের সিনিয়র স্টেশন অফিসার সাইফুল ইসলাম।

হাসপাতালে চিকিৎসাধীন সায়মন পরিবহনের যাত্রী সৈয়দপুরের ব্যবসায়ী রবিউল ইসলাম বলেন, ‘আমার একটু ঝিমুনি এসেছিল। সিটে মাথা নিচু করে ছিলাম। হঠাৎ করে বিকট শব্দ হয়। এর পর কিছু সময় কী হয়েছে আর বলতে পারি না। আমার মাথাসহ শরীরের বিভিন্ন স্থানে আঘাতের কারণে উঠতে পারছিলাম না। পরে ফায়ার সাভিসের কর্মীরা আমাকে উদ্ধার করেন।’ তিনি জানান, তার হাত ও পা ভেঙে গেছে। মাথায়ও আঘাত পেয়েছেন।

রবিউল আরও জানান, চালক বাসটি ঠিকভাবেই চালাচ্ছিলেন। কিন্তু চাকা ফেটে যাওয়ায় আর নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছিলেন না। এরপরই দুর্ঘটনাটি ঘটে।

একই বাসের অপর যাত্রী কবিরুল অভিযোগ করেন, চালক ঘুমের ঘোরে বাস চালানোয় এর আগেও কয়েকবার একটুর জন্য দুর্ঘটনা থেকে বেঁচে যান। তিনি বলেন, ‘আমি ঠাকুরগাঁওয়ে যাওয়ার উদ্দেশে ঢাকার সায়েদাবাদ থেকে সায়মুন পরিবহনে উঠে চালকের পাশে ইঞ্জিনের ওপর বসি। কিছুক্ষণ পর দেখতে পাই, চালক ঘুমে টলছেন। যাত্রীরা তাকে গাড়ি থামিয়ে চোখে পানি দিতে বলেন।’ ঢাকা থেকে রংপুর আসার পথে গাজীপুর, বগুড়া ও রংপুর শহরে গাড়ি থামিয়ে তিনি তিনবার চোখে পানি দেন বলে জানান কবিরুল। দুর্ঘটনায় তিনি সামান্য আহত হয়েছেন।

রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ ও সার্জারি বিভাগের প্রধান ডা. জাকির হোসেন জানান, দুর্ঘটনার পরই ডাক্তার ও নার্সদের হাসপাতাল ত্যাগ না করার নির্দেশ দেওয়া হয়। আহতদের চিকিৎসায় প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে অতিরিক্ত রক্তের প্রয়োজন দেখা দেওয়ায় তিনি আগ্রহীদের হাসপাতালে এসে রক্ত দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছেন।

তারাগঞ্জ থানার ওসি আবদুল লতিফ বলেন, ‘চাকা ফেটে যাওয়ার কারণেই দুর্ঘটনা ঘটে। এরপরই আমরা গিয়ে উদ্ধার অভিযান শুরু করি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *