প্রতিবেদনে তীব্র সমালোচনা করা হয় ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের। বলা হয়েছে, সরকারি কর্মকর্তারা দায়মুক্তি থাকায় প্রায়ই দুর্নীতি করেন। তাদের শাস্তি দেয়ার জন্য আইন আছে। কিন্তু সরকার সে আইন কার্যকরভাবে প্রয়োগ করে না। মানবাধিকার গ্রুপ, মিডিয়া, দুর্নীতি দমন কমিশন ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান সরকারি দুর্নীতির রিপোর্ট করেছে। সরকারে রয়েছে ব্যাপক দুর্নীতি। রয়েছে স্বচ্ছতার অভাব। বাংলাদেশে মানবাধিকারের অন্য সমস্যাগুলো হলো নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন ও অন্যান্য লঙ্ঘন, খেয়াল-খুশি মতো গ্রেপ্তার, আটক, বিচার বিভাগীয় স্বাধীনতা দুর্বল, বিচারের আগেই দীর্ঘ সময় আটকে রাখা। কর্তৃপক্ষ নাগরিকদের ব্যক্তিগত গোপনীয় অধিকার লঙ্ঘন করেছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও আন্তঃদলীয় সহিংসতা গুরুতর সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। সরকারি পর্যায়ে দুর্নীতি বিদ্যমান একটি সমস্যা। কর্মকাণ্ড পরিচালনার ক্ষেত্রে অব্যাহতভাবে আইনি ও অনানুষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার মুখোমুখি বেশ কিছু বেসরকারি সংগঠন। নারী ও মেয়েরা অসমতার শিকার। অনেক শিশু কাজ করতে বাধ্য হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা অর্থনৈতিক প্রয়োজনে কাজ করছে। আবার কখনও তারা পাচারের শিকার। শিশুরা মাঝে মাঝেই সহিংসতা ও নির্যাতনের শিকার। বিকলাঙ্গ ব্যক্তিরা বৈষম্যের শিকার। বিশেষ করে শিশুরা সরকারি স্কুলগুলোতে ভর্তির ক্ষেত্রে এমনটা ঘটছে। ধর্মীয় ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সামাজিক সহিংসতা রয়েছে, যদিও সরকারি ও বিভিন্ন সুশীল সমাজের নেতারা দাবি করেন, এসব ঘটনা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক। এর সঙ্গে ধর্মীয় বিশ্বাসকে মিলিয়ে দেখা উচিত হবে না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, আইনের শাসনের তোয়াক্কা না করায় শুধু ব্যক্তিবিশেষই নয়, সেই সঙ্গে সরকারি কর্মকর্তারাও মানবাধিকার লঙ্ঘন করেন। তারা দায়মুক্তি ভোগ করেন। একই সঙ্গে নাগরিকদের তাদের অধিকার দাবি করা থেকে বিরত রাখা হয়। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তদন্ত ও মামলার ক্ষেত্রে সরকার সীমিত পদক্ষেপ নিয়েছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের সংবিধানে মানুষের জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার দেয়া হয়েছে। কিন্তু মিডিয়া, স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো রিপোর্ট করেছে যে, সরকার ও এর বিভিন্ন এজেন্ট বিপুল পরিমাণ খেয়ালখুশি মতো ও আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকের হাতে কত মানুষ নিহত হয়েছেন তার কোনো পরিসংখ্যান সরকার প্রকাশ করেনি। এমনকি এসব মামলা তদন্তে সমন্বিত কোনো উদ্যোগও নেয়নি, যদিও সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা এর আগে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তারা নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের দ্বারা সব বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে শূন্য সহনশীলতা প্রদর্শন করবেন এবং পূর্ণাঙ্গ তদন্ত করবেন। সামান্য দু-একটি ক্ষেত্রে যাদের বিরুদ্ধে সরকার অভিযোগ এনেছে তাদের শুধু প্রশাসনিক শাস্তি দেয়া হয়েছে। কিন্তু বছর শেষে কমপক্ষে একটি উল্লেখযোগ্য মামলা স্থগিত অবস্থায় রয়ে গেছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর কিছু সদস্য কাজ করেছেন দায়মুক্তিতে। র্যারেব ভেতরে অভ্যন্তরীণ তদন্তের যে সেল গঠন করা হয়েছে সরকার তাতে অব্যাহতভাবে সমর্থন দিয়েছে। এ সেল র্যাবের বিরুদ্ধে আনীত মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো তদন্ত করে। তদন্তকারীদের অব্যাহত প্রশিক্ষণ সত্ত্বেও এই তদন্ত সেল মাত্র ১৬টি মামলা তদন্ত করেছে। ঘেরাও, গ্রেপ্তার ও আইন প্রয়োগকারীদের অপারেশনের সময়ে সন্দেহজনক মৃত্যুর ঘটনা তো আছেই। মাঝে মাঝেই নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী দাবি করে থাকে যে, তারা সন্দেহজনক ব্যক্তিকে অপরাধের স্থানে অথবা লুকিয়ে থাকার স্থানে অস্ত্র উদ্ধারে অথবা অপরাধীদের সনাক্ত করতে নিয়ে যায় রাতের আঁধারে। কিন্তু ওই সন্দেহজনক ব্যক্তির সহযোগীরা পুলিশের দিকে গুলি ছোড়ার সময় সে মারা গেছে। সরকার যথা নিয়মে এই মৃত্যুকে ‘ক্রসফায়ারে মৃত্যু’ ‘বন্দুকযুদ্ধে’ অথবা ‘এনকাউন্টারে মৃত্যু’ বলে বর্ণনা করে। র্যাব ও পুলিশ ইউনিটের সঙ্গে অপরাধীদের গোলাগুলিকে বর্ণনা করতে এ টার্মগুলো ব্যবহার করা হয়, যদিও মিডিয়া এসব ঘটনাকে পুলিশের কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়া হিসেবে বর্ণনা করে থাকে।
ফেব্রুয়ারিতে জিএম নাহিদের মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে নিয়ে যায় পুলিশ। তাকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে বলে প্রমাণ মেলে। নাহিদের পিতা বলেন, তার ছেলে পুলিশি হেফাজতে ছিল। তাকে মুক্তি দিতে পুলিশ পাঁচ লাখ টাকা দাবি করে। এ টাকার অঙ্ক কমিয়ে আনা নিয়ে যখন সমঝোতা চলছিল তখনই পুলিশ হেফাজত থেকে নিখোঁজ হয় তার ছেলে। পরে ওই মাসেই পুলিশ একই মর্গে পাঠায় তিন কিশোরের মৃতদেহ। পুলিশ এ সময় দাবি করে, যখন এরা একটি বাসে পেট্রোল বোমা নিক্ষেপের প্রস্তুতি নিচ্ছিল তখন একদল লোক তাদেরকে ধরে প্রহার করে। এতে তাদের মৃত্যু হয়। পক্ষান্তরে ময়না তদন্ত রিপোর্টে দেখা যায়, ওই কিশোরদের দেহে ৫৭টি বুলেটের ক্ষত রয়েছে।
২০১৪ সালের এপ্রিলে নারায়ণগঞ্জে সাত ব্যক্তিকে অপহরণ করে হত্যা করে কয়েকজন র্যাব কর্মকর্তা। জনক্ষোভের মুখে সরকার ওইসব কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত করে বিচারের মুখোমুখি করে। এ হত্যাকাণ্ডে র্যাব কর্মকর্তাদের চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগের অভিযোগে অভিযুক্ত নূর হোসেনকে ভারত সরকার বাংলাদেশের কাছে হস্তান্তর করে ১২ই নভেম্বর। বছর শেষ পর্যন্ত এ মামলা চলছিলই। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের প্রথম বার্ষিকীর পরে রাজনৈতিক সহিংসতা বৃদ্ধি পায় বাংলাদেশে। প্রায় তিন মাস দেশব্যাপী অবরোধ ও হরতাল পালিত হয়। বাস পোড়ানো ও অন্যান্য ঘটনায় কমপক্ষে একশ’ মানুষ নিহত হন। আহত হন কয়েক শত। আটক করা হয় বিএনপির কয়েক হাজার নেতাকর্মীকে। অভিযোগ রয়েছে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড ও পায়ে পুলিশের গুলি করার। রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র ও যুব শাখাগুলোর সহিংসতা একটি সমস্যা।
পরিস্থিতি
মানবাধিকার গ্রুপ ও মিডিয়ার রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, অনেক গুম ও অপহরণ অব্যাহত ছিল ওই বছরে। এর অনেকগুলোর জন্য দায়ী করা হয় নিরাপত্তা রক্ষাকারীদের। বিশেষ করে এ ঘটনা ঘটে জাতীয় নির্বাচনের বর্ষপূর্তিকে কেন্দ্র করে সহিংসতার সময়ে। এসব ঘটনা প্রতিরোধে বা তদন্তে সরকার সীমিত পর্যায়ের উদ্যোগ নিয়েছে। ২০১৫ সালের ১৪ই জানুয়ারি রংপুরে সাদা পোশাকে নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা প্রহার করে আল আমিন কবিরকে। এরপর তাকে, তার স্ত্রী ও গৃহকর্মীকে তুলে নিয়ে যায়। কবিরের ভাই বলেছেন, বাসে অগ্নিসংযোগের একটি ঘটনা তদন্ত করছিল নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনী। কিন্তু জুলাই নাগাদ তুলে নেয়া তিন ব্যক্তি কোথায় তা জানা যায়নি। ১০ই মার্চ বিএনপির মুখপাত্র ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সালাহউদ্দিন আহমেদকে ঢাকার অ্যাপার্টমেন্ট থেকে তুলে নিয়ে যায় সাদা পোশাকের লোকজন। বিএনপি দাবি করে তাকে অপহরণ করা হয়। সালাহউদ্দিনের স্ত্রী আদালতে হেবিয়াস করপাস অ্যাকশন দাবি করে একটি মামলা করেন। মে মাসের শুরুর সময় পর্যন্ত তিনি কোথায় ছিলেন তা জানা যায়নি। যখন তিনি ভারতের শিলংয়ে একটি হাসপাতালে রহস্যজনকভাবে উদয় হলেন, সেখানে তার বিরুদ্ধে ভারতে অনুপ্রবেশের অভিযোগ আনা হয়।
নির্যাতন ও নিষ্ঠুর আচরণ
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধান ও আইনে নির্যাতন, নিষ্ঠুরতা, অবমানবিকতা, মর্যাদাহানিকর শাস্তি নিষিদ্ধ। তারপরও স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক নানা মানবাধিকার সংগঠন ও মিডিয়া রিপোর্ট করেছে, র্যাব, পুলিশসহ নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার ও জিজ্ঞাসাবাদের সময় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে। নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী বারবার হুমকি, প্রহার, বৈদ্যুতিক শক ব্যবহার করে। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন মাঝে মাঝে যৌন নির্যাতনও করে থাকে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠন অধিকার-এর মতে, বছরের প্রথম সাত মাসে নির্যাতন করে তিনজন ব্যক্তিকে হত্যা করেছে নিরাপত্তারক্ষাকারী বাহিনীর লোকেরা। এসব কর্মকাণ্ডের জন্য যারা দায়ী তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা, অভিযোগ গঠন করে শাস্তি দেয়ার ঘটনা বিরল। ২০১৪ সালে থানার ভিতরে এক ব্যবসায়ীকে নির্যাতনের অভিযোগে এপ্রিলে সিলেট কোতোয়ালি থানা পুলিশের ওসি আতাউর রহমান ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেন। তাকে জেল দেয়া হয়েছে। আইনের অধীনে একজন ম্যাজিস্ট্রেট জিজ্ঞাসাবাদের জন্য রিমান্ড দিতে পারেন। এ জিজ্ঞাসাবাদে আইনজীবী উপস্থিত থাকেন না। আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন বন্দিদের ওপর যৌন নির্যাতন চালান। অক্টোবরে বোয়ালখালি থানা পুলিশের এক কনস্টেবলের বিরুদ্ধে ধর্ষণ চেষ্টার অভিযোগ আনেন এক নারী।
জেলখানা পরিস্থিতি
জেলখানার পরিস্থিতি তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের জেলখানা উপচে পড়ছে বন্দিতে। সেখানে অপর্যাপ্ত সব সুবিধা। পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নাজুক। ফলে বন্দিদের অবস্থা শোচনীয় ও জীবন হুমকির মুখে। স্থানীয় একটি এনজিও এ অবস্থাকে ‘কাস্টডিয়াল ডেথ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। আগস্টে বন্দির সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৯৭১৯ জনে। অথচ বন্দি ধারণ ক্ষমতা আছে মাত্র ৩৪৬৮১ জনের। শতকরা ৭৪ ভাগ বন্দি আটকা রয়েছেন বিচার শুরুর আগেই অথবা তাদের বিচার চলছে। অভিযুক্ত বন্দিদের সঙ্গে রাখা হয়েছে বিচার শুরু হয়নি এমন বন্দিদের। জেলখানায় অতিরিক্ত বন্দি থাকায় তাদের ঘুমাতে হয় শিফট করে। এছাড়া টয়লেট সুবিধা অপর্যাপ্ত। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো ও মিডিয়া বলছে, অনেক বন্দি মেডিকেল সুবিধা বা পানি পান না। বন্দিদের যেখানে রাখা হয় সেখানে তাপমাত্রা অনেক বেশি। ভেন্টিলেশন নাজুক। আইন অনুযায়ী, প্রাপ্ত বয়স্কদের থেকে কিশোর অপরাধীদের আলাদা রাখার নিয়ম। কিন্তু অনেক কিশোর প্রাপ্ত বয়স্কদের সঙ্গে থাকছে। আন্তর্জাতিক কমিটি অব রেড ক্রস বা অন্য কোনো নিরপেক্ষ মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকদের জেলখানা পরিদর্শনের অনুমতি দেয় না সরকার। তবে বিদেশি বন্দিদের সঙ্গে সাক্ষাতের জন্য বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটিকে অনুমতি দেয় সরকার। জেলা জজরা মাঝে মধ্যে জেলখানা পরিদর্শন করে থাকেন।
খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার
সংবিধানে খেয়ালখুশি মতো গ্রেপ্তার ও আটক রাখা নিষিদ্ধ হলেও আইন সন্দেহজনক ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার ও আটক রাখার অনুমতি দিয়েছে কর্তৃপক্ষকে। এক্ষেত্রে কোনো ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশ বা ওয়ারেন্ট প্রয়োজন হয় না। মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেন নির্বাহী বিভাগের ম্যাজিস্ট্রেট। তিনি তাৎক্ষণিক রায় দিয়ে দেন। এর মধ্যে জেলও দেয়া হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তি আইনি প্রতিকার পাওয়ার সুবিধা পান না। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পুলিশ অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা ও আইনশৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পাওয়া প্রতিষ্ঠান। র্যাবসহ নিরাপত্তারক্ষার দায়িত্বে থাকা বাহিনীগুলো অব্যাহতভাবে দায়মুক্তি থাকায় আইন লঙ্ঘন করে যাচ্ছে।
সুষ্ঠু বিচার
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের ১৬তম সংশোধনীর অধীনে ২০১৪ সালে হাইকোর্টের কোন বিচারককে অভিশংসনের ক্ষমতা পায় পার্লামেন্ট। কিন্তু অক্টোবর পর্যন্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে এমন কোনো আইন লিখিতভাবে পাওয়া যায়নি। দুর্নীতি ও মামলাগুলোর পশ্চাৎপদতার কারণে আদালতের কর্মকাণ্ড বিলম্বিত হচ্ছে। এজন্য অনেক সাক্ষীর মন ঘুরে যাচ্ছে, ভীতি প্রদর্শনের শিকার হচ্ছেন, বিবাদী প্রমাণ হারিয়ে ফেলছেন। মানবাধিকার বিষয়ক পর্যবেক্ষকরা বলছেন, অনেক মামলায় ম্যাজিস্ট্রেট, এটর্নি, কোর্টের বিভিন্ন কর্মকর্তা বিবাদীদের কাছে ঘুষ দাবি করেন। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিটি) ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময়কার অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্তদের বিচার অব্যাহত রেখেছে। এপ্রিলে ফাঁসি কার্যকর করা হয় জামায়াতে ইসলামির সিনিয়র সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের। এক্ষেত্রে বিচারের সুষ্ঠুতা ও স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। নভেম্বরে সরকার একই রকম অপরাধে ফাঁসি কার্যকর করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের। সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আইনজীবীরা বলেছেন, আদালত তাদেরকে প্রমাণ হাজির করার অনুমতি দেননি। তাদের দাবি, অপরাধের সময় দেশের বাইরে ছিলেন সালাউদ্দিন।
ব্যক্তিগত গোপনীয়তায় হস্তক্ষেপ
মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো অভিযোগ করেছে, পুলিশের স্পেশাল শাখা, জাতীয় বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সরকারের সমালোচনা করে এমন ব্যক্তিদের ওপর নজরদারি করতে ও তাদের কর্মকাণ্ডের রিপোর্ট করার জন্য ইনফরমার বা সোর্স মোতায়েন করেছে। এছাড়াও নিয়মিতভাবে বিরোধী রাজনীতিকদের ওপর নজরদারি করে যাচ্ছে সরকার। মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলো ও বিভিন্ন নিউজ মিডিয়া বলছে, যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি ছাড়াই নাগরিকদের প্রাইভেট হোমগুলোতে প্রবেশ করছে পুলিশ।
মুক্ত মত ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানে মুক্ত মত প্রকাশ ও মিডিয়ার স্বাধীনতা দেয়া হয়েছে। কিন্তু সরকার মাঝে মধ্যেই এসব অধিকারের প্রতি সম্মান দেখাতে ব্যর্থ হচ্ছে। মত প্রকাশের ক্ষেত্রে রয়েছে সীমাবদ্ধ স্বাধীনতা। হয়রানি ও প্রতিশোধ নেয়ার ভয়ে সরকারের সমালোচনার ক্ষেত্রে কিছু সাংবাদিক নিজেরাই সেলফ সেন্সরশিপ আরোপ করেছেন। সংবিধানের সমালোচনাকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার সমান বলে বিবেচিত হয়। এ আইনে ঘৃণামূলক বক্তব্য সীমাবদ্ধ করে দেয়া হয়েছে, যদিও ঘৃণামূলক বক্তব্য বা হেট স্পিচ বলতে কী বোঝায় তা পরিষ্কারভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়নি। এক্ষেত্রে সরকার বিপুল ক্ষমতা পেয়েছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার বিরুদ্ধে হুমকি মনে হলেই, বিদেশী কোনো রাষ্ট্রের বন্ধুত্বের বিরুদ্ধে গেলে, আইন শৃঙ্খলার বিরুদ্ধে, নৈতিকতার বিরুদ্ধে গেলে, আদালত অবমাননার পর্যায়ের হলে সরকার মত প্রকাশকে সীমিত করতে পারে। অক্টোবরে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের পারফরমেন্স ও নিরপেক্ষতা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে তাদের রিপোর্টে। টিআইবির নির্বাহী পরিচালক জাতীয় সংসদকে ‘পাপেট শো থিয়েটার’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি জাতীয় সংসদকে কার্যকর করার জন্য সবার অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন দাবি করেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকরা বলছেন, বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা মিডিয়ার ওপর প্রভাব বিস্তার করেছে। তারা সরকারি বিজ্ঞাপন ও বেসরকারি বিজ্ঞাপন বন্ধ রাখার অংশ হিসেবে এসব করেছে। মোবাইল ফোন কোম্পানি গ্রামীণ ফোন মিডিয়াকে বলেছে যে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদেরকে ও অন্যান্য করপোরেশনকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে যেন, তারা দুটি শীর্ষ স্থানীয় পত্রিকায় বিজ্ঞাপন না দেয়। সরকারের হস্তক্ষেপ ছাড়া ক্যাবল অপারেটররা কাজ করতে পারেন না। সরকার চায়, সব টেলিভিশন স্টেশন থেকে সরকারের নির্বাচিত খবর বিষয়ক কর্মসূচি ও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য প্রচার করা হোক। গোয়েন্দা বিভাগসহ সরকারের হাতে সাংবাদিকরা মাঝেমধ্যেই শারীরিক হামলা, হয়রানি ও ভয়ভীতির মুখে পড়েন। বিরোধী দল বিএনপির এক নেতার ৫০ মিনিটের এক বক্তব্য সম্প্রচারের পর একুশে টেলিভিশনের চেয়ারম্যান আবদুল সালামকে জানুয়ারিতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফির অভিযোগ আনা হয়। পরে আনা হয় রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ। ধর্মনিরপেক্ষ লেখক বা ইসলামবিরোধী লেখার কারণে ২০১৫ সালে উগ্রপন্থিরা হত্যা করেছে চারজন ব্লগারকে। হত্যাকাণ্ডগুলো তদন্তে ও সন্দেহজনকদের ধরতে সরকার কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। সরকারি কর্মকর্তারা হত্যাকাণ্ডগুলোর নিন্দা করেছেন। একই সঙ্গে তারা সতর্কতা উচ্চারণ করেছেন যে, অন্যের ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কিছু কারো লেখা উচিত নয়। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া একটি অপরাধ হিসেবে গণ্য। ব্লগার অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ডের পর দুটি আলাদা অথচ কাছাকাছি ঘটনায় উগ্রপন্থিরা একজনকে হত্যা করে ও আহত করে তিনজনকে। এদের একজন অভিজিৎ রায়ের বইয়ের প্রকাশক।
এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে আল-কায়েদা ইন দ্য ইন্ডিয়ান সাবকন্টিনেন্ট। হুমকি ও হয়রানির মাধ্যমে সরকার পরোক্ষভাবে মিডিয়াকে সেন্সরশিপ করতে বলে। অনেক সময়ে সরকারি কর্মকর্তারা বেসরকারি মালিকানাধীন টেলিভিশন চ্যানেলকে বিরোধীদলীয় কর্মকাণ্ড ও বিবৃতি সম্প্রচার না করতে বলেন। সরকার ও প্রধানমন্ত্রীর সমালোচনামূলক রিপোর্ট করার কারণে প্রথম আলো ও ডেইলি স্টারকে প্রধানমন্ত্রীর বিভিন্ন ইভেন্টে যেতে দেয়া হয়নি। কিছু সাংবাদিক ও মানবাধিকার বিষয়ক এনজিওর মতে, নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনী প্রতিশোধ নেবে এ ভয়ে সাংবাদিরা সেলফ সেন্সরশিপ চালিয়ে যাচ্ছেন। সরকারের সমালোচনা ছিল সাধারণ বিষয় ও মুখেমুখে। কিছু মিডিয়া ব্যক্তিত্ব সরকারের হাতে হয়রানির আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। পূর্বসূরি বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও রাজনৈতিক সমর্থকদের নতুন সম্প্রচার লাইসেন্স ইস্যু করেছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে এক্ষেত্রে সে লাইসেন্স দেয়া হয়নি। বিদেশি প্রকাশনা ও চলচ্চিত্র পর্যালোচনার পর্যায়ে বা সেন্সরশিপ করেনি সরকার। তবে বাংলাদেশে অবস্থানকারী বিদেশি কিছু সংবাদ প্রতিনিধি বলেছেন, সেলফ সেন্সরশিপ আরোপে তাদের ওপর চাপ আছে। সরকার স্থানীয় ও বিদেশি ছবি পর্যালোচনার জন্য একটি ফিল্ম সেন্সরশিপ বোর্ড গঠন করেছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, আইন শৃঙ্খলা, ধর্মীয় অনুভূতি, অশ্লীলতা, বৈদেশিক সম্পর্ক, মানহানীসহ বিভিন্ন বিষয়ে কর্তৃপক্ষ ছবি সেন্সর করে বা বাতিল করার কর্তৃত্ব আছে এর। কিন্তু আগের চেয়ে এক্ষেত্রে কড়াকড়ি অনেকটা কমেছে। ফেব্রুয়ারিতে ইংরেজি সংবাদপত্র ডেইলি স্টার ‘ফ্যানাটিকস রাইস দেয়ার আগলি হেডস এগেইন’ শিরোনামে রিপোর্টে প্রচারণামূলক একটি পোস্টারের ছবি প্রকাশ করে। এর ফলে জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন যে, নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনকে পৃষ্ঠপোষকতা করার চেষ্টার কারণে ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয়া উচিত সরকারের। অক্টোবরে আল-কায়েদা ইন ইন্ডিয়া সাব কন্টিনেন্ট সমর্থিতরা মিডিয়ায় হুমকি দিয়ে চিঠি পাঠায়। এতে তারা বলে, নারী সাংবাদিকদের চাকরি দিয়ে, বেপর্দায় নারীদের প্রদর্শন করে তারা ইসলামের অবমাননা করছে।
এর মধ্য দিয়ে তারা শরীয়া আইন লঙ্ঘন করছে। ২০১৫ সালে সরকার ইন্টারনেট সুবিধায় কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করে এবং অনলাইন কনটেন্টগুলো সেন্সর করে। এ ছাড়া বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্ট রয়েছে যে, সরকার বেসরকারি অনলাইন যোগাযোগের বিষয়টিতে নজরদারি করছে। অনলাইন এক্টিভিটিকে সীমিত করার জন্য সরকার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ব্যবহার করেছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনার হুমকি দিয়েছে। এসব ঘটনায় শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড হতে পারে। জাতীয় ঐক্যের জন্য ক্ষতিকর হতে পারে বা ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত আসতে পারে এমন উপাদানগুলো ইন্টারনেট থেকে ছেঁকে আলাদা করেছে বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন। বেশ কিছু ফেসবুক পেজ বন্ধ করেছে সরকার। এর মধ্যে কোনো কোনোটিতে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়া হয়েছে। কোনো কোনোটিতে প্রধানমন্ত্রী বা বিরোধীদলীয় নেতার বিরুদ্ধে সমালোচনা রয়েছে। মিডিয়া রিপোর্ট করেছে যে, সরকার যখন নভেম্বর ও ডিসেম্বরে ফেসবুক বন্ধ করে দেয়ার নির্দেশ দেয় তখন সরকারের বিভিন্ন বিভাগ ও রাজনীতিকরা তাদের নিজেদের পেজ ঠিকই আপডেট করেছেন অব্যাহতভাবে। ফেসবুকে প্রধানমন্ত্রী ও তার ছেলেকে নিয়ে ব্যঙ্গচিত্র প্রকাশ করার অপরাধে জানুয়ারিতে পুলিশ গ্রেপ্তার করে বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ফিরদাতুল মুনতাহা সানজিদাকে। প্রধানমন্ত্রীকে নিয়ে ফেসবুকে একটি কার্টুন প্রকাশের অভিযোগে মে মাসে পুলিশ রোমান পালোয়ান নামে একজনকে গ্রেপ্তার করে তার বিরুদ্ধে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনে মামলা করেছে।
শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানে সভা সমাবেশের অধিকার দেয়া আছে। সরকারও এসব অধিকারের প্রতি সম্মান দেখায়। তবে অনেক ক্ষেত্রেই রাজনৈতিক প্রতিবাদ, অসন্তোষের সময় মুক্তভাবে সমাবেশ সীমাবদ্ধ করেছে সরকার। বিশেষ করে ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে যখন সহিংসতা শুরু হয় তখন তা বেশি করা হয়েছে। সরকার মাঝে মাঝেই রাজনৈতিক দলগুলোর সভা সমাবেশ অনুষ্ঠানে বাধা দিয়েছে। আইনের অধীনে একসঙ্গে চারজনের বেশি লোক সমাবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কর্তৃত্ব পেয়েছে সরকার। প্রতিবাদ বিক্ষোভ করতে হলে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাছ থেকে আগেভাগেই অনুমতি নিতে হয়। মানবাধিকার বিষয়ক এনজিওগুলোর মতে, সরকার ক্রমাগতভাবে বর্ধিতহারে এই ধারাটি ব্যবহার করেছে। বিশেষ করে তা হয়েছে নির্বাচনের বার্ষিকীর সময়ে। অনেক সময়ে পুলিশ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা প্রতিবাদ বিক্ষোভ বানচাল করতে শক্তি ব্যবহার করেছে। নির্বাচনের বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে চারদিক যখন টালমাটাল তখন মার্চে জাতীয় ক্রিকেট দলের বিজয় উদযাপনের জন্য আওয়ামী লীগকে র্যালি শোভাযাত্রা করার অনুমতি দেয়। কিন্তু একই রকম কর্মসূচি বিএনপি নিলে তাদেরকে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামে বিদেশিদের চলাচলের ক্ষেত্রে কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। কিন্তু আগস্ট পর্যন্ত পরিষ্কার হওয়া যায়নি, কিভাবে সরকার ওই বিধিনিষেধ কার্যকর করবে। শরণার্থী, আশ্রয় প্রার্থী, রাষ্ট্রহীন মানুষ ও উদ্বেগজনক অবস্থায় থাকা মানুষদের সহায়তা ও সুরক্ষায় জাতিসংঘ শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার ও অন্যান্য মানবাধিকার বিষয়ক সংগঠনগুলোকে পূর্ণ সহযোগিতা দেয়নি বাংলাদেশ সরকার। বিরোধী দলের কিছু সিনিয়র কর্মকর্তা তাদের পাসপোর্ট নবায়নে বিলম্বের অভিযোগ করেছেন। অন্যরা বিদেশে যাওয়ার সময় বিমানবন্দরে হয়রানি ও বিলম্বিতকরণের অভিযোগ করেছেন।
রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের স্বাধীনতা
প্রতিবেদনে বলা হয়, সংবিধানের অধীনে নাগরিকরা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনে তাদের সরকার নির্বাচিত করার অধিকার রাখেন। কিন্তু সাম্প্রতিক নির্বাচনগুলোতে ব্যাপক ট্যাম্পারিংয়ের কারণে ও বিরোধীদের বর্জনের কারণে তার সুনাম নষ্ট হয়েছে। প্রধান বিরোধী দল ২০১৪ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন করে। এতে পার্লামেন্টের অর্ধেকের বেশি আসনে প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। আবার অনেকে শুধু নামমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন। এর কারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না বললেই চলে। বেশিরভাগ ভোটার তাদের পছন্দের প্রার্থী বেছে নিতে ভোট দিতে পারেননি। কয়েক মাসের রাজনৈতিক উত্তেজনা ও সহিংসতার পর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনী পর্যবেক্ষকরা নির্বাচন কেন্দ্রের ভিতরে বা পাশেই সহিংস ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছেন। ভোটারদের বাধা দেয়া হয়েছে। জোর করে ভোট দিতে বাধ্য করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী ও তার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ৩০০ আসনের মধ্যে ২৩৫টিতে জিতে ক্ষমতায় ফিরে। নির্বাচন বর্জন করায় জাতীয় সংসদে বিএনপির কোনো আসনই নেই। সরকারিভাবে বিরোধী দল জাতীয় পার্টির রয়েছে ৩৬টি আসন। তারা ক্ষমতাসীন জোটের শরিক। সরকারকে সমর্থন করে এমন দলগুলো বাকি আসনের বেশিরভাগ পেয়েছে। শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় রয়েছে তার জোটের অন্য দলগুলোর প্রতিনিধি। ২৮শে এপ্রিল ঢাকা ও চট্টগ্রামে সিটি করপোরেশন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যমতে, ওই নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি হয়েছে। ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে। সহিংসতা হয়েছে। অনিয়মের অভিযোগে ভোটগ্রহণ শুরুর তিন ঘণ্টার মধ্যেই বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা নির্বাচন থেকে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। কর্তব্যে অবহেলা ও অনিয়মের কারণে নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য ছিল না বলে উল্লেখ করে নির্দলীয় সুশীল সমাজের নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপ। কয়েক মাস ধরে বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য পদক্ষেপ নেয়ার পর ৩০শে ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় স্থানীয় নির্বাচন। নির্বাচন ছিল ব্যাপক অর্থে অবাধ ও সুষ্ঠু। পর্যবেক্ষকরা নির্বাচনের স্থানগুলোতে শতকরা প্রায় ৮ থেকে ১২ ভাগ অনিয়মের রিপোর্ট করেন। সহিংসতা হয়েছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের মধ্যে। তবে নিয়মিত ভোটাররা এর টার্গেট ছিলেন না। বিএনপির বর্জনের পর ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনে ভোটারের অংশগ্রহণ ছিল খুব কম। নির্বাচন কমিশন দেখিয়েছে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হওয়া ১৪৭ আসনে গড়ে ৪০ ভাগ ভোট পড়েছে।। ২০০৯ সালে এই ভোট ছিল শতকরা ৮০ ভাগেরও বেশি। তবে যেহেতু একজন মাত্র প্রার্থী ছিলেন তাই ১৫৩টি আসনে কোনো ভোটই হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে বিরোধী রাজনৈতিক দলকে প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠান করার ক্ষেত্রে তাদের অধিকারে হস্তক্ষেপ করেছে সরকার। বিরোধীদের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সম্প্রচার সীমিত করে দেয়া হয়েছে।
দুর্নীতি ও সরকারে স্বচ্ছতার অভাব
আইন থাকা সত্ত্বেও সরকারি কর্মকর্তাদের দুর্নীতির ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করেনি সরকার। কর্মকর্তারা প্রায়ই দুর্নীতিমূলক কাজে জড়িয়েছেন। শাস্তির ঝুঁকিমুক্ত থেকেই তারা এসব করেছেন। মানবাধিকার সংগঠন, গণমাধ্যম, দুর্নীতি দমন কমিশনসহ অন্যান্য সংগঠনগুলো সরকারি দুর্নীতির রিপোর্ট করেছে। ২০১০ সালের ওয়ার্ল্ড ব্যাংক রিপোর্ট অনুযায়ী, দুদকের কাজ খর্ব করেছে সরকার।
ব্যাহত করেছে দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিচার প্রক্রিয়া। সরকারি একটি কমিশন দুদককে হাজারো দুর্নীতি মামলা খারিজ করার সুপারিশ করে। ইউএন কনভেনশন এগেইনস্ট করাপশন সিভিল সোসাইটি কোয়ালিশনের একটি রিপোর্টের উদ্ধৃত করে টিআইবি ২০১১ সালের এক বিবৃতিতে জানায়, সরকার দুদককে ১০৫৩৬টি মামলা প্রত্যাহার করতে বলেছে। সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী সংসদের অভিশংসন ক্ষমতা বিস্তৃত করে অন্তর্ভুক্ত করেছে দুদক, নির্বাচন কমিশন, ন্যাশনাল হিউম্যান রাইটস কমিশন (এনএইচআরসি) ও অন্যান্য সাংবিধানিক কমিশনকে। সুশীল সমাজের অনেকে বলেছেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করতে সরকার আন্তরিক নয়। আর তারা রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত মামলার জন্য দুদককে ব্যবহার করেছে। টিআইবি মন্তব্য করেছে, দুদকের কর্মকাণ্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ সংস্থাটিকে ‘দন্তহীন বাঘ’-এ পরিণত করেছে। ২০১৩ সালে সংশোধিত দুদকের একটি আইন সরকারের আগাম অনুমতি ব্যতিরেকে সরকারি কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে সংস্থাটির মামলা করার ক্ষমতা বাতিল করেছে।
সরকার পুলিশের ব্যাপক দুর্নীতি ঠেকাতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। দুর্নীতি মোকাবিলায় ও আরও শক্তিশালী পুলিশ বাহিনী গঠনে পুলিশের মহাপরিদর্শক পুলিশ সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেয়া অব্যাহত রেখেছেন। তবে, পুলিশ বাহিনীর ভেতরে দুর্নীতির ওপর এসব প্রশিক্ষণের প্রভাব নিয়ে কোনো পর্যালোচনা পাওয়া যায়নি বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, বিচার ব্যবস্থার মধ্যে দুর্নীতি অব্যাহতভাবে মারাত্মক একটি সমস্যা। বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতার পেছনে এটা একটা কারণ। এই দীর্ঘসূত্রতা সাক্ষ্যপ্রমাণ প্রভাবিত করা ও ভুক্তভোগীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের সুযোগ করে দেয়। বিচার বিভাগের দৃশ্যমান রাজনীতিকরণ নিয়ে জনঅসন্তোষ বৃদ্ধির ইঙ্গিত মিলেছে মানবাধিকার সংস্থা ও দুর্নীতি পর্যবেক্ষক গ্রুপগুলোর নানা রিপোর্টে।
৪২ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে নারীদের ওপর সহিংসতা, শিশু নির্যাতন, বাল্যবিবাহ, ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর সহিংসতা, লিঙ্গবৈষম্য, শ্রমিক অধিকার, শিশুশ্রম ও কর্মস্থলে বৈষম্যের বিষয় তুলে ধরা হয়।