৩২ নম্বর_ এটুকু বললেই যে-কেউ বুঝতে পারেন রাজধানীর বনেদি আবাসিক এলাকা ধানমণ্ডির সেই স্থান। বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। সেখানেই এখন ‘বঙ্গবন্ধু জাদুঘর’। কিন্তু কী অবস্থা সেই আবাসিক এলাকার? ৩২ নম্বর রোডের ৬৬৭/এ নম্বর হোল্ডিংয়ে রয়েছে ”সাইফুর’স ডেন্টাল সার্জারি” নামের ক্লিনিক। জাদুঘরটির সামনে দিয়ে পশ্চিমে এগিয়ে কয়েকটি ভবন পরই ১১ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর হোল্ডিং। চারতলা ভবনটির সম্মুখস্থানজুড়ে নানা ধরনের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ড। নিচতলায় ফাস্টফুডের দোকান ‘গোলপিয়া বার্গার’, অপরাংশে মুদি দোকান। চতুর্থ তলা ছাড়া প্রতিটি তলা বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহৃত হচ্ছে। পুরো ধানমণ্ডির অবস্থাই অনেকটা এরকম। সবাই জানেন, কার্যত এটা অংশত বাণিজ্যিক এলাকা। শুধু ধানমণ্ডি নয়_ রাজউকের নকশাতে আবাসিক হিসেবে অনুমোদিত রাজধানীর এমন ৫৪ হাজার আবাসিক ভবনে এবং ৭ হাজার সরকারি প্লটে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। তবে পরিকল্পিত ঢাকা নগর প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে অচিরেই ধাপে ধাপে অভিযান চলবে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা এসব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানে। গত ৪ এপ্রিল মন্ত্রিসভার বৈঠকে আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধে ছয় মাস সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এরপর প্রয়োজনে ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চলবে। প্রথম দফায় অভিযান চলবে রাজধানীর সাতটি এলাকাতে। যে সব আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে, সে সব ভবনে তখন গ্যাস, পানি ও বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ করে দেওয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।
এ ব্যাপারে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘শিগগিরই আন্তঃমন্ত্রণালয় বৈঠক করে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের করণীয় নির্ধারণ করা হবে।’ রাজউকের চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন ভুঁইয়া বলেন, ‘পানি, বিদ্যুৎ না থাকলে কেউ
সেখানে কোনো কাজও করতে পারবে না। তখন বাধ্য হয়েই সেটা বন্ধ করে দিতে হবে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ পেলেই আমরা মাঠে নামব।’
সরকারের তরফ থেকে বলা হয়েছে, নিজ উদ্যোগেই সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আগামী ছয় মাসের মধ্যে আবাসিক ভবনে থাকা বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো সরিয়ে নিতে হবে। তবে গণপূর্ত মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার বিভাগ ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সংশয় রয়েছে, এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে কি-না। এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেক জানান, খুব শিগগিরই আন্তঃমন্ত্রণালয়ের বৈঠক করে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের করণীয় নির্ধারণ করা হবে।
সরেজমিন ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা :ধানমণ্ডির ১১ নম্বর সড়কের ২০ নম্বর হোল্ডিংয়ের ভবনটির মালিক হাজি শরফুদ্দিনকে খোঁজ করেও পাওয়া যায়নি। কেয়ারটেকার জানালেন, ‘তিনি পুরান ঢাকায় থাকেন।’ তার কোনো ফোন নম্বরও নাকি জানেন না তিনি!
ভবনটির গায়ে সাঁটানো আছে রিসোর্স ইন্টিগ্রেশন সেন্টার, ঢাকা আহছানিয়া মিশন, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজ, নাগরিক উদ্যোগ সহায়তা প্রকল্প, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন ও নাগরিক অধিকার সংরক্ষণ পরিষদসহ বেশ কয়েকটি সাইনবোর্ড। ওইসব প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা জানান, ভবন বাণিজ্যিক, না আবাসিক সেটা তাদের দেখার বিষয় নয়! মালিক ভাড়া দিয়েছেন। তারা ভাড়া নিয়েছেন। রাজউক জানিয়েছে, ওই সড়কে এ পর্যন্ত একটিও বাণিজ্যিক ভবনের অনুমোদন দেওয়া হয়নি।
ধানমণ্ডির ৭/এ নম্বর রোডের ৫৮ নম্বর হোল্ডিংয়ে গিয়ে দেখা যায়, নিচতলায় বিশালাকৃতির ‘মি. বেকার কেক অ্যান্ড পেস্ট্রি শপ’। দোকানে গিয়ে কথা বলতে চাইলেও কেউ রাজি হলেন না। পরে ভবনের নিরাপত্তা কর্মীকে ভবন মালিকের সঙ্গে কথা বলার সুযোগ চাইলে তিনি পিএবিএক্স দিয়ে যোগাযোগ শেষে জানালেন, ‘কথা বলা সম্ভব না’।
ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকাতেই এ রকম এক হাজার ১৭০টি আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে।
লালমাটিয়া :রাজধানীর লালমাটিয়ার এ ব্লকের ৬/৩ নম্বর হোল্ডিংয়ের তিনতলা আবাসিক ভবনটির নিচতলার পশ্চিম পাশে রয়েছে তামিম হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্ট। মাঝামাঝি স্থানে রয়েছে আইইএলটিএস, স্পোকেন ইংলিশ ও বিদেশে ছাত্রদের ভর্তি-সংক্রান্ত ভিসা প্রসেসিং অফিস। পূর্ব পাশে রয়েছে একটি ডিপার্টমেন্ট স্টোর ‘প্রাকৃতিক কৃষি বিপণন কেন্দ্র’। সব মিলিয়ে নিচতলার বাণিজ্যিক ব্যবহার খুবই জমজমাট। দোতলার একাংশে থাকেন বাড়ির মালিকের পরিবার। এ ছাড়া ভবনটির বাকি অংশের বিভিন্ন ফ্ল্যাটে আছে হাওলাদার হাফিজুর প্রপার্টিজ, লিয়া অ্যাসোসিয়েটস লি., ত্রিয় সিন্ডিকেট, লিয়াকত’স কোচিং। ‘হাঙ্গার এঞ্জার’ নামে একটি ফাস্টফুডের দোকানের সাইনবোর্ডও আছে ফটকে।
ভবনের মালিক হাসান তৌফিক স্বীকার করলেন, নিয়ম অমান্য করে ভবনটিতে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। তিনি বললেন, ‘এই এলাকায় আরও অনেকেই এ রকম করছে। সবাই বন্ধ করে দিলে আমিও বন্ধ করে দেব।’ অবশ্য ভবনে কোচিং সেন্টার থাকায় অনেক শিক্ষার্থীর উপকারই হচ্ছে বলে দাবি করেন তিনি।
উত্তরা :উত্তরার ৪ নম্বর সেক্টরের রোড ১৯/এ-এর ৭ নম্বর হোল্ডিংয়ে গিয়ে দেখা গেল, পুরো ভবনটি ‘হোটেল নর্দান লিমিটেড’ নামের একটি হোটেলে পরিণত হয়েছে। হোটেল কর্তৃপক্ষ জানালেন, মালিকের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে তারা আবাসিক হোটেল দিয়েছেন। এ ভবনের মালিক সাদি স্বীকার করেন, আবাসিক ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম হচ্ছে। তিনি জানান, এ কারণে রাজউক একবার নোটিশও দিয়েছে তাকে। তাই চুক্তি বাতিল করার চিন্তা করছেন তিনি।
৫৪ হাজার ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম :ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ৩ লাখ ২০ হাজার হোল্ডিংয়ের মধ্যে প্রায় পৌনে ৩ লাখই আবাসিক ভবন। যেগুলোর ৫৪ হাজারেই চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। এ প্রসঙ্গে রাজউকের বোর্ড সদস্য (উন্নয়ন ও নিয়ন্ত্রণ) আসমাউল ইসলাম সমকালকে বলেন, ‘এটি প্রকৃত সংখ্যা নয়। তবে আমরা দেখেছি, প্রতি চারটি আবাসিক ভবনের একটির অংশবিশেষ হলেও বাণিজ্যিক কাজে ব্যবহার হয়। একটি বাড়ির সব কিছু ঠিক থাকলেও হয়ত নিচে ছোট পান-সিগারেট বা মোবাইলের টাকা রিচার্জের দোকান বসানো হয়। এ হিসেবে সংখ্যাটি ৫৪ হাজারের কম হবে না।’
বাণিজ্যিক কার্যক্রম সরকারি প্লটের ৭ হাজার ভবনে :বর্তমানে রাজধানী ঢাকাতে রাজউক ও পূর্ত বিভাগের দেওয়া আবাসিক প্লট রয়েছে বনানী, গুলশান, বারিধারা, উত্তরা, ধানমণ্ডি, মিরপুর ও মোহাম্মদপুর এলাকায়। এসব আবাসিক ভবনেও চলছে বাণিজ্যিক কার্যক্রম। বনানীর ৩৯৯, গুলশানের ৯০৪, উত্তরার এক হাজার ৪৯, মিরপুরের এক হাজার ৮৩৬, মোহাম্মদপুরের এক হাজার ৫৫২ ও ধানমণ্ডির এক হাজার ১৭০টি আবাসিকসহ মোট ছয় হাজার ৯১০টি ভবনে বাণিজ্যিক কার্যক্রম চলছে। এছাড়া বারিধারার কয়েকটি ভবনেও বাণিজ্যিক ব্যবহার রয়েছে।
প্রথম লক্ষ্য সাতটি এলাকা :এদিকে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ পরিকল্পনা করছে, প্রথম দফায় সরকারি সাতটি আবাসিক এলাকার বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ করতে। ছয় মাসের মধ্যে বাণিজ্যিক উদ্যোক্তারা নিজেরা তা বন্ধ না করলে রাজউক ও জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের দেওয়া তালিকা অনুযায়ী দুই সিটি করপোরেশন ওইসব ভবনের প্রতিষ্ঠানসমূহের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে দেবে। দ্রুত স্থানান্তরযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে উচ্ছেদ করা হবে। প্রয়োজনে ওইসব ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সিলগালা করে দেওয়া হবে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়, ডিপার্টমেন্ট স্টোর, গেস্টহাউসের মতো বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সময় বেঁধে দেওয়া হতে পারে। ছোট, মাঝারি ও ভারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে তিন ধাপে সময় দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের পর সমন্বিত অভিযান শুরু হবে।
নগর পরিকল্পনাবিদদের অভিমত :এ ব্যাপারে কারও দ্বিমত নেই যে, অপরিকল্পিত নগরায়নের মহানগর ঢাকা বসবাসের অনুপযোগী শহরে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ নিম্ন-মধ্য আয়ের দেশে পরিণত হলেও এবং নগরগুলোতে উন্নয়নের ছোঁয়া লাগলেও আবাসিক ও বাণিজ্যিক এলাকার সুস্পষ্ট বিভাজন না থাকার প্রভাব পড়েছে সর্বত্র। তাই পরিকল্পিত নগরের লক্ষ্যে এখনই সরকার কঠোর না হলে এই শহরকেই এক সময় পরিত্যক্ত ঘোষণা করতে হবে। তবে সরকারের সিদ্ধান্তকে সময়োপযোগী মনে করলেও এর বাস্তবায়ন সহজ হবে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা মনে করছেন, সরকারি আবাসিক এলাকাগুলোতে এ সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা গেলেও অন্যান্য এলাকায় সম্ভব নাও হতে পারে। বাণিজ্যিক কার্যক্রমে যুক্ত অনেকে বেকার হয়ে পড়বেন। সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো, সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়ন করতে গেলে এর মাধ্যমে সরকারবিরোধী আন্দোলন মাথাচাড়া দিতে পারে। তা ছাড়া পুরান ঢাকায় এর বাস্তবায়ন একেবারেই অসম্ভব বলে মনে করছেন অনেকে।
এ প্রসঙ্গে স্থপতি ইকবাল হাবিব সমকালকে বলেন, ‘অনেক সময় গড়িয়েছে। রাজউকের ব্যর্থতার কারণে এ অবস্থা হয়েছে। তাদের কোনো তদারকি নেই। যে কারণে আজ সরকারকে এ সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছে। তবে হিসাবনিকাশ করেই এটা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
তবে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর উন্নয়ন পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. ইশরাত জাহান বলেন, ‘ঢাকা শহর পরিকল্পিতভাবে গড়ে না ওঠায় আবাসিক এলাকাতেই প্রয়োজনের তাগিদে পরবর্তী সময়ে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। নগর পরিকল্পনার ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ জায়গা মিশ্র ব্যবহারের জন্য রাখার নিয়ম। ঢাকায় সেটা রাখা হয়নি। মধ্য উন্নয়নের দেশের সামঞ্জস্য রাখার জন্য যে রকম পরিকল্পনা ও নীতিমালা প্রয়োজন, সেসবও নেই।’ তিনি প্রশ্ন তোলেন, ‘এখন হুট করে ছয় মাস সময় দিলে এরা যাবে কোথায়? সেখানেও তো যানজটের সৃষ্টি হবে। কাজেই হুট করে বাণিজ্যিক ব্যবহার বন্ধ না করে তথ্য, উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে গবেষণার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত।’
নগর পরিকল্পনাবিদ স্থপতি মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘কয়েক বছর আগে রাজধানীতে ১৩ হাজার আবাসিক ভবনের বাণিজ্যিক ব্যবহার হতো। এ সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে। পরিকল্পিত আবাসিক এলাকাগুলোর অবস্থাও খুব খারাপ। তবে তাড়াহুড়া করে সিদ্ধান্ত নিলে বিপুল জনগোষ্ঠীর বেকার হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে। এরা তো দেশের অর্থনীতিতেও ভূমিকা রাখছে।