শিগগিরই এর খসড়া চূড়ান্ত করা হবে।
এ প্রসঙ্গে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন সমকালকে বলেন, ‘সরকারের উদ্দেশ্য হচ্ছে উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করা। এ জন্য উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা রয়েছে। আইনটি শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে যেসব প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, তা দূর করা হবে।’ তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে যে দাবিগুলো পাওয়া গেছে, তা পর্যালোচনা করা হচ্ছে। এগুলোর মধ্য থেকে যৌক্তিকগুলো আইনে সংযোজন করা হবে। আর যা অপ্রয়োজনীয়, তা আইন থেকে বাদ দেওয়া হবে।’ জনগণের প্রতিষ্ঠান হিসেবে জনগণের প্রতিনিধিদের স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষেত্র তৈরি করতেই তার মন্ত্রণালয় কাজ করছে বলে তিনি জানান।
তবে আইন সংশোধনীর বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞরা। তাদের মতে, একটি মহল স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে চায় না। তারা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখছে। যদি সরকার এ বলয়ের মধ্য থেকে বের হয়ে এসে একটি শক্তিশালী স্থানীয় সরকার করতে আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়, তা হলে ইতিবাচক ফল পাওয়া যাবে বলে মনে করেন তারা।
এমপিদের অবস্থান সম্পর্কে সিদ্ধান্ত আসেনি: দীর্ঘদিন ধরে উপজেলা চেয়ারম্যানরা এমপিদের পরিষদের পরামর্শক হিসেবে রাখার ধারাটি বাদ দিয়ে আইন সংশোধনের দাবি করে আসছেন। কিন্তু সংশোধনী আইনে পরিষদে এমপিদের পরামর্শক হিসেবে রাখা হবে, নাকি বাদ দেওয়া হবে- সে বিষয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ। তবে পরামর্শক হিসেবে না রাখার সম্ভাবনাই বেশি। শেষ পর্যন্ত তারা পরামর্শক হিসেবে থাকলেও কোন কোন ক্ষেত্রে তাদের পরামর্শ নিতে হবে, সে বিষয়গুলো নির্দিষ্ট করে দেওয়া হবে।
বেতন বাড়ছে চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের: উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানদের বেতন-ভাতা দ্বিগুণ করে সহসাই প্রজ্ঞাপন জারি হতে পারে। এরই মধ্যে এ নিয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগ একাধিক বৈঠকও করেছে। বর্তমানে উপজেলা চেয়ারম্যানের মাসিক বেতন ২০ হাজার ৫০০ টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যানদের বেতন ১৪ হাজার ৫০০ টাকা। চেয়ারম্যান একজন প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তার মতো ভ্রমণ-ভাতাসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন। এ ছাড়া চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানরা দায়িত্বভাতা পান।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের দাবি-দাওয়ার প্রেক্ষাপট: দীর্ঘদিন বিলুপ্ত থাকার পর সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে উপজেলা পরিষদ চালু করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০০৯ সালের ২২ জানুয়ারি দেশের ৪৮১টি উপজেলায় নির্বাচন হয়। একই বছর ফেব্রুয়ারির শেষ সপ্তাহে নির্বাচিত চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যানদের শপথ সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ এপ্রিল স্থানীয় সরকার (উপজেলা অধ্যাদেশ) বিলুপ্ত করে উপজেলা পরিষদ আইন-১৯৯৮ সংশোধন করে সরকার। ওই আইনে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে উপজেলা পরিষদের সচিব করা হয়। ওই সময়ে এ আইনে সন্তুষ্ট হতে পারেননি আমলারা। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা এ সময় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানান, এ আইনের মাধ্যমে তাদের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করা হয়েছে। পরে উপজেলা চেয়ারম্যানদের প্রবল আপত্তির মুখে ২০১১ সালে উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন করে ইউএনওদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা করা হয়।
এ সংশোধনের যুক্তি ছিল, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভায় প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা থাকেন। এর আদলে উপজেলা পরিষদেও ইউএনও মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন। উপজেলা চেয়ারম্যানরা শুরু থেকেই বলে আসছেন, এতে কিছু ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হচ্ছে। তারা বলছেন, ইউএনও মুখ্য কর্মকর্তা থাকায় সাধারণ জনগণের ধারণা জন্মেছে, পরিষদের মুখ্য সিদ্ধান্ত ইউএনও নিয়ে থাকেন। বর্তমানে উপজেলা পরিষদের বেশির ভাগ কমিটির সভাপতি ইউএনও হন, উপদেষ্টা রাখা হয় চেয়ারম্যানকে। উপজেলা চেয়ারম্যানদের অভিমত, এতেও নানা জটিলতা দেখা দেয়।
উপজেলা চেয়ারম্যানদের পক্ষ থেকে অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা পরিষদে ১৩ দপ্তর ও সংস্থা ন্যস্ত করা হলেও পরিষদের মুষ্টিমেয় কয়েক কর্মকর্তার কারণে তারা ঠিকমতো দায়িত্ব পালন করতে পারেন না। এর পর ২০১৪ সালে পুনরায় উপজেলা নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু এর পরও উপজেলা পরিষদ দৃশ্যত কার্যকর হয়নি বলে চেয়ারম্যানরা বিভিন্ন মহলে অভিযোগ করেন। পরিষদের কাজকর্ম নিয়ে তাদের মধ্যে এক ধরনের অনীহা দেখা দেয়। তারা আইন সংশোধন করতে সরকারের কাছে দাবি জানান। অষ্টম পে স্কেল ঘোষণা হওয়ার পর প্রকৃচি-বিসিএস সমন্বয় পরিষদও উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধনের দাবি তোলে। তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব আবদুল মালেকের সঙ্গে বৈঠক করে আইন সংশোধনীর বিষয়ে যুক্তি উপস্থাপন করেন। এ সময়ে তারা বলেন, উপজেলা পরিষদ আইন সংশোধন না করলে উপজেলা অন্যান্য অফিসের কর্মকর্তাদের কাজে অনীহা দেখা দিচ্ছে। তারা আইন সংশোধন করে উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করার দাবি জানান। পরে সরকার আইন সংশোধনীর কাজে হাত দিয়েছে।
সংশোধনীতে যেসব পরিবর্তন আসবে: বর্তমানে আইনটির ৩৩(১) ধারায় রয়েছে, উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন এবং সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন। ৩৩(২) ধারায় বলা হয়েছে, পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা নির্ধারিত কার্যাবলি পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা সম্পাদন করবেন। এ ধারা সংশোধন করে যুক্ত হবে, ‘উপজেলা নির্বাহী অফিসার পরিষদের সচিব হবেন এবং সাচিবিক দায়িত্ব পালন করবেন। চেয়ারম্যানের পরামর্শ নিয়ে পরিষদের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন, আর্থিক শৃঙ্খলা প্রতিপালন এবং বিধি দ্বারা অন্যান্য কার্যাবলি সচিব সম্পাদন করবেন।’ এ ছাড়া আইনের ২৯ ধারায়ও সংশোধন আসছে। এ ধারায় পরিষদের কয়েকটি কমিটিতে চেয়ারম্যানকে সভাপতি করার সুযোগ আসছে। বর্তমানে পরিষদের ১৭টি কমিটির সভাপতি হচ্ছেন ভাইস চেয়ারম্যান। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যানের ক্ষমতাও বাড়ছে। প্রকল্প নেওয়ার ক্ষেত্রে ভাইস চেয়ারম্যানদের মতামত অগ্রাধিকার দেওয়ার বিষয়টিও আইনে সংযোজন হচ্ছে।
নতুন আইনে উপজেলা পরিষদের কার্যক্রমের কিছু বিষয় স্পষ্ট করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত রয়েছে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো, উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারসহ অন্যান্য কর্মকর্তার ছুটির বিষয়ে জানাতে হবে। যদিও তারা তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার কাছ থেকে ছুটি নেবেন। সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির সভাপতি হবেন উপজেলা চেয়ারম্যান। তিনিই এসব কর্মসূচির আওতায় বরাদ্দ করা চাল বা গম ইউনিয়নভিত্তিক বণ্টন করবেন। তবে এসব কর্মসূচির আর্থিক ব্যাপারে তিনি সংশ্লিষ্ট থাকতে পারবেন না। অর্থাৎ কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন প্রকল্পের বিপরীতে তিনি ডিও দিতে পারবেন না। এ ক্ষমতা থাকবে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হাতে। স্থানীয় সরকারের আওতায় বিভিন্ন রাস্তাঘাট কালভার্ট, সেতুর জন্য টেন্ডার কমিটির সভাপতি হবেন উপজেলা চেয়ারম্যান। চেয়ারম্যান উপজেলা পরিষদের দৈনন্দিন প্রশাসনিক কাজ করবেন। তিনি পরিষদের নিজস্ব কর্মচারী নিয়োগ ও তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলামূলক ব্যবস্থা নিতে পারবেন। তিনি উপজেলা চেয়ারম্যান পরিষদে ন্যস্ত বিভিন্ন অফিসের কর্মচারী নিয়োগ কমিটির প্রধান হবেন। তিনি পরিষদের আওতাধীন বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, বৃত্তি ও পেশার জন্য লাইসেন্স দিতে পারবেন। উপজেলা চেয়ারম্যান ভূমি রাজস্ব আদায় ও ভূমি-সংক্রান্ত কোনো কাজ করতে পারবেন না। তিনি আইন-শৃঙ্খলাসংক্রান্ত বৈঠকে উপস্থিত থাকলেও আইন-শৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। উপজেলায় যে কোনো ধরনের নির্বাচন-সংক্রান্ত কমিটিতেও থাকতে পারবেন না তিনি। উপজেলা চেয়ারম্যানরা বিধিবহির্ভূত কোনো কাজ করলে উপজেলা নির্বাহী অফিসার সরকারি প্রতিনিধি হিসেবে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে জানাবেন। তাদের প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সরকার উপজেলা চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ উপজেলা পরিষদ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোজাম্মেল হক সরকার সমকালকে বলেন, ‘উপজেলা পরিষদ শক্তিশালী করতে হলে আইন সংশোধনের বিকল্প নেই। কারণ, এখন প্রেক্ষাপট পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো আইনে কোনো স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারবে না।’ তিনি জানান, তারা সরকারের কাছে আইন সংশোধনের বিষয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন। সরকারও আইন সংশোধন করা হবে বলে আশ্বস্ত করেছে।
– See more at: http://bangla.samakal.net/2016/04/11/205449#sthash.SfBkD7z5.dpuf