খোঁজ নেই ফেরদৌসুর রহমানের। নির্বাচনের পর থেকেই দেখা নেই তার। আসছেন না বিদ্যালয়ে। পরিবারের লোকজন এখন বলছেন তিনি ঢাকায় চিকিৎসাধীন। তবে কোথায় চিকিৎসা করাচ্ছেন সেটি তারা বলছেন না। নবীনগরের কৃষ্ণনগর আবদুল জব্বার উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। ৩১শে মার্চ অনুষ্ঠিত ভোটে নবীনগর উপজেলার বীরগাঁও ইউনিয়নের চর কেদারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসার ছিলেন ফেরদৌসুর রহমান। ঐদিন ভোট গণনার সময় কেন্দ্রটি দখল করে ফলাফল পাল্টানোর অভিযোগ রয়েছে। সশস্ত্র হামলা চালানো হয় কেন্দ্রটিতে। এসময় ফেরদৌসুর রহমানকে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। ঐদিনের পর থেকেই বেখবর হয়ে যান তিনি। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক মনির হোসেন বলেছেন, নির্বাচনের আগের দিন পর্যন্ত তিনি স্কুলে এসেছেন। এখন অসুস্থ, ঢাকায় চিকিৎসাধীন। ফেরদৌসুর রহমানের মা আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘ফেরদৌস অসুস্থ। তার কি হয়েছে আমি জানি না। আমার কাছে কিছু বলে না। আমি কিছু জানতে চাইলে বলে আপনি আমারে জিগাইয়েন না। আল্লাহ আমারে বাঁচাইছে। এতেই আপনি সবুর থাকেন। ঢাকায় কোথায় চিকিৎসা করাচ্ছে তা জানি না। নির্বাচনের পর রাতে বাড়িতে এসেছিলো। এরপর ঢাকায় চলে গেছে।’ তিনি জানান, কেন্দ্রে গণ্ডগোল হয়েছিলো। এরপর থেকেই সে ভয় পাচ্ছিল। আল্লাহ আমার ছেলেরে বাঁচাইছে এতেই আমি সবুর। চর কেদারখোলা কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ প্রার্থী জহির রায়হানের নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন ওয়ালী আহমেদ। তাকেও গুলি করে মারার চেষ্টা করা হয়। ওয়ালী তখন কবির আহমেদের পায়ে ধরে জীবন ভিক্ষা চান। প্রত্যক্ষদর্শী একজন জানান, ভোট গণনার সময় হঠাৎ একটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এতে কেন্দ্রের ভেতরে থাকা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। কেন্দ্রটিতে শান্তিপূর্ণ ভোট হয়েছে। তাই ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ সবাইকে বিচলিত করে তোলে। পরপর আরও কয়েকটি ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটে। এক-দেড়’শ লোক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী কবির আহমেদ কেন্দ্রটি ঘিরে ত্রাস সৃষ্টি করেন। তারা কেন্দ্রের ভেতর ঢোকার চেষ্টা করতে থাকেন। প্রার্থী কবিরসহ তাদের ৩ ভাইয়ের হাতে ছিলো পিস্তল। এই অবস্থা দেখে কেন্দ্রের ভেতর ঢোকার গেইটে তালা দিয়ে দেয়া হয়। তারা আওয়ামী লীগ প্রার্থীর এজেন্ট ওয়ালী আহমেদের নাম ধরে গালাগাল করতে থাকে। একপর্যায়ে তাদের ভয়ে গেইট খুলতে বাধ্য হয় কেন্দ্রের লোকজন। তারা ভেতরে ঢুকেই প্রিজাইডিং অফিসারের কক্ষে চলে যায়। তাকে শুয়োরের বাচ্চা, কুত্তার বাচ্চা বলে গালাগাল করে মারতে শুরু করে। ওয়ালীকে গুলি করে মারবে বলে খুঁজতে থাকে। ওয়ালী তখন লুকিয়ে থাকেন। প্রিজাইডিং অফিসার একপর্যায়ে ভয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যান। তাকে মারধর ও মানসিক নির্যাতন করা হয়। কবির আহমেদ প্রিজাইডিং অফিসারকে বলে তাকে ফার্স্ট রেজাল্ট দিতে হবে। সন্ধ্যা ৭টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত কেন্দ্রটিতে সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানো হয়। এরপর তাদের কথামতো রেজাল্ট বানিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারের কাছ থেকে সিগনেচার আদায় করা হয়। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই কেন্দ্রে দায়িত্বপালনকারী এক আনসার সদস্য জানান, ওয়ালী আহমেদ কবিরের পায়ে ধরে জীবন বাঁচান। সূত্র জানায়, ভোট গণনা যতটুকু হয়েছিলো তাতে জহির রায়হান পেয়েছিলো ৪ শ’ ভোট। আর কবির আহমেদ পেয়েছিলো ৮৮ ভোট। এই খবর কবিরের এজেন্ট জানিয়ে দেয়ার পর কেন্দ্রটিতে হামলা চালানো হয়। বীরগাঁও ইউনিয়নে ১০টি কেন্দ্র ছিলো। ফলাফল ঘোষণার সর্বশেষ কেন্দ্র ছিলো এটি। আওয়ামী লীগ প্রার্থী জহির রায়হান জানান, বাইশমৌজা ও দুর্গারামপুর কেন্দ্রেও তারা ব্যাপক ভোট কারচুপি করে। এই দু- কেন্দ্রের ফলাফল পাল্টানো হয়। তারপরও আমি পাস ছিলাম। ৯টি কেন্দ্রের ফলাফল দেখে তারা বুঝে ফেলে চর কেদারখোলার ভোট কমাতে না পারলে কাজ হবে না। এরপরই ফলাফল ঘোষণার বাকি চর কেদারখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় কেন্দ্রে আমার ভোটের অবস্থা দেখে কয়েক শ’ ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী নিয়ে কবির সেখানে হামলা চালায়। যতো ভোট পেলে সে পাস করবে সেভাবে রেজাল্ট বানিয়ে প্রিজাইডিং অফিসারকে অস্ত্র ঠেকিয়ে তাতে সিগনেচার নেয়। তিনি বলেন- ঐ এলাকায় আমার জনপ্রিয়তা ছিলো বেশি। কেন্দ্রের ভোট গণনা শুরু হলে আমার ভোটের হার দেখে সে তার ফেলের ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে যায়। কেন্দ্রের রেজাল্ট নিজের পক্ষে নিতে কবির আর তার সন্ত্রাসীরা প্রিজাইডিং অফিসার ফেরদৌসুর রহমানকে প্রচণ্ড মারধর করে। ফলাফল বদলে প্রিজাইডিং অফিসারকে তাদের সঙ্গে করে উপজেলা সদরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছে না। জহিরের অভিযোগ প্রশাসনও ফেরদৌসুর রহমানকে গায়েব করার সঙ্গে জড়িত। কেন্দ্রটিতে হওয়া অনিয়ম ঢাকতেই তারা এ কাজ করেছে। যাতে অনিয়মের ভোট জায়েজ হয়ে যায়। তিনি বলেন- যতটুকু জেনেছি ফেরদৌসুর রহমান মানুষ দেখলেই এখন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। তাকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে রাখা হচ্ছে। কিন্তু সে কোথায় আছে তা বলে না পরিবারের সদস্যরা। জহির রায়হান দাবি করেন প্রথম ভোট গণনায় এ কেন্দ্রে তিনি পেয়েছিলেন ৮ শ’ ভোট। পরে তার ভোট দেখানো হয় ৪ শ’।