ইউপি নির্বাচনে কোথাও কোথাও উৎসবের ভোট হলেও এবার সহিংসতা বাড়ছে। ব্যালট পেপার ছিনতাই হচ্ছে। এত দিন পশ্চিমবঙ্গে ছাপ্পা ভোটের যে দৃশ্য ছিল সেটি এখানে সিল হয়ে ঠাঁই নিচ্ছে। প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি প্রার্থীরা দু-এক জায়গায় রুখে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেও অধিকাংশ জায়গায় জানের ভয়ে আত্মসমর্পণ করে যাচ্ছেন। কোথাও কোথাও ভোট চলাকালেই বর্জনের ঘোষণা দিচ্ছেন। প্রথম দফা ইউপি ভোটে আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীরা লড়েছিলেন। অনেক জায়গায় জিতেছেনও। গতকাল দ্বিতীয় দফার ভোটে বিদ্রোহী স্বতন্ত্র প্রার্থীরাও রণে ভঙ্গ দিয়ে বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন অনেক জায়গায়।
প্রথম দফায় ভোট হয়েছিল ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ১১ জনের। আহত, বর্জন, ব্যালট ছিনতাই, সিল ভোটের ঘটনা সবার জানা। গতকাল ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছে। ভোটের আগের রাত থেকে এই লেখা তৈরি পর্যন্ত শিশু, হকারসহ ৯ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উৎসবের বাদ্য বাজিয়ে যে ভোট এসেছিল মানুষের জীবনে সেখানে স্বপ্রণোদিত, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, সরকারি দলের উন্নাসিকতা, স্থানীয় প্রশাসনের কারও কারও অতিউৎসাহ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারের দমন-পীড়ন, হটকারী আন্দোলনের পথে গিয়ে জেল-মামলায় অতিশয় দুর্বল আতঙ্কগ্রস্ত বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সরকারি দলের দখলদারির মুখে জয়-পরাজয় বড় নয়, অংশগ্রহণই বড়- এই মনোভাব নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছে। এবারই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রথম দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই অর্ধশতাধিক সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি দেড়শতাধিক জায়গায় প্রার্থীই দিতে পারেনি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হওয়াটা প্রহসন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অতীতে যারা বিজয়ী হতেন তাদের দলীয় পরিচয় থাকলেও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক প্রভাব, আঞ্চলিকতা ভোটযুদ্ধে ফ্যাক্টর হতো। যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তারও একই ধরনের যোগ্যাতা ও শক্তি থাকত। এতে ভোট হতো উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য। বিশাল ভোটযজ্ঞে ছোটখাটো হাঙ্গামা ঘটলেও এবারের মতো অসহিষ্ণু, দৃষ্টিকটু রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্ষমতাসীন দলের উন্নাসিকতার চিত্র অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলও কখনো এতোটা মাথা চাড়া দেয়নি। অতীতে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ আধিপত্যের লড়াই দ্বন্দ্ব-কোন্দল জেলা পর্যন্ত সীমিত ছিল। সর্বোচ্চ বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলায় গড়িয়েছে। এবারের ভোটের মধ্য দিয়ে সেটি গ্রামপর্যায়ে গড়ালো। রাজনৈতিক দলগুলোকে এর পরিণতি আগামী দিনে আরও করুণভাবে যে দেখতেই হবে না, বইতেও হবে তার আলামত দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন তৃণমূল বিস্তৃত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন গ্রাম পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামোতে বিভক্তির রক্তাক্ত যন্ত্রণাদায়ক দগদগে ঘা-এর জন্ম দিলো। অনেক জায়গায় জনপ্রিয় বিদায়ী চেয়ারম্যানরা দলীয় মনোনয়ন পাননি। অনেক জায়গায় জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়ন নিতে পারেননি। দলের কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেয়া হলেও তৃণমূলে বড় ধরনের মনোনয়ন বাণিজ্য ঘটে গেছে আগেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চার-পাঁচজন নেতা এই মনোনয়ন বাণিজ্য ঘটিয়ে অর্থ যার, মনোনয়ন তার- এটি নিশ্চিত করেছেন। কোথাও মনোনয়ন বাণিজ্য, কোথাও বা মন্ত্রী-এমপির আজ্ঞাবহদের মনোনয়ন দিতে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি ঘটেছে ভোটের ময়দানে। ভোটযুদ্ধে দেখা দিয়েছে আধিপত্যের লড়াই, অহম, জেদ, প্রতিহিংসা, শেষ পর্যন্ত সহিংসতা। সরকার যতই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলুক না কেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিঃশর্তভাবে আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপির শাসনামলের শেষ পর্বে আওয়ামী লীগ জোট স্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য যে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল, তাদের জোট ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলেও তার পুরোটা কার্যকর হয়নি। স্বাধীন, শক্তিশালী দূরে থাকুক দিনে দিনে দুর্বল হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এক কোটি জাল ভোট বাতিল করে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করেছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার এ টি এম শামসুল হুদা নির্বাচন কমিশন। সেনাবাহিনী একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও আইডি কার্ড দিয়েছিল। রকিব কমিশন তাদের দিয়েই গঠিত হয়েছে যার বর্তমান সরকারের প্রতি বিভিন্ন সময় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকলে অবসরে যাওয়ার তিন বছর আগে কোনো সরকারি কর্মকর্তা ভোট করতে পারবেন না বলে যে নির্বাচনী বিধিটি করা হয়েছিল সেটিও এখন বর্তমান সরকারের অনুগত সুবিধাভোগী আমলারা বাতিল করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কারণ, তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। তার আগে সরকারি সুযোগ-সুবিধাটুকুও নিঙড়ে ভোগ করতে চান। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে কার্যত সামরিক শাসন কবলিতই করা হয়নি, মানুষের ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সেই দিন গণতন্ত্রের সংগ্রামে অসংখ্য নেতাকর্মীর আত্মদানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই বাতিঘর হয়ে এসেছিল জাতির জীবনে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন সেই আন্দোলনের নেত্রী। তার দল ও জোটের অনেক শরীক ছিলেন সেদিনের রাজপথের সহযোদ্ধা। নব্বইয়ে সেনাশাসক এরশাদ যুগের অবসান ঘটেছিল গণ-অভ্যুত্থানে। গণতন্ত্রের নবযাত্রায় একটি মাগুরার উপনির্বাচন পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুতই করেনি জনগণের জীবনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে মানুষের ফিরে পাওয়া ভোটের অধিকারের ধারা অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে বিচারপতি কে এম হাসানকে ঠেকাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন ও বিএনপির আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে একতরফা নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল ১/১১। সেদিনের রাজনৈতিক সহিংসতার মুখে পতিত ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনের সামনে ১/১১-এর কোনো বিকল্প ছিল না। ১/১১ সরকারকেও নানা হটকারিতা ও ভুলভ্রান্তির পথে বিদায় নিতে হলেও ২০০৮ সালের গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। সেই নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মুছে দেয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় একতরফা ও নানা ঘটনা প্রবাহে দেড় শতাধিক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের কারণে। বিএনপির হটকারী ভোটবর্জন ও সহিংস আন্দোলনের পথ গ্রহণ আওয়ামী লীগকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার সুযোগ করে দেয়। কার্যত দেশে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের জন্য যতখানি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, শাসক ও রাজনৈতিক মহলে ততখানি নয়। বিএনপি কার্যত ঘরোয়া রাজনীতির আবহে মামলা-মোকদ্দমার ভেতরে তাদের পথ অতিক্রম করছে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ রয়েছে। সেখানে ঘরজামাই বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সরকারের গুণকীর্তনে ব্যস্ত। যে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ওই নির্বাচনকে নানা নাটকের ভেতর জায়েজ করার চেষ্টা সেই পার্টির ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীদেরকেও তৃণমূলের আওয়ামী লীগ রেহাই দেয়নি। রাজপথে কার্যকর বিরোধী দল নেই। প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম সর্বত্র এখন সরকারের জন্য অনুকূল হাওয়া। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও সরকারের শরিকরা অবহিত শেখ হাসিনাই একেকটা চ্যালেঞ্জের নিজের ক্যারিশমায় উত্তরণ ঘটিয়েছেন বলেই তারা ক্ষমতার অংশীদার। দেশজুড়ে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ যেমন চলছে তেমন করে মাঠপর্যায়ে নানা জায়গায় শাসক দলের উন্নাসিক নেতাদের আচরণে সাধারণ মানুষই নয় দলের অনেকেও অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। ক্ষমতার পাদপ্রদীপে দাঁড়িয়ে সবাই রাতারাতি আওয়ামী লীগ বনে গেলেও হাইব্রিডদের চেহারাই ভাসছে সর্বত্র। তৃণমূল বিস্তৃত এই সংগঠন তার সাংগঠনিক কাঠামো কতটা শক্তিশালী করেছে সেটি দেখতে হলে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো সুযোগ নেই। যারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা জেনে গেছেন উনিশের আগে সরকার জাতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে না। আগামী নির্বাচনেও হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা মাফিক আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্বশর্ত ভোটাধিকারের যে চিত্র একের পর এক উঠে এসেছে তাতে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক আওয়ামী লীগ চিরকাল তো ক্ষমতায় থাকবে না। তাহলে যখন বিরোধী দলে যাবে তখন তৃণমূল বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামোতে সহিংসতার ক্ষতদাগ আর এসব নির্বাচনের চিত্র নিয়ে রাজনৈতিক ভাষা তখন কী নির্ধারণ করবে। ভারতে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিধিবিধান ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথেই হাঁটতে হচ্ছে। দশ বছরের শাসনামল শেষে বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলটির চরম ভরাডুবি ঘটলেও রাজনীতির পথেই মানুষের মাঝে গিয়েই রাজনীতি করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বর্ণাঢ্য অতীতের বিজয়ের মুকুটপড়া একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে ভবিষ্যতে বিরোধী দলে গেলে কী নিয়ে দাঁড়াবে। শুধু কি পদ্মা সেতু, স্থল সীমান্ত চুক্তি, সমুদ্র বিজয়, ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিপ্লব, ব্যাপক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সন্ত্রাসবাদ দমন? এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উন্নয়নের স্বর্ণযুগের নায়ক হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায়ী সেনাশাসকদের নামও আসে। কিন্তু রাজনীতির গতিপথে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানদের নামই সোনার হরফে লেখা হয়। একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে ৩ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। আওয়ামী লীগের উপলব্ধির সময় সব দল বাদ দিলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এই নির্বাচন কতোটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে; যে নির্বাচনে অবুঝ শিশুকে জীবন দিতে হয়, সরকারি দলকে দুই ভাগ হয়ে রক্তারক্তি করতে হয়। সেখানে প্রশ্ন থেকে যায়, সংসদ যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে পারে, জেলা পরিষদে যদি দলীয় কর্মীদের বছরের পর বছর প্রশাসক পদে রাখা যায়, ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত বিরোধী দলের মেয়রদের যদি বরখাস্ত করা যায়, এই রক্তক্ষয়ী ইউপি নির্বাচনের কী প্রয়োজন ছিল। নির্বাচন কমিশন চাইলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে দিতে পারতেন। এতে সবার মানও বাঁচত, জানও বাঁচত।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম
প্রথম দফায় ভোট হয়েছিল ৭১২টি ইউনিয়ন পরিষদে। প্রাণহানির ঘটনা ঘটেছিল ১১ জনের। আহত, বর্জন, ব্যালট ছিনতাই, সিল ভোটের ঘটনা সবার জানা। গতকাল ৬৩৯টি ইউনিয়ন পরিষদে ভোট হয়েছে। ভোটের আগের রাত থেকে এই লেখা তৈরি পর্যন্ত শিশু, হকারসহ ৯ জনের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। উৎসবের বাদ্য বাজিয়ে যে ভোট এসেছিল মানুষের জীবনে সেখানে স্বপ্রণোদিত, আজ্ঞাবহ নির্বাচন কমিশন, সরকারি দলের উন্নাসিকতা, স্থানীয় প্রশাসনের কারও কারও অতিউৎসাহ এমন পরিস্থিতি তৈরি করেছে। নির্বাচনের শুরু থেকেই সরকারের দমন-পীড়ন, হটকারী আন্দোলনের পথে গিয়ে জেল-মামলায় অতিশয় দুর্বল আতঙ্কগ্রস্ত বিএনপি সাংগঠনিক দুর্বলতা ও সরকারি দলের দখলদারির মুখে জয়-পরাজয় বড় নয়, অংশগ্রহণই বড়- এই মনোভাব নিয়ে ভোটযুদ্ধে নেমেছে। এবারই ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন প্রথম দলীয় প্রতীকে হচ্ছে। নির্বাচনের আগেই অর্ধশতাধিক সরকারদলীয় প্রার্থী বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপি দেড়শতাধিক জায়গায় প্রার্থীই দিতে পারেনি। দলীয় প্রতীকে নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সঙ্গতিপূর্ণ কিন্তু প্রার্থী মনোনয়নে তৃণমূলের মতামত উপেক্ষিত হওয়াটা প্রহসন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে অতীতে যারা বিজয়ী হতেন তাদের দলীয় পরিচয় থাকলেও সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ছিল। ব্যক্তি ইমেজ, পারিবারিক প্রভাব, আঞ্চলিকতা ভোটযুদ্ধে ফ্যাক্টর হতো। যিনি প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতেন তারও একই ধরনের যোগ্যাতা ও শক্তি থাকত। এতে ভোট হতো উৎসবমুখর ও গ্রহণযোগ্য। বিশাল ভোটযজ্ঞে ছোটখাটো হাঙ্গামা ঘটলেও এবারের মতো অসহিষ্ণু, দৃষ্টিকটু রাজনৈতিক সহিংসতা ও ক্ষমতাসীন দলের উন্নাসিকতার চিত্র অতীতে কখনো দেখা যায়নি। ইউনিয়ন পর্যায়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-কোন্দলও কখনো এতোটা মাথা চাড়া দেয়নি। অতীতে রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরীণ আধিপত্যের লড়াই দ্বন্দ্ব-কোন্দল জেলা পর্যন্ত সীমিত ছিল। সর্বোচ্চ বিচ্ছিন্নভাবে উপজেলায় গড়িয়েছে। এবারের ভোটের মধ্য দিয়ে সেটি গ্রামপর্যায়ে গড়ালো। রাজনৈতিক দলগুলোকে এর পরিণতি আগামী দিনে আরও করুণভাবে যে দেখতেই হবে না, বইতেও হবে তার আলামত দেখা যাচ্ছে।
বিশেষ করে ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন তৃণমূল বিস্তৃত রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের জন্য ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন গ্রাম পর্যায়ে সাংগঠনিক কাঠামোতে বিভক্তির রক্তাক্ত যন্ত্রণাদায়ক দগদগে ঘা-এর জন্ম দিলো। অনেক জায়গায় জনপ্রিয় বিদায়ী চেয়ারম্যানরা দলীয় মনোনয়ন পাননি। অনেক জায়গায় জনপ্রিয়, গ্রহণযোগ্য প্রার্থীরা মনোনয়ন নিতে পারেননি। দলের কেন্দ্র থেকে অনুমোদন দেয়া হলেও তৃণমূলে বড় ধরনের মনোনয়ন বাণিজ্য ঘটে গেছে আগেই। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের চার-পাঁচজন নেতা এই মনোনয়ন বাণিজ্য ঘটিয়ে অর্থ যার, মনোনয়ন তার- এটি নিশ্চিত করেছেন। কোথাও মনোনয়ন বাণিজ্য, কোথাও বা মন্ত্রী-এমপির আজ্ঞাবহদের মনোনয়ন দিতে গিয়ে বিদ্রোহী প্রার্থীর ছড়াছড়ি ঘটেছে ভোটের ময়দানে। ভোটযুদ্ধে দেখা দিয়েছে আধিপত্যের লড়াই, অহম, জেদ, প্রতিহিংসা, শেষ পর্যন্ত সহিংসতা। সরকার যতই নির্বাচন কমিশনকে স্বাধীন বলুক না কেন, নির্বাচন কমিশন নিজেই স্বপ্রণোদিত হয়ে নিঃশর্তভাবে আজ্ঞাবহ হয়ে পড়েছে। ২০০৬ সালের অক্টোবরে বিএনপির শাসনামলের শেষ পর্বে আওয়ামী লীগ জোট স্বাধীন শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনের জন্য যে সংস্কার প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল, তাদের জোট ক্ষমতায় দীর্ঘদিন থাকলেও তার পুরোটা কার্যকর হয়নি। স্বাধীন, শক্তিশালী দূরে থাকুক দিনে দিনে দুর্বল হয়েছে নির্বাচন কমিশন। এক কোটি জাল ভোট বাতিল করে ভোটার আইডি কার্ড দিয়ে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচন সম্পন্ন করেছিল সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়কার এ টি এম শামসুল হুদা নির্বাচন কমিশন। সেনাবাহিনী একটি স্বচ্ছ ভোটার তালিকা ও আইডি কার্ড দিয়েছিল। রকিব কমিশন তাদের দিয়েই গঠিত হয়েছে যার বর্তমান সরকারের প্রতি বিভিন্ন সময় আনুগত্যের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। সরকারি সুযোগ-সুবিধা নিয়ে থাকলে অবসরে যাওয়ার তিন বছর আগে কোনো সরকারি কর্মকর্তা ভোট করতে পারবেন না বলে যে নির্বাচনী বিধিটি করা হয়েছিল সেটিও এখন বর্তমান সরকারের অনুগত সুবিধাভোগী আমলারা বাতিল করার জন্য চাপ দিচ্ছেন। কারণ, তারা আগামী জাতীয় নির্বাচনে প্রার্থী হতে চান। তার আগে সরকারি সুযোগ-সুবিধাটুকুও নিঙড়ে ভোগ করতে চান। ১৯৭৫-এর ১৫ই আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে পরিবার-পরিজনসহ নৃশংসভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে বাংলাদেশকে কার্যত সামরিক শাসন কবলিতই করা হয়নি, মানুষের ভোটের অধিকার, গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করা হয়েছিল। সেই দিন গণতন্ত্রের সংগ্রামে অসংখ্য নেতাকর্মীর আত্মদানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগই বাতিঘর হয়ে এসেছিল জাতির জীবনে। আজকের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছিলেন সেই আন্দোলনের নেত্রী। তার দল ও জোটের অনেক শরীক ছিলেন সেদিনের রাজপথের সহযোদ্ধা। নব্বইয়ে সেনাশাসক এরশাদ যুগের অবসান ঘটেছিল গণ-অভ্যুত্থানে। গণতন্ত্রের নবযাত্রায় একটি মাগুরার উপনির্বাচন পরবর্তীকালে খালেদা জিয়া সরকারকে ক্ষমতাচ্যুতই করেনি জনগণের জীবনে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে মানুষের ফিরে পাওয়া ভোটের অধিকারের ধারা অব্যাহত রাখার সুযোগ করে দিয়েছিল। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান পদে বিচারপতি কে এম হাসানকে ঠেকাতে গিয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের আন্দোলন ও বিএনপির আজ্ঞাবহ রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনের তত্ত্বাবধায়ক দিয়ে একতরফা নির্বাচনে তাদের ক্ষমতায় আসার পথ রুদ্ধ করে দিয়েছিল ১/১১। সেদিনের রাজনৈতিক সহিংসতার মুখে পতিত ২২শে জানুয়ারির নির্বাচনের সামনে ১/১১-এর কোনো বিকল্প ছিল না। ১/১১ সরকারকেও নানা হটকারিতা ও ভুলভ্রান্তির পথে বিদায় নিতে হলেও ২০০৮ সালের গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনে গণতন্ত্রের প্রত্যাবর্তন ঘটেছিল। সেই নির্বাচনে নিরংকুশ বিজয় নিয়ে আওয়ামী লীগ জোট সরকার সংবিধান থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা মুছে দেয়। ২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হয় একতরফা ও নানা ঘটনা প্রবাহে দেড় শতাধিক প্রার্থীর বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিজয়ের কারণে। বিএনপির হটকারী ভোটবর্জন ও সহিংস আন্দোলনের পথ গ্রহণ আওয়ামী লীগকে সংবিধানের দোহাই দিয়ে ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করার সুযোগ করে দেয়। কার্যত দেশে গণতন্ত্র, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের জন্য যতখানি আলোচনার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, শাসক ও রাজনৈতিক মহলে ততখানি নয়। বিএনপি কার্যত ঘরোয়া রাজনীতির আবহে মামলা-মোকদ্দমার ভেতরে তাদের পথ অতিক্রম করছে। একটি প্রশ্নবিদ্ধ সংসদ রয়েছে। সেখানে ঘরজামাই বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সরকারের গুণকীর্তনে ব্যস্ত। যে জাতীয় পার্টিকে নিয়ে ওই নির্বাচনকে নানা নাটকের ভেতর জায়েজ করার চেষ্টা সেই পার্টির ইউপি চেয়ারম্যান প্রার্থীদেরকেও তৃণমূলের আওয়ামী লীগ রেহাই দেয়নি। রাজপথে কার্যকর বিরোধী দল নেই। প্রশাসন, সিভিল সোসাইটি, গণমাধ্যম সর্বত্র এখন সরকারের জন্য অনুকূল হাওয়া। আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও সরকারের শরিকরা অবহিত শেখ হাসিনাই একেকটা চ্যালেঞ্জের নিজের ক্যারিশমায় উত্তরণ ঘটিয়েছেন বলেই তারা ক্ষমতার অংশীদার। দেশজুড়ে উন্নয়ন কর্মযজ্ঞ যেমন চলছে তেমন করে মাঠপর্যায়ে নানা জায়গায় শাসক দলের উন্নাসিক নেতাদের আচরণে সাধারণ মানুষই নয় দলের অনেকেও অসন্তুষ্ট হচ্ছেন। ক্ষমতার পাদপ্রদীপে দাঁড়িয়ে সবাই রাতারাতি আওয়ামী লীগ বনে গেলেও হাইব্রিডদের চেহারাই ভাসছে সর্বত্র। তৃণমূল বিস্তৃত এই সংগঠন তার সাংগঠনিক কাঠামো কতটা শক্তিশালী করেছে সেটি দেখতে হলে আওয়ামী লীগকে বিরোধী দলে যাওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করা ছাড়া কোনো সুযোগ নেই। যারা মধ্যবর্তী নির্বাচনের স্বপ্ন দেখেছিলেন তারা জেনে গেছেন উনিশের আগে সরকার জাতীয় নির্বাচনে যাচ্ছে না। আগামী নির্বাচনেও হয়তো আওয়ামী লীগ সরকারের পরিকল্পনা মাফিক আবার ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু জাতীয় নির্বাচন থেকে ইউপি নির্বাচন পর্যন্ত মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের পূর্বশর্ত ভোটাধিকারের যে চিত্র একের পর এক উঠে এসেছে তাতে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক আওয়ামী লীগ চিরকাল তো ক্ষমতায় থাকবে না। তাহলে যখন বিরোধী দলে যাবে তখন তৃণমূল বিস্তৃত সাংগঠনিক কাঠামোতে সহিংসতার ক্ষতদাগ আর এসব নির্বাচনের চিত্র নিয়ে রাজনৈতিক ভাষা তখন কী নির্ধারণ করবে। ভারতে প্রাচীন রাজনৈতিক দল কংগ্রেসকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, বিধিবিধান ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের পথেই হাঁটতে হচ্ছে। দশ বছরের শাসনামল শেষে বিগত লোকসভা নির্বাচনে দলটির চরম ভরাডুবি ঘটলেও রাজনীতির পথেই মানুষের মাঝে গিয়েই রাজনীতি করতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এই দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী, মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী, গণতান্ত্রিক সংগ্রামের বর্ণাঢ্য অতীতের বিজয়ের মুকুটপড়া একটি প্রাচীন রাজনৈতিক দল হিসেবে ভবিষ্যতে বিরোধী দলে গেলে কী নিয়ে দাঁড়াবে। শুধু কি পদ্মা সেতু, স্থল সীমান্ত চুক্তি, সমুদ্র বিজয়, ইন্টারনেট প্রযুক্তি বিপ্লব, ব্যাপক অবকাঠামোর উন্নয়ন ও সন্ত্রাসবাদ দমন? এ দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে উন্নয়নের স্বর্ণযুগের নায়ক হিসেবে গণ-অভ্যুত্থানে বিদায়ী সেনাশাসকদের নামও আসে। কিন্তু রাজনীতির গতিপথে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় পণ্ডিত জওহরলাল নেহেরু, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানদের নামই সোনার হরফে লেখা হয়। একটি ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও বিদ্রোহী প্রার্থীর সংঘর্ষে ৩ জনের প্রাণহানী ঘটেছে। আওয়ামী লীগের উপলব্ধির সময় সব দল বাদ দিলেও আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এই নির্বাচন কতোটা রক্তক্ষরণ ঘটিয়েছে; যে নির্বাচনে অবুঝ শিশুকে জীবন দিতে হয়, সরকারি দলকে দুই ভাগ হয়ে রক্তারক্তি করতে হয়। সেখানে প্রশ্ন থেকে যায়, সংসদ যদি বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে পারে, জেলা পরিষদে যদি দলীয় কর্মীদের বছরের পর বছর প্রশাসক পদে রাখা যায়, ব্যালট বিপ্লবে অভিষিক্ত বিরোধী দলের মেয়রদের যদি বরখাস্ত করা যায়, এই রক্তক্ষয়ী ইউপি নির্বাচনের কী প্রয়োজন ছিল। নির্বাচন কমিশন চাইলেই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান পদে বসিয়ে দিতে পারতেন। এতে সবার মানও বাঁচত, জানও বাঁচত।
লেখক: প্রধান সম্পাদক, পূর্বপশ্চিমবিডি ডটকম