স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর এখন আর বলা যায় না_ আমরা সদ্য-স্বাধীনতাপ্রাপ্ত একটি দেশ; যে, বাংলাদেশ নড়বড়ে পায়ে হাঁটা শিখছে মাত্র; যে, বাংলাদেশ এখনও বিশ্বের জন্য তৈরি হয়নি। কারণ সাড়ে চার দশক যে কোনো দেশের জন্য একটা লম্বা সময়। অনুন্নত থেকে উন্নত অবস্থানে পেঁৗছাতে অনেক দেশের জন্য এতটা সময়ও লাগেনি, যেমন কোরিয়া অথবা মালয়েশিয়ার। তার পরও এ রকম কথা আমরা মাঝে মাঝে শুনি_ বাংলাদেশ যে এখনও একটি শিশুরাষ্ট্র। এ কথাটি বলেন, যারা নানা ক্ষেত্রে এদেশের অনুন্নয়নের একটা অজুহাত খোঁজেন।
তারা যে খুব ভুল বলেন, তা কিন্তু নয়_ কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমাদের আচরণ এখনও পরিপকস্ফ হয়নি। এই সাড়ে চার দশকে আমাদের গণতন্ত্র ওই নড়বড়ে পায়েই চলছে; নানান উগ্রবাদ আমাদের সামাজিক অগ্রযাত্রাকে হামাগুড়ি দিয়ে চলার পর্যায়ে নিয়ে আসার চেষ্টা করছে। আর্থিক ব্যবস্থাপনায় আমরা এখনও শৈশব পেরোইনি। আমাদের সাইবার কার্যক্রম বয়োপ্রাপ্ত হয়নি। আমাদের স্বাস্থ্য ও পুষ্টিসেবা এখনও একটি কিশোরের শক্তিও অর্জন করতে পারেনি।
কিন্তু একথা ঠিক নয় যে, আমরা পঁয়তালি্লশ বছরের শিশু। আমরা এগোচ্ছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা নিজেদের
সামর্থ্যকেও অতিক্রম করেছি। কোনো কোনো ক্ষেত্রে আমরা শুধু হাঁটছি না, আমরা ঊর্ধ্বশ্বাসে ছুটছি। সমস্যাটা হলো, একটি ক্ষেত্রের অর্জন আরেক ক্ষেত্রের অনার্জনের জন্য অনেকটাই মূল্য হারায়। কখনও কখনও একটি ক্ষেত্র বাধা হয়ে দাঁড়ায় অন্যসব ক্ষেত্রের অর্জনের পথে। এটি একটি জটিল সমীকরণ; এই সমীকরণকে বুঝতে-ভাঙতে-নতুন করে সাজাতে হবে। সব ক্ষেত্রেই আমাদের দৌড়াতে হবে, উড়াল দিতে হবে। সেটি মোটেও অসম্ভব নয়, তবে তার আগে এই গতি-রুদ্ধতা, সক্রিয়তা-নির্লিপ্ততা, ইতি-নেতির সমীকরণটা আমাদের বুঝতে হবে।
বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয়, তখনকার কথাটা কল্পনা করুন। ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ আমরা স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলাম; ওই বছর ১৬ ডিসেম্বর সারাদেশে আমরা স্বাধীন পতাকা উড়িয়েছিলাম। মাঝখানের দিনগুলোতে আমরা মানুষের অপূর্ব জাগরণ দেখেছি, সাহস আর সংকল্প দেখেছি, স্থির লক্ষ্যে দৃষ্টি মেলে দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে চলা দেখেছি। এ ছিল হাজার বছরে একবার ঘটা এক জাদুর ঘটনা; এ ছিল আমাদের ইতির খাতায় সর্বশ্রেষ্ঠ প্রাপ্তি। কিন্তু এই সাহস, চেতনা, সংকল্প, আত্মবিশ্বাস আমরা ধরে রাখতে পারিনি।
পাশাপাশি নেতিরও কিছু ছবি ছিল। কিছু লোক পাকিস্তানের পক্ষ নিয়ে নিজেদের মানুষকে খুন করেছে; অপহরণ ও ধর্ষণ করেছে। এই বিশ্বাসঘাতকের দল নিশ্চিহ্ন হয়নি। পঁয়তালি্লশ বছর পরও তারা যেমন আছে, তাদের সমর্থকরাও আছে, তাদের সংখ্যাও বেড়েছে।
১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর যে বাংলাদেশকে আমরা পেয়েছিলাম, তা ছিল রক্তাক্ত, বিধ্বস্ত। বড় বড় অবকাঠামো ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত, কলকারখানা ছিল অকেজো। যোগাযোগ বিপর্যস্ত। তারপরও নতুন উদ্যম নিয়ে আমরা নেমেছিলাম। দেশপ্রেমের মন্ত্র ছিল সবার হৃদয়ে। এ ছিল এক বিশাল ইতির চিত্র। কিন্তু এই ছবিটি দ্রুতই আমরা হারিয়ে ফেললাম। নেতির কিছু চিত্র বড় হয়ে উঠল_ কিছু মানুষের লোভ; রাজনীতিকে ব্যবহার করে লুটতরাজ, ক্ষমতার অপব্যবহার স্বাধীনতার অর্জনকে নিষ্প্রভ করে দিল। ১৯৭৪ সালে যে দুর্ভিক্ষ হলো উত্তরবঙ্গে, তখন জাতি হিসেবে আমাদের সবচেয়ে কুশ্রী চেহারাটা দেখা গেল ইতিহাসের আয়নায়। দুর্ভিক্ষপীড়িত উত্তরবঙ্গের এক লাখের মতো উদ্বাস্তু ঢাকা শহরে এলো আশ্রয় ও খাদ্যের আশায়। এই মানুষই একাত্তরে আমাদের তাদের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল, নিজেরা গোয়ালঘরে ঠাঁই নিয়েও। অথচ ঢাকা শহর তাদের মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দিল।
এর পর আরও বিপর্যয় নামল দেশটার ওপর। পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে তার পরিবারের অধিকাংশ সদস্যসহ হত্যা করা হলো। এর পর আমরা হারালাম গণতন্ত্র, সুশাসন, সংস্কৃতির গতিশীলতা, উদারনৈতিকতা। বাড়ল ধর্ম নিয়ে উগ্রতা, সামাজিক বিভাজন, অসহিষুষ্ণতা।
এর পর আমরা ইতি আর নেতির দ্বন্দ্বে নেতির শক্তি সঞ্চয় দেখলাম। ফলে, এই ২০১৬ সালের ২৬ মার্চে দাঁড়িয়ে আমরা বুঝতে পারি_ কেন সহিংসতা এখন প্রতিদিনের জীবন-যাপনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে, কেন কেউ এখন আর নিরাপদ নয়; কেন গণতন্ত্র রুগ্ণ, প্রশাসন-পুলিশ গরিব এবং দুর্বলের বিপক্ষে দাঁড়ায়, কেন দুর্নীতি সর্বগ্রাসী। ইউনিয়ন কাউন্সিলের নির্বাচন হচ্ছে দেশে, মানুষ মরছে, হাত-পা হারাচ্ছে। এখন সারা দেশে শুধুই বিভাজন_ দলে-দলে; শ্রেণীতে-শ্রেণীতে; শোষকে-শোষিতে।
নেতির এ রকম চিত্র কোরিয়া অথবা মালয়েশিয়ায় থাকলে তারাও থাকত অনুন্নয়নের চক্রে বন্দি।
তবে এত নেতি-বিভ্রান্তি-বিনষ্টতার মাঝেও আমাদের ইতির চিত্রটি পুরোটি ঢেকে যায়নি। এই সাড়ে চার দশকে দেশ জেগেছে। কৃষকরা নীরবে, কষ্ট সয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার থেকে বেশি হারে খাদ্য ফলিয়ে মানুষকে ভুক্ত রেখেছেন; শ্রমিকরা কলকারখানা সচল রেখেছেন; প্রবাসে গিয়ে উপার্জন করে দেশের মাথাটা পানির ওপর রেখেছেন, নারীরা ঘরের চার দেয়াল ছেড়ে কর্মক্ষেত্রে ঢুকেছেন; শিক্ষার বিস্তার বেড়েছে। এখন তরুণরাই মূল শক্তি। অনেক তরুণ উদ্যোক্তা বিশ্ববাজারে নিজেদের পণ্যের একটা জায়গা করে নিয়েছেন। তরুণ পেশাজীবীরা নানা উদ্ভাবনী চিন্তা ও কাজের সমন্বয় ঘটিয়ে অনেক বড় অর্জনের পথে যাচ্ছেন।
মালয়েশিয়া এবং কোরিয়ায় যে কাজগুলো করেছে সরকার; যে-কাজগুলো হয়েছে সরকারের কারণে, বাংলাদেশে সেসব কাজ করেছে মানুষ, সরকার সত্ত্বেও। পদে পদে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে প্রতিষ্ঠান, গোষ্ঠী, দল, ব্যক্তি অথচ মানুষ এসব বাধা অতিক্রম করে এগিয়ে গেছে।
এখন বাংলাদেশ গমগম করে কাজের আওয়াজে। এত যে বাধা, তারপরও। এটি সম্ভব হয়েছে একটি সামাজিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। গত পঁয়তালি্লশ বছরে একটা অলিখিত চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে এই দেশে, এক অলিখিত সামাজিক চুক্তি এবং এটি হচ্ছে ‘সবার ওপরে বাংলাদেশ’। এ জন্য এখন মানুষ ভয়ানকভাবে দল-অন্ধ হলেও দেশের প্রশ্নে এক কাতারে এসে দাঁড়ায়। বিদেশে আবাহনী খেলতে গেলে মোহামেডানের সমর্থকরাও তাদের জেতার জন্য প্রার্থনা করে। এ জন্য গত বছরের শুরুতে তিন মাসের অবরোধ-হরতাল কর্মসূচি ভেস্তে গেল_ যেহেতু মানুষ বুঝেছে এ কর্মসূচি দেশের জন্য ক্ষতিকর। এখন কোনো হরতালে জনসমর্থন মেলে না। কারণ হরতাল দেশবিরোধী।
যদি পাঁচটি ক্ষেত্রে আমরা একমত হতে পারি, সামাজিক চুক্তিটি নবায়ন করতে পারি, আমাদের মেধা ও শ্রম বিনিয়োগ করতে পারি, তাহলে এ দেশের অগ্রযাত্রা কেউ রুখতে পারবে না। এসব হচ্ছে রাজনীতি, শিক্ষা, সামাজিক সম্প্রীতি, সাম্য প্রতিষ্ঠা এবং আইনের শাসন। রাজনীতিকে অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে; শিক্ষাকে সত্যিকার অর্থে সর্বজনীন এবং বিজ্ঞান ও সংস্কৃতিমনস্ক হতে হবে, ভবিষ্যৎমুখী হতে হবে; সামাজিক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা করে ধর্ম-বর্ণ-নৃতত্ত্বগত পার্থক্য ঘুচাতে হবে, সব ক্ষেত্রে চূড়ান্তভাবে অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং উৎসাহব্যঞ্জক একটি সামাজিক ঐকমত্য তৈরি করতে হবে; ধনী-দরিদ্র, শহুরে-গ্রামীণ ইত্যাদি নানা বিভাজন ও বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে একটি উদারনৈতিক ও প্রগতিশীল সমাজ কাঠামো গড়ে তুলতে হবে এবং সব ক্ষেত্রে আইনের কঠোর শাসন আরোপ করতে হবে, যাতে অর্থ-বিত্ত-রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব-প্রতিপত্তি কখনও আইনকে প্রভাবিত না করতে পারে।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বাংলাদেশ দৌড়াচ্ছে, অন্য অনেক ক্ষেত্রে হামাগুড়ি দিচ্ছে। এখন, বিশ্বসভার সম্মানিত সদস্য হিসেবে গৌরবের একটি আসন পাওয়ার জন্য বাংলাদেশকে সব ক্ষেত্রে দৌড়াতে হবে।
পঁয়তালি্লশতম স্বাধীনতা বার্ষিকীতে এই দৌড়ানোর অঙ্গীকারই হোক আমাদের সামাজিক ও জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তি।