বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে নারী

Slider নারী ও শিশু
untitled-1_198146
পথের সব বাধা লঙ্ঘন করে এগিয়ে যাচ্ছে নারী। ‘আপন ভাগ্য জয়’ করার এই সংগ্রামে পুরুষ তাদের সহযাত্রী। নারীর সাফল্যের কীর্তিগাথা সর্বত্র। নারীর ক্ষমতায়ন একদা ছিল বিলাসী স্লোগান। এখন তা আনন্দময় বাস্তবতা। তবে নারীর এই সংগ্রামে চূড়ান্ত বিজয় অর্জনে যে পথ পরিক্রমণ করতে হচ্ছে তা মোটেও কুসুমাস্তীর্ণ নয়”- আজ ‘বিশ্ব নারী দিবস’কে সামনে রেখে এসব মন্তব্য নারী নেত্রীবৃন্দের। শুধু ‘নারী দিবস’ এলেই নারীর সমমর্যাদার স্লোগান তোলা নয়, সারা বছরই নারী আন্দোলন বেগবান রাখতে হবে বলে মনে করেন তারা। বর্তমান সরকারের অগ্রাধিকারের তালিকায় অনেক ওপরেই রয়েছে নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করে সমতার সেতুবন্ধন তৈরি। বৈশ্বিক বিচারে এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় ঈর্ষণীয়।

নারী নেত্রীরা বলছেন, ‘সার্বিক বিচারে নারীর ক্ষমতায়নে অভূতপূর্ব সাফল্য দেখা গেলেও জাতিসংঘের সিডও সনদ অনুযায়ী নারীর প্রতি বৈষম্য এখনও দূর হয়নি। কাটেনি আইনি প্রতিবন্ধকতা।’ অবশ্য গত বছরের নভেম্বরে প্রকাশিত জেনেভাভিত্তিক বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের ‘বিশ্ব লিঙ্গ বৈষম্য প্রতিবেদন ২০১৫’-তে দেখা গেছে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নারী-পুরুষ বৈষম্য কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এবারও শীর্ষস্থান ধরে রেখেছে। পৃথিবীর ১৪৫টি দেশের নারীর অবস্থানসূচক অনুযায়ী প্রণীত তালিকায় অবস্থান করছে ৬৪ নম্বরে। ২০১৪ সালে ১৪২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ৬৮-তে। নানা প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে এগিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি নারীকে যথাযোগ্য মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে প্রথমে সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাতে হবে বলে মনে করেন বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি আয়শা খানম।

প্রত্যন্ত অঞ্চলে নারীর পেশাগত সচলতা দেখা দিলেও সামাজিক অবস্থার এখনও বিশেষ হেরফের হয়নি। সামাজিক অবক্ষয়, ধর্মান্ধতা, অসচেতনতা ও অশিক্ষার কারণেও নারী তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা এবং মজুরি হারের দিক থেকে নারী-পুরুষের বৈষম্যের হার এখনও প্রকট। অধিকাংশ নারীই নিযুক্ত রয়েছেন ঘরের কাজে। যার আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা হয় না। গৃহস্থালি কাজের নারী অবদানের আর্থিক মূল্যায়নের আন্দোলন এখন সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ছে।

ঘরে-বাইরে সহিংসতার শিকার নারী: পুরুষতান্ত্রিক সমাজের নানা পারিবারিক ও সাংস্কৃতিক বাধায় নারী যেমন ঘরের বাইরে পদে পদে নানারকম সামাজিক, অর্থনৈতিক ও পেশাগত বৈষম্য, নিপীড়ন, যৌন হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার, ঠিক তেমনি ঘরের ভেতরও পারিবারিক বঞ্চনা, অবমাননা ও অত্যাচারের শিকার। আইসিডিডিআর,বির এক গবেষণায় দেখা গেছে, শহরের ৫০ শতাংশ ও গ্রামের ৬৫ শতাংশ পুরুষ বিশ্বাস করেন, পরিবারকে রক্ষা করার জন্য নারীদের নির্যাতন সহ্য করা উচিত। পাশাপাশি শহরের ৯৩ ও গ্রামের ৯৮ শতাংশ পুরুষই বিশ্বাস করেন, পুরুষ হতে হলে তাকে কঠোর হতেই হবে। একই ধারণা পোষণ করেন অধিকাংশ নারী।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের তথ্যানুযায়ী, দেশের ৩০-৫০ শতাংশ নারী কোনো না কোনোভাবে পারিবারিক নির্যাতনের শিকার। মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’-এর এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে শতকরা ৪১ দশমিক ৭০ এবং শহরাঞ্চলে শতকরা ৩৯ দশমিক ৭০ শতাংশ নারী স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার।

এ প্রসঙ্গে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি  বলেন, ‘নারী-পুরুষ উভয়ের দিক থেকেই নির্যাতনের বিষয়টিকে স্বীকৃতি দেওয়ার যে প্রবণতা, তা নারী নির্যাতন প্রতিরোধের ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে নানা আইন আছে; কিন্তু শুধু আইনের প্রয়োগে নির্যাতন বন্ধ করা কতটুকু সম্ভব? নারী নির্যাতন বন্ধ করতে হলে সবার আগে প্রয়োজন নারীর শিক্ষা ও অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন। পাশাপাশি প্রয়োজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন।’

মনোরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মেখলা সরকার বলেন, ‘নারী নির্যাতনের ঘটনাকে সামাজিক অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে। যারা ঘটনার সঙ্গে জড়িত তাদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করে শাস্তি দিতে হবে। তবে মহিলা ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি জানান, নারীর প্রতি সহিংসতা বন্ধে সরকার নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে এবং তা বাস্তবায়নও করছে। পূর্বের তুলনায় নারীর প্রতি সহিংসতা কমেছে বলেও দাবি করেন তিনি।।

নারীর কাজ অমূল্যায়িত সেবা খাতে: বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নে বাংলাদেশের অবস্থান এবার দশম স্থান থেকে অষ্টম স্থানে। অর্থনৈতিক কার্যক্রমে বাংলাদেশের নারীর অবস্থান দুই ধাপ পিছিয়ে ১৩০তম অবস্থানে নেমেছে। তবে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষায় নারীর অবস্থানের ক্ষেত্রে গত বছরের মতো এবারও পৃথিবীতে প্রথম অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশ।

দেশের অভ্যন্তরে অর্থনীতির মূল কর্মক্ষেত্রগুলোতে নারীর অবদান ক্রমাগত বাড়ছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক সমীক্ষা অনুসারে, মূলধারার অর্থনীতি হিসেবে স্বীকৃত উৎপাদন খাতের মোট কর্মীর প্রায় অর্ধেকই এখন নারী। উচ্চশিক্ষিত হয়ে বিজ্ঞানী, উদ্যোক্তা, চিকিৎসক, স্থপতি, প্রকৌশলী, শিক্ষক, ব্যাংকার, নির্মাতা থেকে শুরু করে গণমাধ্যমকর্মীদের তালিকায়ও উঠে এসেছে নারী। সংখ্যায় নগণ্য হলেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ নির্বাহী ও উচ্চপদেও দায়িত্ব পালন করছেন তারা। তবে তা সংখ্যায় নগণ্য। নারী কর্মীদের সিংহভাগই শ্রমজীবী।

এই গবেষণায় দেখা যায়, কর্মজীবী নারীদের অর্ধেকের বেশি কৃষিকাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত। কলকারখানায় পুরুষের চেয়ে নারী শ্রমিক বেশি। তবে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে এখনও তারা পিছিয়ে রয়েছেন। কৃষি, শিল্প, সেবা খাতসহ বিভিন্ন আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিক সেক্টরে নারীর অংশগ্রহণ দিন দিন বাড়লেও জাতীয়ভাবে পিছিয়ে পড়ছেন তারা। কায়িক শ্রমে নারীদের অংশ নেওয়ার হার বৃদ্ধি অব্যাহত রয়েছে। বসতবাড়িতে হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল পালন, উৎপাদন, গোয়ালঘর নির্মাণ, পরিষ্কার, এদের খাওয়ানো ও পরিচর্যাসহ গবাদিপশু সম্পদ ব্যবস্থাপনায় নারীদের অংশগ্রহণের হার শতকরা ৪৪ থেকে ৮৫ শতাংশ। যেখানে পুরুষের অংশগ্রহণ ০ থেকে ৫০ শতাংশ মাত্র। এ চিত্র পাওয়া যায় অ্যাকশন এইডের এক গবেষণা থেকে।

ওই গবেষণায় আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশের নারীরা তাদের প্রতিদিনের কাজের অন্তত ৪০ শতাংশ পরিবার ও স্বজনের পেছনে ব্যয় করেন। কিন্তু তারা এ ৪০ শতাংশ কাজের অর্থনৈতিক মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। বিবিএসের এক গবেষণায় দেখা গেছে, কর্মজীবী একজন পুরুষ ২৪ ঘণ্টার মধ্যে অর্থের বিনিময়ে ৬ ঘণ্টা ৫৪ মিনিট কাজ করেন। নারীরা ৫ ঘণ্টা ১২ মিনিট কাজ করেন। জিডিপিতে নারীদের রান্নাবান্না, সন্তান লালন-পালনসহ গৃহস্থালির কাজকর্মের স্বীকৃতি নেই। এই শ্রমের আর্থিক মূল্যমানও নির্ধারণ করা হয় না। ফলে অর্থনীতিতে নারীর এ কাজের অবদান আড়ালেই থাকছে।

দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম: এদিকে কর্মক্ষেত্রে অংশগ্রহণের সঙ্গে নারী দারিদ্র্যের হারও বেড়ে চলেছে। শহরে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ তৈরি হলেও গ্রামে অবস্থার পরিবর্তন ঘটছে না সহজে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর তানিয়া হকের মতে, বাংলাদেশে নারীর দারিদ্র্য দূর করার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতাগুলো হচ্ছে- প্রচলিত পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বিদ্যমান আইন-কানুন, ধর্মীয় মৌলবাদ, আধুনিকায়ন, পরিবেশে বিপর্যয়, দুর্নীতি ইত্যাদি। নারীকে স্বাবলম্বী করতে প্রয়োজন নারীর কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক পথের বাধা দূর, অনুকূল প্রাতিষ্ঠানিক পরিবেশ সৃষ্টি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *