মানুষের চরিত্র কতোই না বিচিত্র? সহজাত প্রবৃত্তিতে থাকা ছয়টি রিপুর তাড়নায় করে থাকে নানান কাজ। একেকটার ক্রিয়া প্রতিক্রিয়ায় জনে জনে পাল্টে যায় চরিত্রের ধরন। বদল হয় স্বভাবের, বিশিষ্টতা পায় ভিন্নভাবে। ঠিক তেমনি ভয়াবহ কিন্তু একই সঙ্গে মজার দুটি মানসিক রোগ আছে- প্যাথলোজিক্যাল জেলাস ও সিজোফ্রেনিয়া।
প্যাথলোজিক্যাল জেলাস, রোগটা কাউকে হিংসা করতে নয়, সন্দেহ বাতিকের স্বভাব বাড়িয়ে দেয়। কোনো ব্যক্তি বা বিষয় নিয়ে সন্দেহ আসতেই পারে। এটা মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। সেই সন্দেহের সূত্র ধরেই অনেক সময় সত্যটা বেরিয়ে আসে। কিন্তু এই সন্দেহকে তখনই রোগ হিসেবে বিবেচনা করা হবে যখন সেটি অযৌক্তিক, অকারণ, অমূলক এবং অন্যকে অতিষ্ঠ করার পর্যায়ে উপনীত হবে। মহানবী (সা:) বলেছেন, ‘সন্দেহ হচ্ছে সবচেয়ে বড় মিথ্যা’। কারণ এটি অনুমানের উপর প্রতিষ্ঠিত। প্রমাণ হলেই সেটি সত্যে পরিণত হয়। সুতরাং তার আগ পর্যন্ত এটি অবশ্যই মিথ্যা। প্যাথলোজিক্যাল জেলাস রোগটা বড়ই অদ্ভুত। কারণ, এটি চিরাচরিত সন্দেহ রোগ থেকে আলাদা এবং পাত্র-পাত্রীও ভিন্ন।
গভীর বা সত্যিকারের ভালোবাসা পাওয়ার সৌভাগ্য ক’জনের হয়! ক্ষেত্রবিশেষে, প্যাথলোজিক্যাল জেলাস রোগটার উৎপত্তি কিন্তু এই গভীর ভালোবাসা থেকেই। এক্ষেত্রে কেউ একজন তার সঙ্গীকে খুব ভালোবাসে। কিন্তু সঙ্গীর কাছ থেকে তার প্রত্যাশা অনুযায়ী ভালোবাসা না পেলে, মনে হতে পারে সঙ্গী তাকে চায়না, অবহেলা করছে। সে অন্য কিছুতে জড়িত। এ থেকে তার মনে সন্দেহ দানা বাঁধতে শুরু করে। ক্রমান্বয়ে এটি মানসিক ব্যাধিতে পরিণত হয়। চোখের আড়াল হলেই মনে হয়- সঙ্গী হয়তো এখন অন্য কারো সঙ্গে অবৈধ মেলামেশা বা শারীরিক সম্পর্ক করছে। সঙ্গী প্রতারণা করছে, তাকে ঠকাচ্ছে। আর এই যে মেলামেশার ব্যাপারটা- সন্দেহ কোনো পারিবারিক বা সামাজিক সম্পর্ক অথবা লিঙ্গভেদ- কোনোকিছুকেই বাদ দেয় না।
তার সন্দেহ এবং অমূলক ধারণা কাজ করে এভাবে- যে তার সঙ্গী তাকে অবহেলা করছে। প্যাথলোজিকাল জেলাস রোগের সম্ভাব্য পরিনতি, আক্রান্ত ব্যক্তি তার সঙ্গীর ক্ষতি করবে। সেটি প্রাণহরণও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে সন্দেহের তীব্র জ্বালা আর মিথ্যা অভিযোগ সইতে না পেরে সঙ্গী নিজেই আত্মহত্যা করতে পারে।
এই রোগটির আরেকটি পরিচিতি আছে- ওথেলো সিনড্রোম। শেক্সপিয়ার রচিত নাটক ওথেলোতে দেখানো হয়েছে, এই রোগে আক্রান্ত ওথেলো তার স্ত্রী ডেসডিমোনাকে খুন করে। ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তির একটা পর্যায়ে গিয়ে হ্যালুসিনেশন ঘটতে থাকে। যার দরূণ, যে ঘটনাটি ঘটেনি বা সঙ্গী উক্ত ব্যাপারে কিছুই জানেনা সেই অলৌকিক ধারণা বা কথিত অপরাধে ব্যধিগ্রস্থ ব্যক্তি তার সঙ্গীর উপর চড়াও হয়। তাকে জেরা করে। তাকে তার অজানা কৃতকর্মের জন্য যেকোনো ভাবে স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। তাকে শারীরিক আঘাত করে। তার অন্ধ বিশ্বাস এবং বদ্ধমূল ধারণা যে তার সঙ্গী অবশ্যই কোনো অবৈধ সম্পর্ক বা পরকীয়ায় জড়িত। হ্যালুসিনেশন (অলীক প্রত্যক্ষণ) ওথেলো সিনড্রোমে প্রভাব বিস্তারকারী হিসেবে কাজ করে। আর এরোগে আক্রান্তরা কখনোই বুঝবে না বা স্বীকার করবে না- সে মানসিকভাবে অসুস্থ। তার এই অসুস্থ আচরণগুলো তার কাছে খুব স্বাভাবিক বলে মনে হবে।
সিজোফ্রেনিয়া আরেকটি জটিল মানসিক রোগ। এ রোগের বিভিন্ন উপসর্গের মধ্যে অন্যতম- আক্রান্তরা কথিত গায়েবি সংবাদ পায়। তারা মনে করে ঐশ্বরিকভাবে তাদের কাছে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা আসে। যেকারণে, এ রোগে আক্রান্তরা খুব ধর্মভীরু হয়ে থাকে। তারা নিজেদেরকে পৃথিবীতে বিধাতার দূত বলে মনে করে। এটিও মনে করে, তারা বিধাতার প্রিয়পাত্র। বিধাতা তাদেরকে বিভিন্ন হুমকি বা অনিষ্ঠ থেকে রক্ষা করে। তারা স্বয়ং বিধাতা হতে বিশেষ সুবিধাপ্রাপ্ত।
আসমানী কিতাব প্রাপ্ত ধর্ম অনুযায়ী পৃথিবীতে মানব জাতির সূচনা থেকে অসংখ্য নবী এসেছেন। এসব ধর্মে বিশ্বাসী মানুষগুলো মনে করে নবী রাসূলরা খোদার কাছ থেকে কখনো সরাসরি বা কখনো ফেরেশতা বা স্বর্গীয় দূতের মাধ্যমে ওহী বা দিক নির্দেশনা প্রাপ্ত হতেন। এই কনসেপ্টটি সিজোফ্রেনিয়া রোগের লক্ষণের সঙ্গে মিলে যায়। কিন্তু নবী রাসূলরা সিজোফ্রেনিয়াতে আক্রান্ত ছিলেন না। কারণ, খোদা প্রেরিত নবী রাসূলগনের জীবন এবং কর্মপদ্ধতির ঐতিহাসিক মজবুত ভিত্তি আছে।
তৎকালীন সময়ে অনেকে নিজেকে নবী রাসূল, খোদার প্রেরিত দূত, এমনকি নিজেকেই খোদা বলে দাবী করেছে। সুতরাং তাদের মধ্যে কেউ হয়তো বা ছিলো সিজোফ্রেনিক রোগী। যদিও ১৮৮৭ সালে জার্মান মনোবিদ এমিল ক্রিপলিন প্রথম এই রোগের সন্ধান পান। ইসলাম ধর্মের প্রবক্তা মহানবী (সা:) হচ্ছেন সর্বশেষ খোদা প্রেরিত রাসূল। পবিত্র কোরআনের বর্ণনা মতে, এরপর থেকে নবী রাসূল আগমনের পথ রূদ্ধ। সুতরাং তৎপরবর্তী সময় হতে বর্তমানেও যদি কেউ গায়েবী হতে দিক নির্দেশনা পায় বা নিজেকে খোদার দূত মনে করে তবে সে নিশ্চয়ই সিজোফ্রেনিয়া নামক জটিল মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত।
আমার পরিচিত একজনের জীবন থেকে নেয়া বাস্তব একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করি। পরস্পরকে ভালোবেসে তারা বিয়ে করেছিলো। ছেলেটির প্রতি মেয়েটির গভীর ভালোবাসা ছিলো। ছেলেটি অত গভীর ভালো না বাসলেও- ভালোবাসা সহানূভুতির কমতি ছিলো না। ন্যুনতম যতটুকু ভালোবাসা থাকলে সারাজীবন হাতে হাত রেখে একছাদের নিচে পার করে দেয়া যায়। ছেলেটি যেহেতু ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত হয়নি তাই মেয়েটির ভালোবাসা ছেলেটির চেয়ে অনেক গভীর বলেই ধরে নেয়া যায়।
পরিবারকে না জানিয়ে তারা বিয়ে করেছিলো। ছেলেটির সম্বল শুধুমাত্র একটি চাকরি। ধীরে ধীরে দেনার পরিমান বাড়তে থাকে। কর্মজীবনের প্রচণ্ড চাপ- তার উপর সে নিজেও পড়াশুনার মধ্যে ছিলো। সবমিলিয়ে ছেলেটির জীবন ক্রমান্বয়ে জটিল হয়ে পড়ে। আর চুড়ান্ত জটিলতার শুরু তখন থেকেই। আমার জানামতে, ছেলেটির অন্য কারো সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক ছিলো না। কিন্তু সম্পূর্ণ একা লড়াই করতে গিয়ে সে দিশেহারা হয়ে পড়ে। সেজন্য স্ত্রীর প্রত্যাশিত ভালোবাসার সবটা হয়তো তার পক্ষে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছিলো না। আর এসব ঘটনায় মেয়েটি আক্রান্ত হয় ওথেলো সিনড্রোম নামক ভয়াবহ রোগে। অন্যের জীবনকে বিষময় করে তুলতে যার অল্প আঁচই যথেষ্ট।
অবশ্য বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার আগেও একটা সময় মেয়েটি মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছিলো। দীর্ঘমেয়াদে সে চিকিৎসাধীন ছিলো। এই অসুস্থতা তার পরবর্তী জীবনেও প্রভাব বিস্তার করতে পারে। মেয়েটির ধারাণা মতে ছেলেটির দৈনন্দিন জীবনের যাপিত একটি দিনের বিবরণ দেয়া যেতে পারে-
সকালে অফিসের উদ্দ্যেশে বের হয়ে বাসস্ট্যান্ড থেকে অন্য কোনো মেয়েকে সঙ্গে নিয়ে যাত্রা শুরু। আবার মধ্যবর্তী কোনো স্থানে ঐ মেয়েটিকে নামিয়ে দিয়ে অফিসের এক মেয়ে কলিগকে নিয়ে একসঙ্গে অফিসে গমন। অফিসে ঐ মেয়েটির সঙ্গে টয়লেটে অথবা অন্য কোনো সুবিধাজনক স্থানে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা। আর অফিস শেষ করে ঐ মেয়েটির বাসায় চলে যাওয়া। সেখানে আবার নিরাপদে নিশ্চিন্তে ঘনিষ্ঠ মেলামেশা। স্ত্রীকে তার ভার্সিটি থেকে আনতে যাওয়ার পথে কোনো হোটেলে পাঁচ-ছয়শ টাকা মূল্যের নারীদের সঙ্গ লাভ। যেদিন হোটেলে না যাওয়া হয়, সেদিন ভার্সিটির আশেপাশে অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে ডেটিং সেরে ফেলা। কোনোদিন ছেলেটি যদি তার স্ত্রীর আগে বাসায় চলে আসে তবে মা-বোনের সঙ্গে অবৈধ সম্পর্ক। রাত্রি বেলা ছেলেটির ঘুমাতে গিয়েও শান্তি নেই- সে নাকি সারারাত ঘুমায়না- গভীর রাতে অগোচরে তার মা-বোনের রুমে চলে যায়। আর বাসায় প্রায়ই স্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অন্য মেয়ে নিয়ে ফুর্তি করা হয়।
ওথেলো সিনড্রোমে আক্রান্ত রোগীর ভয়াবহ মনো দর্শনের ধারণা দিতেই কুরুচিকর এই প্রসঙ্গটি ব্যাখ্যা করতে হলো। মানবমন আসলেই জটিল এবং জীবন অনেকাংশেই নির্মম। মেয়েটি কখনো বলতো, ছেলেটি নাকি রাতে শয়তানের পূজা করে। যেটাকে আমরা ব্ল্যাক ম্যাজিক নামে জানি। আর মেয়েটি খোদার কাছ থেকে, গায়েবী হতে বিভিন্ন দিক নির্দেশনা প্রাপ্ত। খোদা তাকে সর্বদাই প্রটেক্ট করে চলছে। সুতরাং একই ঘরে শুভ আর অশুভ শক্তির মধ্যে লড়াই। বলা চলে, খোদার প্রতিনিধি আর শয়তানের প্রতিনিধি- কে কাকে পরাজিত করবে সেই প্রতিযোগিতা।
যাহোক, এভাবে চলতে থাকলে ছেলেটিও কঠিন কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত হবে। এটা এক প্রকার নিশ্চিত, শুধু সময়ের অপেক্ষা। কোনো পরিবারে যদি কোনো মানসিক রোগী থাকে তবে বলা যায়, সেখান হতে সুখ-শান্তিরও সমূলে বিনাশ। যেমনটা বলা হয়ে থাকে- অভাবের সংসারে ভালোবাসা পেছনের দরজা দিয়ে পালায়। একজন মানসিক রোগে আক্রান্ত ব্যক্তির জন্য পরিবারের অন্য সদস্যদের যে কি নির্মম যাতনা সইতে হয়- তা নরকতুল্য।
বর্তমান যুগে চিকিৎসা বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতি সাধন হয়েছে। কৃত্রিম বিভিন্ন অঙ্গ-প্রতঙ্গ গবেষণাগারে তৈরি এবং তা মানবদেহে সফলভাবে প্রতিস্থাপন করা হচ্ছে। অগ্রগতির এই ধারা দেখে এটা সহজেই অনুমেয় যে, শারীরিক সকল প্রতিবন্ধকতা, রোগ বালাইকে মানুষ অবশ্যই নির্মূল করতে পারবে। মানব শরীরের প্রতিটি কোষ সম্পর্কে জানাশোনা থাকলেও মানবমন সত্যিই রহস্যপূর্ণ ও জটিল। মানবমনের দুর্বোধ্যতা কখনই জয় করা সম্ভব হবেনা। সেজন্য জটিল মানসিক রোগীদের পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠার হার উল্লেখযোগ্য নয়। মানসিক রোগীদের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদী হলেও সম্পূর্ণ আরোগ্য লাভের হার সিন্ধুতে বিন্দুর মতোই। ওথেলো সিনড্রোম, সিজোফ্রেনিয়া রোগের ক্ষেত্রে তা অধিক প্রযোজ্য। শারীরিক অসুস্থতা মানুষের মৃত্যু ঘটায়। মানসিক অসুস্থতা মানুষের মৃত্যুর কারণ না হলেও বেঁচে থাকাটা অনুভূতিহীন বা জড় বস্তুর মতোই। শারীরিকভাবে অসুস্থ একজন শুধু নিজেই কষ্ট অনুভব করে। কিন্তু মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত মানুষ নিজে পীড়ার অনুভব না পেলেও তার চারপাশের মানুষজনের জীবন দুর্বিষহ করে তোলে।
হতাশ হওয়ার মতো যথেষ্ট কারণ থাকলেও আশা রাখতেই হবে। কারণ আশাই জীবনের ধর্ম। মানসিক রোগীর প্রতি দীর্ঘমেয়াদে ধৈর্য্যশীল হওয়ার চেষ্টা এবং সদিচ্ছা রাখতে হবে। তাদের প্রতি অবশ্যই সদয় আচরণ করতে হবে। চিকিৎসার মাধ্যমে যথাসম্ভব তার মনটাকে সুস্থির রাখার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। নিজেকে ভালোবাসা ও সচেতনতা অবশ্যই কাম্য যেন নিজেরাই ভুক্তভোগী না হয়ে যাই।