গত মাসে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের গভর্ন্যান্স ইনোভেশন ইউনিটের সভায় যানজট নিরসনে বিভিন্ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়। সিদ্ধান্ত হয়, এসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করবে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন। এর অংশ হিসেবে আজ বৃহস্পতিবার বৈঠক বসছে দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে। এতে বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের ডাকা হয়েছে। শিগগিরই হবে উত্তর সিটি করপোরেশনের সভা।
যানজট নিরসনে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় আটটি সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এগুলো হলো_ দক্ষিণ সিটি করপোরেশনভুক্ত এলাকায় পাঁচটি বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণের স্থান নির্ধারণ; রাজধানীর সদরঘাট, সচিবালয়, ইংলিশ রোড, ধানমণ্ডি ও শাহবাগে এসব ভবন নির্মাণ করা হবে; অবৈধ পার্কিং বন্ধ করা; বিভিন্ন সড়ক রিকশামুক্ত করা ও পৃথক রিকশা লেন চালু করা; বিভিন্ন মোড়ে বাঁ দিকের লেন নির্দিষ্ট করা; রাস্তার ওপর গড়ে ওঠা অবৈধ বাজার উচ্ছেদ এবং ফুটপাত দখলমুক্ত করা ও ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ফিটনেসবিহীন গাড়ি জব্দ।
এসব সিদ্ধান্তের একটিও নতুন নয়। অতীতেও বহুবার নেওয়া হয়েছে। জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল, ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ), সিটি করপোরেশনের মতো সরকারি সংস্থাগুলো গত চার বছরে অন্তত পাঁচবার সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিল; কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। তবে এবার প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাস্তবায়নের নির্দেশ এসেছে বলে আশাবাদী হচ্ছেন সংশ্লিষ্টরা।
দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র সাঈদ খোকন বলেন, ‘যানজট দিন দিন ভয়াবহ হচ্ছে। তাই যানজট নিরসনে অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে।। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যে নির্দেশনা এসেছে, তা পর্যালোচনা করে দ্রুত বাস্তবায়ন করা হবে। কিন্তু এটি শুধু সিটি করপোরেশনের পক্ষে বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।’ তবে সিটি করপোরেশনও একাধিকবার সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার সিদ্ধান্ত নিয়েও বাস্তবায়ন করতে পারেনি। বাস্তবায়ন করতে পারেনি অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত। গত জুনে একাধিক সংস্থার প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে বৈঠক করে এসব সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে যেসব নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে, তার সবই ছিল সড়ক নিরাপত্তার সর্বোচ্চ সংস্থা সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সুপারিশে। কাউন্সিলের বিশেষজ্ঞ উপকমিটি ২০১২ সালে যানজট নিরসন ও নিরাপদ সড়ক নিশ্চিত করতে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি ৮৬টি সুপারিশ করে।
কাউন্সিল এক মাসের মধ্যে সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার সুপারিশ করেছিল। স্বল্পমেয়াদি সুপারিশের মধ্যে ছিল অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ। যত্রতত্র যাত্রী ওঠানামা বন্ধে রাজধানীতে ২০টি বাস-বে নির্মাণও ছিল স্বল্পমেয়াদি সিদ্ধান্ত। বাস্তবায়নের দায়িত্ব ছিল সিটি করপোরেশনের। তখন এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন হয়নি; বরং গত বছরের ১০ আগস্ট অনুষ্ঠিত ২৩তম সভার কার্যপত্রে বলা হয়, সিটি করপোরেশন জানিয়েছে, বাস-বে নির্মাণের জন্য প্রয়োজনীয় জমি পাওয়া যায়নি। নানা বাস্তবতা ও প্রতিবন্ধকতার কারণে এই সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সদস্য কলামিস্ট সৈয়দ আবুল মকসুদ বলেন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত মানে প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত। এবার আশা করা যায়, বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলো তৎপর হবে। তিনি আরও বলেন, কাউন্সিলের সুপারিশ করা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ ছাড়া আর কোনো ক্ষমতা নেই। বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব যাদের, তারা নাগরিক সমাজকে হয়তো গুরুত্ব দেন না। এ কারণেই পুরনো সিদ্ধান্তগুলোই নতুন করে নিয়ে বাস্তবায়ন করতে হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীকে।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক ও গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. শামসুল হক বলেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে কোনো ঘাটতি নেই। ঘাটতি ছিল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে। সরকারের একটি সংস্থা সুপারিশ করে, বাস্তবায়ন করে অন্য প্রতিষ্ঠান। এ কারণে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কোনো দায়বদ্ধতা নেই।
গত বছরের ৮ জুন দুই মেয়রের উপস্থিতিতে সড়ক দখলমুক্ত করা ও পার্কিং উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত হয়েছিল ডিটিসিএর সভায়। ১৫ জুনের মধ্যে ঢাকার সড়ক ও ফুটপাত দখলমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়েছিল। প্রায় ছয় মাস পর উত্তর সিটি করপোরেশন গাবতলী সড়ক পার্কিংমুক্ত করতে পারলেও অন্যগুলোর বেলায় সিদ্ধান্ত কার্যকর হয়নি। সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের গত দুই সভায়ও একই সিদ্ধান্ত হয়; কিন্তু বাস্তবায়নের হার প্রায় শূন্য।
সুশৃঙ্খল পার্কিং ব্যবস্থা গড়ে তুলতে ২০০৫ সালে অবিভক্ত সিটি করপোরেশন মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে। কিন্তু ১১ বছরেও অবৈধ পার্কিং উচ্ছেদ হয়নি, উল্টো পার্কিংয়ের জন্য নির্ধারিত স্থানে তৈরি হয়েছে মার্কেটসহ বিভিন্ন স্থাপনা। ১৯৯১ সালে বহুতল পার্কিং ভবন নির্মাণে নিউমার্কেট এলাকায় তিন একর জমি সিটি করপোরেশনকে দেয় ভূমি মন্ত্রণালয়। গত ২৫ বছরে সেখানে ভবন নির্মাণ দূরে থাক, দখলেই যেতে পারেনি সিটি করপোরেশন। জমিটি দখল করে গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা।
ফিটনেসবিহীন ও অবৈধ যানবাহন জব্দ করতে গত পাঁচ বছরে চারবার ‘জোরদার’ অভিযান পরিচালনা করেছে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা। কোনোবারই কাঙ্ক্ষিত ফল আসেনি। পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের আন্দোলনের মুখে প্রতিবারই অভিযান শুরুর কয়েক দিন পরই তা স্তিমিত হয়ে গেছে। গত অক্টোবরেও একই ফল হয়েছে। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে পুলিশ ও বিআরটিএ ফিটনেসবিহীন গাড়ি ও ভুয়া ড্রাইভিং লাইসেন্স জব্দে অভিযানে নামে। গত ১৮ অক্টোবর শ্রমিকরা ভ্রাম্যমাণ আদালতের ‘নির্যাতনের প্রতিবাদে’ রাজধানীতে যান চলাচল বন্ধ করে দেন। ‘জোরদার’ অভিযানও বন্ধ হয়ে যায়।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২৫ বছরের পুরনো গাড়ি ধরতে সিটি করপোরেশন, সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সমন্বয়ে কয়েকটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালিত হবে। ডাম্পিংয়ের স্থান নির্ধারণের জন্য এরই মধ্যে জেলা প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করেছে ডিএমপি। পরিকল্পনায় রাজধানীর রাস্তায় অবৈধ রিকশা চলাচল বন্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।
এ বিষয়ে ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া বলেন, পুলিশ সব সময় যানজট নিরসনের চেষ্টা করছে। যানজট নিরসনে যে কোনো সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে তারা সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করবে।