ঢাকা : ‘চুলা অল্প জ্বালিয়ে চায়ের পানি দিছি। ওর আব্বু (মৃত শাহনেওয়াজ) বললো- ঘরে গ্যাসের গন্ধ আসছে, ফ্যানটা ছেড়ে দেই। ফ্যান ছেড়ে সে জানালা খুলে দেয়ার জন্য যাচ্ছিল। জায়ান ওর বাবার কোলে। ফ্যানটা ছেড়ে দেয়ার পরে দাউ দাউ করে আগুন। সেকেন্ডের মধ্যে, এতো আগুন। আসলে ডাইনিং রুমটাই গ্যাস ভরা ছিল। সারলিনের রুম ছিল রান্না ঘরের পাশেই। একটা জানালা সম্ভবত বন্ধ ছিল।’ স্বজনদের কাছে এভাবেই সেদিনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করছিলেন গৃহবধূ সুমাইয়া বেগম (৪০)।
আগুনে তার শরীরের ৯০ শতাংশ পুড়ে গেছে। গত ছয়দিন ধরে তিনি মৃত্যুর সঙ্গে লড়ছেন। এখন চিকিৎসাধীন আছেন মোহাম্মদপুরের সিটি হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। গত শুক্রবার রাজধানীর উত্তরায় তাদের বাসার রান্না ঘরে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে সুমাইয়ার স্বামী ও দুই ছেলে নিহত হয়েছে। তিনদিন প্রায় অচেতন থাকার পর কথা বলতে শুরু করেছেন সুমাইয়া। স্বজনদের কাছে ঘটনার কারণ ও ধরন পুরোটাই বর্ণনা করেছেন তিনি।
বুধবার আইসিইউতে স্বজনদের সুমাইয়ার সঙ্গে কথা বলতে দেয়া হয়নি। তবে এর আগে তার ২৮ মিনিটের কথা মোবাইল ফোনে রেকর্ড করেন স্বজনরা। সেখানে সুমাইয়া বারবার বলেছেন, চুলার আগুনে বা তাদের অসাবধানতায় দুর্ঘটনাটি ঘটেনি। গ্যাসের লাইনের ছিদ্র থাকার কারণে ঘরের ভেতরে গ্যাসেই অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ঘরে গ্যাসের লাইনের সমস্যার কথা মালিককে জানানো হলেও এর কোনো প্রতিকার হয়নি। এদিকে ঘটনার পরে বাংলামেইলের সরেজমিন অনুসন্ধানেও অগ্নিকাণ্ডে মালিকের চরম অবহেলার ঘটনা উঠে আসে। এবার জীবন-মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে থাকা সুমাইয়ার বক্তব্যে তা আবারো প্রমাণ হলো।
স্বজনরা বলছেন, ‘ওরা কী বেঁচে নেই’ বলে বারবার প্রশ্ন করছেন সুমাইয়া। না জানানো হলেও তিনি বুঝতে পেরেছেন তার দুই ছেলে ও স্বামী মারা গেছেন। অন্যদিকে সুমাইয়ার মেঝো ছেলে জারিফ বিন নেওয়াজ এখন আগের চেয়ে অনেকটা ভালো আছে। সিটি হাসপাতালেই চিকিৎসাধীন সে। গত মঙ্গলবার মাকে একবার দেখার পর থেকে বাবা ও ভাইদের দেখতে চাইছে জারিফ।
গত শুক্রবার ভোরে উত্তরার ১৩ নম্বর সেক্টরের ৩ নম্বর রোডের ৮ নম্বর সাততলা ভবনের সপ্তম তলার ফ্ল্যাটে রান্নাঘরের গ্যাস লাাইনের আগুনে প্রকৌশলী শাহিন শাহনেওয়াজের পরিবারের পাঁচজন দগ্ধ হয়। গৃহকর্তা শাহনেওয়াজ ছিলেন আমেরিকান দূতাবাসের মেইনটেন্যান্স ইঞ্জিনিয়ার। শুক্রবারই মারা যায় তার দুই ছেলে সারলিন বিন নেওয়াজ (১৫) এবং জায়ান বিন নেওয়াজ (১৪ মাস)। শনিবার মারা যান শাহনেওয়াজ। চিকিৎসকরা সুমাইয়ারও সুস্থ্য হয়ে ওঠার আশা ছেড়ে দিয়েছেন। তবুও স্বজনরা উন্নত চিকিৎসার আশায় মঙ্গলবার তাকে সিটি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
সুমাইয়ার খালাতো ভাই খিরকিন নেওয়াজ বাংলামেইলকে জানান, সুমাইয়া গত তিনদিন ধরে সব কথা বলেছেন। মঙ্গলবার খিরকিনের বড় ভাই নওশাদ জামান মোবাইল ফোনে সুমাইয়ার বক্তব্য রেকর্ড করেছেন। এরপর খিরকিন সেই বক্তব্য ফেসবুকে আপলোড করেন। পরে তা সামাজিক মাধ্যম ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
খিরকিন নেওয়াজ বলেন, ‘ঘটনার পর আগুনের কারণ নিয়ে নানা কথা বলা হলেও এখন স্পষ্ট যে, ঘরে গ্যাস বা অন্য কেনো দাহ্য পদার্থ থাকার কারণেই আগুন লেগেছে। চুলার সমস্যা লিকেজ হলে জানালা ও ভেন্টিলেটারের ফাঁকা দিয়ে সামান্য গ্যাস চলে যেতো। দুর্ঘটনা ঘটলে চুলা জ্বালানোর সঙ্গে সঙ্গেই ঘটত। চুলা জ্বালানোর পর, ফ্যান চালিয়ে হাঁটাচলা করার পর আগুন ধরতো না। এ ঘটনায় তদন্ত হলে দেখা যেতো মালিকের কতোটা অবহেলা ছিল।’
সুমাইয়া তার বর্ণনায় বলেন, ‘বাসায় গ্যাসের পাওয়ার কম ছিল। তিনদিন বাইরে থেকে খাবার কিনে খাই। সমস্যা জানানোর পর মিস্ত্রি এসে পাওয়ারফুল রাইজার লাগিয়ে দিয়ে যায়। এরপরও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পেতাম। গ্যাসের পাইপে লিক ছিল। ঘটনার আগের দিন রাতেও বাসায় গ্যাসের গন্ধ পাওয়া গেছে। ওর বাবা (শাহনেওয়াজ) মোমবাতি জালিয়ে পরীক্ষা করে দেখে। বলে- ছাদে গ্যাসচালিত গিজারের ট্যাংক আছে, গন্ধ সেখান থেকে আসতে পারে। আমরা তো রান্নার সময় ছাড়া চুলা সবসময় বন্ধ রাখি।’
‘ঘটনার দিন সকালে নামাজ পড়ে চা বানানোর জন্য চুলায় পানি দেই। ওর বাবার সকাল পৌনে ৭টায় বাসা থেকে বের হওয়ার কথা ছিল। রান্নাঘরের জানালা খোলা। সকালে রান্নার সময়ও ঘরে গ্যাসের গন্ধ। জারিফের বাবা বলছে গ্যাসের গন্ধ, ফ্যান ছেড়ে দিই। ফ্যান ছাড়ার পর চুলার কাছে যাই। এরপরই সেকেন্ডের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে পড়লো।’
অগ্নিকাণ্ডের পর প্রতিকবেশীদের সহযোগিতা চেয়েও পাননি সুমাইয়া ও তার পরিবার। এই দুঃসহ পরিস্থিতির বর্ণনা দিয়ে সুমাইয়া বলেন, ‘ওর বাবার কোলে পিচ্চিটা। সাততলা থেকে দৌড়ে নামছি আর চিৎকার করছি। প্রথমে চারতলা ও পরে তিনতলায় ফ্ল্যাটের দরজায় কড়া নাড়লাম। ওরা দরজা খুলল। আমাগো দেইখ্যা দরজাগুলো সঙ্গে সঙ্গে বন্ধ করে দিল। সব স্পষ্ট মনে আছে। বিল্ডিংয়ের নিচে নামলাম। দেখলাম কতো মানুষ। কেউ এগিয়ে আসলো না। সবাই তাকাইয়্যা রইল। পুরা কাপড় তো পুইড়্যা গেল। একটা চটের বস্তা দিয়া শরীরটা জড়াই। আল্লাহ মাফ করুন। মানুষ কত অমানবিক। বিল্ডিংয়ের মহিলারা একটা চাদরও আগাইয়্যা দিল না। বললাম আমি মহিলা; অন্তত একটা চাদর দেন। কিচ্ছু দিল না। নইলে ওদের একটা চাদর বা তোষকই পুড়ত। আমার বাচ্চারা তো বাঁচতো।’
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, সুমাইয়াদের বাসায় দুই শোবার ঘর। রান্না ঘরের সঙ্গে একটি ছোট বসার ঘর, যেখানে একটি ছোট খাট ছিল। ওই রুমের ফ্যান চালানোর কথাই বলেছেন সুমাইয়া। মূলত রান্না ঘরের চেয়ে বেশি পুড়েছে এই ঘরটি। সুমাইয়া ও নিহত শাহনেওয়াজের বর্ণনা অনুযায়ী, গোলার মতো আগুন তাদের ধাক্কা মেরে বসার ঘরের দিকে নিয়ে আসে। তখনই বিস্ফেরণ ঘটে। পুরো ঘর অন্ধকার হয়ে যায়।
এতে স্বজনরা ধারণা করছেন, ছিদ্র দিয়ে বের হওয়া গ্যাস বসার ঘরে জমাট বেঁধে ছিল। রান্না ঘরের জানালা খোলার কারণে সেখানে চুলা জ্বালালেও তাৎক্ষণিক বিস্ফোরণ ঘটেনি।
এদিকে অগ্নিকাণ্ডে একটি পরিবার বিপন্ন হওয়ার ঘটনায় বাড়ির মালিক দেলোয়ার হোসেনের অবহেলার অভিযোগ উঠলেও তার বিরুদ্ধে আইনগত কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। শাহনেওয়াজের স্বজনরা একটি অপমৃত্যু মামলা করেছেন। ব্যবস্থা নেয়নি পুলিশও।
জানতে চাইলে উত্তরা-পশ্চিম থানার ওসি আলী হোসেন বাংলামেইলকে বলেন, ‘কেউ কোনো অভিযোগ করেনি। কেন দুর্ঘটনা হয়েছে তা উদ্ঘাটনে আমরা আলামত পরীক্ষা করে দেখেছি। সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার মতামত চেয়ে চিঠিও পাঠানো হয়েছে।’ একমাত্র আশঙ্কামুক্ত জারিফ হাসপাতালের বিছানায়
সিটি হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায়, হাতে-পায়ে সাদা ব্যান্ডেজে মোড়ানো জারিফ আধশোয়া অবস্থায় হাসপাতালের বিছানায়। চেয়ে আছে অপলক দৃষ্টিতে। চোখে-মুখে ক্লান্তির ছাপ। সাদা চাদরে তাকে ঢেকে রাখা হয়েছে। সে বারবার বলছে, ‘আমার বাবাকে এনে দাও। বড় ভাইকেও ডাক। তাদের সঙ্গে কথা বলবো। বাবুটাকে (ছোট ভাই) আমার কোলে দাও। আমি ওর সঙ্গে খেলবো। বাসার ড্রয়ার থেকে খেলনা এনে দাও।’
ডা. শহীদুল্লাহ বারীর তত্ত্বাবধানে জারিফের চিকিৎসা চলছে। আশঙ্কামুক্ত হলেও পুরোপুরি সেরে উঠতে জারিফের অন্তত দুই সপ্তাহ লাগবে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা।
চাচতো বোন মিথিলা জামান পান্থী হাসপাতালে জারিফের দেখাশোনা করছেন। তিনি বলেন, ‘ও (জারিফ) অনেক প্রশ্ন করছে। সব প্রশ্নের উত্তর দিতে পারছি না। কীভাবে দেবো? তার বাবা-ভাই বেঁচে নেই, কীভাবে তাকে বলি যখন তার নিজের অবস্থাও শোচনীয়? এখন জারিফকে ভালো রাখাই আমাদের বড় কাজ।’
পান্থী জানান, মঙ্গলবার একবার জারিফের সঙ্গে তার মায়ের দেখা হয়েছে। তবে বুধবার স্বজনদের আইসিইউতে ঢুকে সুমাইয়ার সঙ্গে দেখা করতে দেয়া হয়নি। কারণ তাকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।