বাড়ছে শিশু হত্যা, গুরুত্ব নেই পুলিশের কাছে!

Slider নারী ও শিশু

 

 

2016_03_02_04_05_44_nr4Akz5bTzhzaBkaMvDEeLFvUD5y31_original

 

 

 

 

ঢাকা : চার বছরে সারাদেশে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যা, এক হাজার শিশু ধর্ষণ এবং প্রায় পাঁচশ শিশু অপহরণের শিকার হয়েছে। গত বছর ২৯২ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। চলতি বছরের দুই মাসে ৪৯ শিশুকে হত্যা করা হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থ্যাগুলোর সূত্রে মিলেছে এই তথ্য।

সর্বশেষ গত সোমবার রাজধানীর বনশ্রীতে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের ইস্কাটন শাখার সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইশরাত জাহান অরনি (১৪) ও তার  ছোট ভাই হলি ক্রিসেন্ট স্কুলের নাসারি শ্রেণির শিক্ষার্থী আলভি আমানের (৬) রহস্যজনক মৃত্যু হয়। স্বজনরা দাবি করে, দুই শিশু রেস্টেুরেন্টের খাবার খেয়ে অসুস্থ্য হয়ে মারা গেছে। তবে ময়নাতদন্তে দুজনকেই শ্বাসরোধে হত্যার আলামত পাওয়া গেছে। শিক্ষকসহ ঘনিষ্ঠ আটজনকে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিশ।

এর আগে গত শনিবার কুমিল্লা শহরের রসুলপুরে মেহিদী হাসান জয় (৮) ও মেজবাউল হক মনি (৬) নামে দুই শিশু খুন হয়। মঙ্গলবার রাজধানীর শান্তিনগর থেকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে দুই শিশুর সৎ ভাই আল শফিউল ইসলাম ছোটনকে (২২)। সে জিজ্ঞাসাবাদে, দুজনকে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেছে।

সমাজবিজ্ঞানী, মানবাধিকার কর্মী ও অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, বড় ধরনের ঘটনা ঘটলে তোলপাড় হলেও দেশে শিশুদের সুরক্ষায় কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। সভ্যতার বিকাশের আগে অপেক্ষাকৃত দুর্বল শিশু ও নারীদের আক্রমণ করতো সবল, পুরুষরা। আকাশ সংস্কৃতি এবং আনলাইন প্রযুক্তির নেতিবাচক প্রভাব; মাদকের প্রভাব এবং বিচারহীনতার কারণে সেই ‘বিকৃত আচরণ’ বারবার ফিরে আসছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, শিশুদের নিয়ে যারা কাজ করেন সেসব মানবাধিকার সংগঠন এবং পুলিশ-প্রশাসনও শিশুদের সুরক্ষিত রাখতে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারছে না। নির্যাতনের তথ্য সংগ্রহ এবং সভা-সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ এনজিও’র কাজ। শিশুদের সহায়তা দিতে প্রতিটি থানায় ‘শিশু ডেস্ক’ চালু করার কথা থাকলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি এখনো।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নির্মম আচরণ থেকে শিশুদের রক্ষা করতে হলে বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। শিক্ষার্থী, অভিভাবকসহ বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে কাউন্সিলিং করতে হবে।

সম্প্রতি গত ১৭ ফেব্রয়ারি হবিগঞ্জের বাহুবলের ভাদেশ্বর ইউনিয়নে মাটি খুঁড়ে চার শিশুর লাশ উদ্ধারের ঘটনায় তোলপাড় হয়েছে। ঘটনার চারদিন আগে থেকে জাকারিয়া আহমেদ শুভ (৮), তাজেল মিয়া (১০), মনির মিয়া (৭) এবং ইসমাঈল হোসেন (১০) নামে ওই চার শিশু নিখোঁজ ছিল।

পুলিশসহ সংশ্লিষ্টরা বলছে, বড়দের পূর্ব শত্রুতার জের ধরে এই শিশুদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। এর আগে গত বছর সিলেটে রাজন, খুলনায় রাকিব, বরগুনায় রবিউল ও ঢাকায় নাজিমসহ কয়েক শিশু হত্যার ঘটনায়ও ব্যাপক তোলপাড় হয়।

বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম (বিএসএএফ)-এর তথ্য অনুযায়ী, গত চার বছরে এক হাজার ৮৫ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২ শিশু, ২০১৪ সালে ৩৫০; ২০১৩ সালে ২১৮ এবং ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। চার বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৯৭৬ শিশু। গত বছর ধর্ষণের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। এ বছর ৫২১ শিশুকে ধর্ষণ করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯১ শিশু গণধর্ষণের শিকার হয়। ২০১৪ সালে ধর্ষণের শিকার হয় ১৯৯ শিশু; ২০১৩ সালে ১৭০ এবং ২০১২ সালে ৮৬ শিশু ধর্ষণের শিকার হয়।

বিএসএফ’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর ৪০ শিশুকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। এ বছর মোট অপহরণের শিকার হয় ২৪৩ শিশু। এর মধ্যে ১৬৭ শিশুকে উদ্ধার করা হয়েছে। ২০১৪ সালে অপহৃত হয় ১১৮ শিশু, যার মধ্যে ৫০ শিশুকেই মেরে ফেলা হয়। ৬৬ শিশুকে অপহরণের পর উদ্ধার করা হয়। ২০১৩ সালে ৪২ শিশু অপহরণের শিকার হয়, যার মধ্যে মেরে ফেলা হয় ১৩ জনকে। এর আগে ২০১২ সালে ৬৭ শিশু অপহৃত হয়েছিল।

ঘটনাগুলো পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, পারিবারিক কলহ, যৌতুক, অনৈতিক সম্পর্ক, মুক্তিপণ না পাওয়া, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদকাসক্তির কারণেই বেশি শিশু হত্যা হয়েছে। গত বছর ৪৩ শিশু তার মা, বাবা বা কোনো আত্মীয়ের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪ সালেও এভাবে খুন হয় ১৫ শিশু। বিএসএএফ’র তথ্য অনুযায়ী, জানুয়ারি মাসে ২৯ শিশু খুন হয়েছে। ফেব্রয়ারিতে ২০ শিশুকে হত্যা করা হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান ড. জিয়া রহমান বাংলামেইলকে বলেন, ‘শিশু নির্যাতন ও হত্যার ঘটনা হঠাৎ করে বেড়েছে এমনটি নয়, এগুলো ঘটেই চলেছে। লোভ-লালসা, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পরকীয়াসহ নানা কারণে শিশুদের হত্যা করা হচ্ছে। এখন মূলত গণমাধ্যমের কল্যাণে এসব ঘটনা দ্রুত জানা যাচ্ছে। আলোচনায় আসছে। তবে প্রতিকার হচ্ছে না।’

তিনি বলেন, ‘সমস্যা সমাধানে ব্যাপক সামাজিক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে, যেটি আসলে নেই। আইনের কঠোর প্রয়োগের পাশাপাশি জনসচেতনতা দরকার। শিক্ষার্থীদের জন্য কাউন্সেলিং চালু করতে হবে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান অনুষদের অধ্যাপক জিনাত হুদা  বলেন, ‘সভ্যতার বিকাশ ঘটলেও অনেক স্থানে শিশুদের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হয়নি। এখনো শিশু ও নারীরা দুর্বল ভেবে তাদের বেশি নির্যাতন করা হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতার কারণে মানসিক অস্থিতরতা বাড়ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘পরিবারে বা বাইরে শিশুদের রক্ষার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ কম। এ জন্য টিভি ও অনলাইনের কিছু নিয়ন্ত্রণ আনা দরকার। পাশাপাশি সচেতনতার জন্য কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।’

অধ্যাপক জিনাত হুদার সঙ্গে অনেকটা মিল রেখে কথা বলেছেন বিএসএএফ’র চেয়ারম্যান এমরানুল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘এখনো শিশুরা দুর্বল বলে তাদের ওপর আঘাত করা হয়। শিশু নির্যাতন সামাজিক ব্যাধিতে পরিণত হচ্ছে। শিশু নির্যাতন বন্ধে ২০১৩ সালে শিশু অধিকার আইন করা হলেও এখনো বিধি করা হয়নি। অনেক ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কার্যকর ভূমিকা পালন করে না।’

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত ১৭ ফেব্রয়ারি বাহুবলের চার শিশু নিখোঁজ হওয়ার পর শিশু শুভর বাবা ওয়াহিদ মিয়া বাহুবল মডেল থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন। তবে নিখোঁজ শিশুদের উদ্ধারে তেমন কোনো পদক্ষেপই নিতে পারেনি প্রশাসন। লাশ উদ্ধারের পর খুনিদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা ঘোষণা করেছে পুলিশ।

গত দেড় মাসে কেরানীগঞ্জের শিশু আব্দুল্লাহ, দিনাজপুরের মিমি; সিলেটের সালমান; যশোরের লিমা খাতুন; রহিমুল ইসলাম রওনক; ধামরাইয়ের চৌহাট এলাকার শাকিল এবং ইমরান হোসেনকে অপহরণের পর হত্যা করা হয়। রাজশাহীর পবায় গত ১৭ ফেব্রয়ারি মোবাইল ফোন চুরির অভিযাগে জাহিদ ও ইমন নামে দুই শিশুকে বেঁধে নির্মমভাবে নির্যাতন চালানো হয়।

গত ৩ জানুয়ারি ঝিনাইদহের শৈলকুপায় পারিবারিক কলহের জের ধরে ইকবাল হোসেন নামের এক ব্যক্তি নিজের ভাই ও বোনের তিন সন্তান শিবলু, আমিন ও মাহিনকে পুড়িয়ে হত্যা করে। ৫ জানুয়ারি এক দিনেই দেশে ছয় শিশুকে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে গাজীপুরের টঙ্গীতে চোর সন্দেহে মোজাম্মেলক হককে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। ঢাকায় রানা নামের এক শিশুকে বিষ খাইয়ে হত্যা করেন তার সৎবাবা। আর চট্টগ্রামে ছুরিকাঘাতে নিহত হয় আজিম হোসেন। নিখোঁজের এক মাস পর গাজীপুরে ৯ জানুয়ারি রাব্বি হোসেন নামের তিন বছরের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করা হয়।

 
প্রতীকী শিশু হত্যা, মূল ছবি- রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে খেলাঘরের শিশুদের বিশেষ আয়োজন

একইভাবে নিখোঁজের পর কুমিল্লার তাহমিনা ও মনিকা, গাইবান্ধার মশিউর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার লায়লা হোসেন ও তাসলিমা বেগম, নাটোরের খানজাহান ও নরসিংদীর তাপস বিশ্বাসের লাশ উদ্ধার করা হয়। গত ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জের ২ নম্বর বাবুরাইলে পাঁচজনকে হত্যা করা হয়। তাদের মধ্যে শান্ত ও সুমাইয়া নামে দুই শিশুও ছিল। ১৯ জানুয়ারি কক্সবাজারের রামুর বড়বিল গ্রামে ফলের বাগান থেকে মোহাম্মদ শাকিল ও মোহাম্মদ কাজল নামে দুই সহোদরের লাশ উদ্ধার করে পুলিশ। ৩০ জানুয়ারি মুন্সীগঞ্জ মালির পাথর এলাকার পরিত্যক্ত ঘর থেকে নীরব নামের এক শিশুর লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

পুলিশের শিশু ডেস্ক কাগজে-কলমেই : 
শিশু হত্যা, নির্যাতন প্রতিরোধ ও শিশুদের আইনি সেবা দিতে গত বছরের আগস্টে দেশের প্রতিটি থানায় শিশুবিষয়ক ডেস্ক স্থাপনের নির্দেশনা দিয়েছিল পুলিশ সদর দপ্তর। এতে শিশুদের অভিযোগ তদন্তে আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথাও বলা ছিল। এর আগে শিশু আইন ২০১৩’তে প্রত্যেক থানায় শিশু ডেস্ক ও আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হয়। তবে ওই আইন পাসের দুই বছর এবং পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনার ছয় মাস পার হলেও থানাগুলো তা বাস্তবায়ন করতে পারেনি।

রাজধানীর কয়েকটি থানায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সেখানে শিশুদের জন্য আলাদা পুলিশ কর্মকর্তা নিয়োগ ও শিশু ডেস্ক স্থাপন করা হয়নি। কয়েকটি থানায় সার্ভিস ডেলিভারি বা অন্য ডেস্কের সঙ্গে শিশু ডেস্ক স্থাপন এবং সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। অথচ শিশু আইনে শিশুদের জন্য আলাদা ডেস্ক স্থাপনের কথা স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।

সম্প্রতি ওয়ার্ল্ডভিশন ও সেন্টার ফর সার্ভিস অ্যান্ড ইনফরমেশন অন ডিজঅ্যাবিলিটি নামে দুটি বেসরকারি সংস্থা ঢাকার ১৩টি ওয়ার্ড এবং ৩৪টি জেলায় অবস্থিত থানাগুলোতে অনুসন্ধান চালিয়ে শুধু ঢাকায় সাতটি থানায় শিশু ডেস্ক থাকার কথা জানতে পেরেছে। তবে কোথাও আলাদা শিশুবিষয়ক পুলিশ কর্মকর্তা পাওয়া যায়নি।

ওয়ার্ল্ডভিশনের ন্যাশনাল অ্যাডভোকেসি কো-অর্ডিনেটর (শিশু সুরক্ষা ও শিক্ষা) সাবিরা সুলতানা বাংলামেইলকে বলেন, ‘বেশিরভাগ থানা থেকে শিশু ডেস্ক এবং আলাদা কর্মকর্তা থাকার বিষয়টি দাবি করা হলেও দৃশ্যত তারা তা দেখতে পারেননি। কয়েকটি থানায় ডেস্ক ও শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা নিয়োগের কথা বলা হলেও তাদের দৈনন্দিন অন্য পুলিশি কাজ থাকায় নিজেদের ডেস্কে সময় দিতে পারেন না।’

জানতে চাইলে রাজধানীর বাড্ডা থানার ওসি আবদুল জলিল জানান, তাদের অফিসার কম থাকায় শিশুদের জন্য আলাদা কর্মকর্তা নিয়োগ দেয়া সম্ভব হয়নি। তবে অন্য দায়িত্বের সঙ্গে একজন নারী কর্মকর্তা এ ডেস্কের দায়িত্বে রয়েছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *