ঢাকা : ‘আফিসারদের কেন হত্যা করা হলো? কেন সেটা জনতে পারবো না? এভাবে মানুষ মানুষকে মারতে পারে না। কেন মারলো আজও বুঝতে পারছি না।’ বুধবার বিকেলে কান্না জড়িত কণ্ঠে জাতীয় প্রেসক্লাবের ভিআপি লাউঞ্জে এভাবেই বলছিলেন বিডিআর বিদ্রোহের ঘটনায় নিহত লেফটেন্যান্ট কর্নেল ইনশাদ ইবনে আমিনের স্ত্রী ড. রোয়েনা মতিন। ‘পিলখানা শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভায়’ কথা বলছিলেন তিনি। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল। উপস্থিত ছিলেন পিলখানায় নিহত সেনা পরিবারের সদস্যরা।
আলোচনা সভা চলাকালে তাদের কয়েকজনকে কাঁদতে দেখা যায়। কেউ কেউ হৃদয় স্পর্শ করা বক্তব্য রাখেন। আলোচনা সভা শেষে শহীদদের স্মরণে প্রেসক্লাবের সামনে অলোর মিছিল করা হয়।
সুলতানা কামাল শহীদ পরিবারের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘এই ক্ষত কোনোদিন শুকাবে না। তিনটি তদন্ত কমিটি হয়েছে কিন্ত তথ্য জানা যায়নি। আমরা তদন্ত করতে পারিনা নাকি প্রকাশ করতে চাই না। এটা তাদের প্রশ্ন থেকে যায়।’
নিহত কর্নেল কুদরত এলাহীর বাবা হাবিবুর রহমান বলেন, ‘পৃথিবীর কোথাও এতো বড় সেনা হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেনি। কী অপরাধ ছিল তাদের? কেন তাদের হত্যা করা হলো? কারা পরিকল্পনাকারী? ৮৪৬ জন আসামির বিরুদ্ধে প্রায় সাড়ে ৪ বছর পর রায় ঘোষণা করা হলো। ১৫২ জনের ফাঁসি হলো। খালাস পেলেন ২৭৭ জন। এটা আপিলযোগ্য। আমার জীবদ্দশায়তো নয়ই তার স্ত্রী সন্তানরাও এই বিচার দেখে যেতে পারবে কি না সন্দেহ আছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘যে স্ত্রী তার স্বামী হারিয়েছে, যে সন্তান তার বাবা হারিয়েছে, যে পিতা তার সন্তান হারিয়েছে তারা বুঝে কষ্টটা কতো।’
কর্নেল মুজিবুল হকের স্ত্রী নেহরীন ফেরদৌসি বলেন, ‘যেখানেই যাই মানুষ একটি কথা বলে। আমারা সরকারের কাছ থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। ৩২ বছর আমার স্বামী সেনা বাহিনীতে চাকরি করেছে। যখন হিলটেক্সে গেলাম আমাকে সে বলছিল এখানে আমার ঘাম রয়েছে। তার আয়ের প্রত্যেকটি পয়সা সেই পরিশ্রমের।’
ব্যাংকার্স অ্যাসোসিয়েশনকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, ‘প্রতিমাসে তারা ৪০ হাজার করে টাকা দেয়। দুবছর আমার পরিবারের বাজার হয়েছে এই ৪০ হাজার টাকায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘কেউ আমাদের জিজ্ঞেস করে না কেমন আছো? সন্তানরা কেমন আছে? শহীদ পরিবারের সন্তানদের খবর রাখে না কেউ। এই ঘটনার পর ট্রমা থেকে উঠতে ৩-৪ বছর লেগেছে। সন্তানদের ট্রমা এখনো কাটেনি। নিজেরা নিজেরা কাউন্সেলিং করেছি। কেউ পাশে আসেনি। আমরা কারো সহানভূতি চাই না। দিবসটিকে বিশেষ দিবস ঘোষণা করা হোক। একটি শহীদ মিনার তৈরি করা হোক।’
মেজর মোহাম্মদ সালেহের স্ত্রী নাসরিন আহমেদ বলেন, ‘বিচার পুরোপুরি জানতে চাই। এতো বড় ঘটনার পেছনে কারা ছিলেন, উদ্দেশ্য কি ছিল জানতে চাই। সন্তানরা জানতে চায়।’
মেজর মাহবুবুর রহমানের স্ত্রী রিটা রহমান বলেন, ‘২৫ ফেব্রুয়ারি শহীদ সেনা দিবস হিসেবে ঘোষণা করা হোক। যা হলো মেনে নিলাম। কিন্তু জানতে চাই যাদের পোস্টিং এখানে ছিল না তাকে কেন ডেকে আনা হলো। সেটাতো জানতে পারছি না।’
কর্নেল কুদরত এলাহীর ছেলে সাকিব রহমান বলেন, ‘জুডিশিয়াল ইনকোয়ারি করে পেছনের লোকদের বের করা হোক। তা পাবলিকলি প্রচার করা হোক।’
এছাড়া অবসরপ্রাপ্ত মেজর হায়দার ও ক্যাপ্টেন আরিফ বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, এটি ‘বিডিআর বিদ্রোহ নয়। হত্যাকাণ্ড।’
আজ সাত বছর :
২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি এই দিনে পিলখানা বিদ্রোহে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয়। বিজিবি সদর দপ্তর জানায়, পিলখানা হত্যাকাণ্ডে শহীদদের স্মরণে শাহদৎবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় বনানী সামরিক কবরস্থানে শহীদদের স্মৃতিস্তম্বে পুষ্পস্তবক অর্পণ করবেন রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, তিনবাহিনীর প্রধানরা (সম্মিলিতভাবে), স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, বিজিবি মহা-পরিচালক (একত্রে)। ২৬ ফেব্রুয়ারি বাদ আসর পিলখানার বীর উত্তম ফজলুর রহমান খন্দকার মিলনায়তনে শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র সচিব, বিজিবি মহা-পরিচালক, শহীদদের নিকটাত্মীয়, পিলখানায় কর্মরত সকল অফিসার ও বিজিবি সদস্য এবং বেসামরিক কর্মচারীরা উপস্থিত থাকবেন।
সেদিন যা ঘটে :
পিলখানা হত্যা মামলার তদন্ত থেকে জানা যায়, ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি পিলখানার দরবার হলে মহাপরিচালকের (ডিজি) দরবারে মোট ৯৭ জন কর্মকর্তা ও দুই হাজার ৪৮৩ জন জওয়ান ও অন্যরা উপস্থিত ছিলেন। পবিত্র কোরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে দরবার শুরু হওয়ার পর ডিজি মেজর জেনারেল শাকিল আহম্মেদ তার বক্তব্য দিতে থাকেন। তার বক্তব্যের প্রায় শেষ পর্যায়ে হঠাৎ একটা শব্দ হয়।
দরবার হলের পূর্ব-দক্ষিণে রান্নাঘরের দিক থেকে সিপাহি মাঈন, ১৩ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন অস্ত্র নিয়ে দরবার হলের মঞ্চে ঢোকেন। পেছনে পেছনে ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়ন সিপাহি কাজল আলী একটি রাইফেল হাতে মঞ্চের দিকে আসেন। সিপাহি মাঈন ডিজির দিকে অস্ত্র তাক করে ধরেন। সঙ্গে সঙ্গে আশপাশে থাকা সেনা কর্মকর্তারা তাকে আটক করে ফেলেন। দরবার হলে হৈচৈ শুরু হয়ে যায়।
ওই সময় সিপাহি কাজল দরবার হল থেকে বের হয়ে এক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করেন। মুহূর্তের মধ্যে বিডিআর সিপাহিদের দু’টি গ্রুপ দরবার হল ঘিরে ফেলে গুলি করে এবং গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটায়। কর্মকর্তারা জীবন রক্ষার জন্য দরবার হলের মঞ্চের পেছনে, টয়লেট ও বিভিন্ন জায়গায় নিজেদের আড়াল করে রাখার চেষ্টা করেন। অনেক কর্মকর্তা দরবার হল থেকে বের হয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। মেজর শাহ নেওয়াজ, মেজর খালিদ হোসেন ও মেজর ইদ্রিস দরবার হলের দক্ষিণ গেট দিয়ে বের হয়ে একটু যেতেই বিডিআর সদস্যরা তাদের গুলি করে হত্যা করে।
পিলখানার বিভিন্ন কোত থেকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ লুট করে বিদ্রোহীরা গোটা পিলখানায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। দরবার হল থেকে পশ্চিম গেট দিয়ে বের হয়ে রাস্তার পাশে পৌঁছলে ৮-১০ সেনা কর্মকর্তাকে প্রথমে হাঁটু গেড়ে বসিয়ে ও শুইয়ে রাখে বিদ্রোহীরা। এরই মধ্যে একটি পিকআপে সিপাহি রমজান ১৫ ব্যাটালিয়নের সঙ্গীদের নিয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং তার হাতে থাকা এসএমজি দিয়ে ব্রাশফায়ার করে তাদের হত্যা করেন।
সিপাহিদের নির্দেশ মেনে মহাপরিচালক শাকিল আহম্মেদ লাইনের আগে এবং অন্য সেনা কর্মকর্তারা তার পেছনে পেছনে দরবার হলের পশ্চিম গেটের দিকে যেতে থাকেন। দরবার হলের বাইরে দু-তিন পা অগ্রসর হওয়া মাত্র বিদ্রোহীরা ব্রাশফায়ার করে তাদের হত্যা করে। তাদের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র লুটপাট করে। হত্যার আগে বিদোহীরা সেনা কর্মকর্তাদের লাথি, ঘুষি মারে এবং বেয়নেট চার্জ করে।
তিন সেনা কর্মকর্তা দরবার হলের উত্তর দিকে কাচ ভাঙা অংশ দিয়ে পালিয়ে মাঠ ও মাঠের পরে রাস্তা পার হয়ে একটি পানির ট্যাংকের ঘরে ঢুকে আত্মরক্ষার চেষ্টা করেন; কিন্তু বিদ্রোহীরা সেখানে গিয়ে তাদের হত্যা করে। মেজর হুমায়ুন কবির দরবার হলের দক্ষিণে রাস্তার ওপর ডিজির গাড়িতে লুকিয়ে থাকার চেষ্টা করেন। তাকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
বিদ্রোহীদের এলোপাতাড়ি গুলিতে সুবেদার কাশেম দরবার হলের দক্ষিণ পাশে মারা যান। বিদ্রোহীদের গুলি, বোমার বিস্ফোরণে পিলখানার আশপাশের কয়েকজন পথচারী, একজন রিকশাওয়ালাও নিহত হন। তারা একপর্যায়ে ডিজির স্ত্রী, বাসায় থাকা দুই মেহমান ও গৃহকর্মীকেও হত্যা করে। সেনা কর্মকর্তাদের বাসায় ব্যাপক লুটপাট হয়। সেনা পরিবারের সদস্যদের নির্যাতনও করা হয়। এভাবে বিদ্রোহীরা দরবার হল ও আশপাশের এলাকায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে হত্যা করে।
পরবর্তী সময়ে হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে দুটো মামলা হয়। হত্যা মামলার রায়ে ১৫২ জনের ফাসি ২৭৭ জন খালাস পায়। অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডের সাজা হয়।
আজ ২৫ ফেব্রুয়ারি বিডিআর বিদ্রোহের সাত বছর পূর্ণ হচ্ছে। এ উপলক্ষে বিজিবি নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করছে।