ঢাকা : একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় গণহত্যা, লুটপাট, অগ্নিসংযোগ, ধর্ষণের মতো ঘটনা নতুন করে তুলে এনে পাকিস্তান সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে ঘৃণা তৈরিতে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার ও সরকার প্রধান শেখ হাসিনার ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করেছে ইসলামাবাদভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন।
দৈনিকটিতে বৃহস্পতিবার (১৯ ফেব্রুয়ারি) প্রকাশিত ‘ইজ হাসিনাস বাংলাদেশ অ্যাট ওয়ার উইথ ইটসেলফ অর পাকিস্তানি-লাভার্স’ শীর্ষক প্রতিবেদনজুড়ে ছিল এ সমালোচনা। বিশ্লেষণমূলক এক প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন দেশটির অনুসন্ধানী সাংবাদিক নাভিদ আহমেদ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার দায়ে ঢাকায় নিযুক্ত পাকিস্তান হাইকমিশনের নারী এক কূটনীতিককে বহিষ্কারের পর দু’দেশের সম্পর্কের অতীত তিক্ততা নতুন মাত্রা পায়। পরে দেশটিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের নারী কূটনীতিককে বহিষ্কার করে পাকিস্তান বদলা নেয়।
এ নিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্নে আওয়ামী লীগ এমপিদের দাবির মুখে পাকিস্তানি ওই কূটনীতিককে বহিষ্কার করা হয়েছে বলেও উল্লেখ করা হয় নাভিদের ওই প্রতিবেদনে।
নাভিদ আহমেদ বলেন, শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসলেই আন্তর্জাতিক সংবাদ মাধ্যমের শিরোনাম হয়ে ওঠে ঢাকা। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন-পীড়নসহ নানা প্রসঙ্গ টেনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী বিচারের ইস্যু। এ বিচার শুরু করে বাংলাদেশ ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল পাকিস্তান, ভারত ও সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের মধ্যকার ত্রিপক্ষীয় চুক্তি শেখ হাসিনা লঙ্ঘন করেছে বলেও মন্তব্য করেন নাভিদ আহমেদ।
তবে ত্রিপক্ষীয় ওই চুক্তি কীভাবে লঙ্ঘিত হয়েছে তা ব্যাখ্যা করেননি প্রতিবেদক।
পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফ বাংলাদেশ সফরে গিয়ে সেখানে একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনা সদস্যদের গণহত্যা, লুটপাট ও ধর্ষণের মতো অপরাধের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। বলেন, ‘বর্বর এ আচরণে বাংলাদেশের মানুষের বেদনার সঙ্গে সমব্যথী পাকিস্তানের ভাই-বোনেরাও। অতীত ভুলে আসুন আমরা সামনে তাকাই।’
সেসময় বাংলাদেশে বিএনপি নেতৃত্বাধীন সরকার একাত্তরের ভূমিকা নিয়ে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল পারভেজ মোশাররফের এ বক্তব্যকে স্বাগত জানিয়েছে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগসহ বিরোধী রাজনৈতিক শিবির জেনারেল মোশাররফের এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে বলেন, ‘শুধুমাত্র দুঃখ প্রকাশ যথেষ্ট নয়।’
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের সময় মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে বিএনপির শীর্ষ নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, সহকারি সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের ফাঁসি হয়।
অবশ্য পাকিস্তানি এ প্রতিবেদকের ভাষায় একাত্তরে পাকিস্তানকে সমর্থন করার দায়ে জামায়াত ও বিএনপির এ চার নেতাকে ফাঁসি দেয়া হয়। একই অপরাধে জামায়াতের সাবেক প্রধান গোলাম আযমকে বয়স বিবেচনায় আমৃত্যু কারাদণ্ড দেয়া হয়। পরে তিনি জেলখানাতেই মারা যান। দলটির নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকেও মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাগারে রয়েছেন।
বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে শেখ হাসিনা ২০০৯-এ মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল নামকরণ করা হলেও সেখানে বিদেশি কোনো বিচারক নিয়োগ দেয়া হয়নি বলে উল্লেখ করেন নাভিদ আহমেদ।
প্রতিবেদনে বলা হয়, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে ‘তথাকথিত’ আদালত গঠনের আগে দু’দেশের সম্পর্ক স্বাভাবিক রাখতে পাকিস্তানের পক্ষ থেকে চেষ্টা করা হলেও তাতে সায় দেয়নি বাংলাদেশ।
মানবতাবিরোধী অপরাধের এ বিচার প্রক্রিয়াকে ‘তথাকথিত’ দাবি করে প্রতিবেদক আরো বলেছেন, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা এ বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনকে ঘিরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি উত্তপ্ত হতে শুরু করে। প্রধান বিরোধী দল বিএনপি এবং দলটির সমমনা জোটের শরিকরা ওই নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকে এবং নির্বাচন প্রতিরোধের ডাক দেয়। এতে দেশজুড়ে সহিংসতা শুরু হয়। তিন বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় ৫শর বেশি মানুষ নিহত হয়েছে বলেও ওই প্রতিবেদনে উল্লেখ করেন পাকিস্তানি এ সাংবাদিক।
লক্ষণীয়, বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা নিয়ে প্রতিবেশি ভারত মোটেও মাথা ঘামাচ্ছে না। দেশটিতে সন্ত্রাস বৃদ্ধি নিয়েও দিল্লির কোনো উদ্বেগ নেই বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।