ভালোবাসার সংজ্ঞা নিরূপণ আক্ষরিক অর্থে খুবই কঠিন। ভালোবাসা বলতে আমরা সাধারণত: বুঝি প্রেমিক-প্রেমিকার ভালোবাসা। ভালোবাসা বয়সে, মানুষে-মানুষে, সামাজিক অবস্থানে, নানা ক্ষেত্রে তাঁর রূপ পাল্টায়। প্রকাশ ভঙ্গি ভিন্ন হয়। ক্ষুধার্ত মানুষের ভালোবাসা হলো এই মুহূর্তে তাঁর জন্য খাবার চাই। যার কাছে খাবার আছে তাঁর জন্য হয়তো তাঁর প্রেমিকার জন্য অপেক্ষা করার নাম ভালোবাসা। যে মানুষটি শুধু সম্পদের পাহাড় গড়তে চায় তাঁর কাছে কাড়ি কাড়ি টাকা অর্জন করাই ভালোবাসা। টাকা চাই আরও টাকা। এটাই তাঁর ভালোবাসা… তাঁর কাছে প্রেম-প্রীতি অথবা মানবিক কোন ব্যাপার মোটেই গুরুত্বপূর্ণ নয়। কাজেই ভালোবাসার সংজ্ঞা নিরূপণ করা সত্যি কঠিন ব্যাপার। রোমান সাম্রাজ্য যখন পুড়ে যাচ্ছিলো তখন নিরো বাঁশি বাজাচ্ছিলেন। তখন তাঁর কাছে বাঁশির সুরই ছিল ভালোবাসা।
অনেকে উত্তম ভালোবাসার কথা বলেন। হ্যাঁ উত্তম ভালোবাসা আসলে গভীর অনুভূতির একটা প্রকাশভঙ্গি। সেই চল্লিশ, পঞ্চাশ, ষাট দশকে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ভালোবাসার প্রকাশ ভঙ্গি মূলত চলচ্চিত্রের মাধ্যমেই প্রাণ পেয়েছিল। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন উত্তম-সূচিত্রা। ছবিতে তাঁদের অভিনয় দেখে দর্শক মুগ্ধ হতেন। ছেলেরা এক একজন উত্তম কুমার, মেয়েরা এক একজন সুচিত্রা হতে চাইতেন। ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে তাঁরা একটা স্বপ্ন ছড়িয়ে দিতেন। সেই স্বপ্নের পেছনে ছুটতো দর্শক। এখনকার চলচ্চিত্রে ভালোবাসার এমন সৌন্দর্য দেখা যায় না। এখনকার চলচ্চিত্রে কাহিনীর মধ্যে প্রেম থাকলেও হিংসা আর বিদ্বেষের প্রকাশ ভঙ্গিই বেশি। কে কাকে বিপদে ফেলে এগিয়ে যাবে, কে কার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করবে এটাই যেন মূল বিষয়। ফলে ভালোবাসার ছবিতেও ভালোবাসা দাগ কাটে না। উত্তমও আসে না সূচিত্রাও আসে না।
সেই সময়কার ছবিতে পাশের বাড়ির মেয়েটির সঙ্গে ভালোবাসার সম্পর্ক গড়ার ক্ষেত্রে একধরনের কোমলতা ছিল। প্রকাশভঙ্গির সৌন্দর্য ছিল। কোমল স্পর্শের আকাঙ্খা ছিল। কিন্তু বর্তমান সময়ের ছবিতে এমনটা আর দেখা যায় না। এখনকার ছবিতে স্পর্শের কোমল আকাঙ্খার বদলে মনে হয় সুযোগ পেলেই প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে কত বেশি ঘনিষ্ট হওয়া যায় এই চেষ্টাই থাকে। সম্পর্কের ক্ষেত্রে কোমল স্পর্শের বদলে হিংস্র থাবার বহি:প্রকাশ দেখা যায়। ফলে ছবি আর ছবি হয়ে ওঠে না। উত্তম আর উত্তম থাকে না। অধম হয়ে যায়।
ষাট সত্তুর দশকে চলচ্চিত্রের মাধ্যমে মানুষের মধ্যে ভালোবাসার যে সম্পর্ক ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল তা তখনকার সমাজ জীবনে কার্যকর প্রভাবও সৃষ্টি করেছিল। উত্তম আর সুচিত্রার ‘উত্তমপ্রেম’ দেখে সবাই তা অনুসরণ করতে চাইত। একটি পরিবার গঠনের জন্য, স্বামী-স্ত্রীর প্রেমকে জাগ্রত করা, সাংসারিক বন্ধন সুদৃঢ় করা, সুন্দর সমাজ গঠনের জন্য তখনকার দিনের চলচ্চিত্র ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। তখনকার দিনের চলচ্চিত্র স্বামীর প্রতি স্ত্রীর শ্রদ্ধা, স্ত্রীর প্রতি স্বামীর কর্তব্যবোধ, প্রেমিকার প্রতি প্রেমিকের করণীয় সর্বোপরি একটি সুন্দর সমাজ গঠনে পরিবারের ভূমিকা কেমন হওয়া উচিত তা শেখাতো। চলচ্চিত্রের এতটাই প্রভাব ছিল যে উত্তম আর সূচিত্রা হতে চাইতেন সবাই। তরুণীরা ভাবতো আমার প্রেমিক অথবা জীবন সঙ্গীকে হতে হবে উত্তম কুমারের মতো। আর তরুণেরা ভাবতো আমার জীবন সঙ্গীকে হতে হবে সুচিত্রা সেনের মতো।
সেই সময়ে অভিসার সিনেমা হলে সুচিত্রা সেনের একটি ছবি দেখেছিলাম। প্রেমিকের জন্য তাঁর যে হাহাকার। ছবিটা দেখার পর ৩/৪ দিন আমি নিজেকে স্থির রাখতে পারিনি। শুধুই ভাবতাম মানুষ মানুষকে এত ভালোবাসতে পারে?
সেই সময়ে একান্নবর্তী পরিবারগুলো টিকে ছিল মূলত ভালোবাসার কারণে। বড় পরিবার। অনেক সদস্য। অথচ কী সীমাহীন ভালোবাসা আর শ্রদ্ধাবোধ ছিল পরস্পরের মধ্যে। বড়দের প্রতি ছোটদের সম্মান শ্রদ্ধা প্রকাশের ভঙ্গি ছিল অত্যনত্ম আনত্মরিক। বড়রা তাই ছোটদেরকে পরম মমতায় আগলে রাখতেন। মিষ্টি শাসন ছিল। ভালোবাসা ছিল। পাশাপাশি শ্রদ্ধাবোধ ছিল। এক্ষেত্রে তখনকার দিনের চলচ্চিত্র ব্যাপক ভূমিকা পালন করেছে। কালের বিবর্তনে পরিস্থিতি পাল্টে গেছে। এখনকার কেউ সমষ্টি নিয়ে ভাবে না। সবাই যেনো যার যার তাঁর তাঁর ভাবে চলছে। ফলে ভালোবাসাও ভেঙ্গে ভেঙ্গে টুকরো হয়ে গেছে। ভালোবাসার শক্তি যেন কমে যেতে শুরু করেছে।
একটু উদাহরণ দিলেই বোধকরি বিষয়টা আরও পরিষ্কার হয়ে যাবে। রোজ সাইকেল চালিয়ে রাসত্মা পার হন একজন শিক্ষক। তার বেশভূষা, চোখের চশমা, চাহনি সব কিছুতেই একটা কোমল ভাব। পথে ছাত্রীর সাথে দেখা হয়। শিক্ষক ছাত্রীর প্রতি স্নেহের আলো ছড়িয়ে দেন আর ছাত্রী ছড়ায় শ্রদ্ধার আলো। আহ! কী মধুর দৃশ্য!
বর্তমানে এই ধরনের দৃশ্য দেখলে সহজেই মনে হবে ইভটিজিং হচ্ছে। কারণ প্রকাশ ভঙ্গি পাল্টেছে। শ্রদ্ধা আর স্নেহের সেই আলো যেনো নেই। কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। অথচ আমরা অনেক আধুনিক হয়েছি। কিন্তু মানবিক হতে পারি নাই। স্বেচ্ছাচারিতাকেই অনেকে প্রশ্রয় দিয়ে চলেছি। এই অবস্থার পরিবর্তন দরকার। অতীতের মতো বর্তমানেও চলচ্চিত্র এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা পালন করতে পারে। একথা সবাই মানবেন ওপারে মহানায়ক উত্তম কুমার আমাদের দেশে নায়করাজ রাজ্জাক ছবিতে অভিনয়ের মাধ্যমে ভালোবাসার শক্তিকেই উজ্জ্বল করেছেন। তাই সিনেমাপ্রেমী মানুষের কাছে তাঁরা দু’জনই অনেক শ্রদ্ধার পাত্র। বর্তমানের ছবিতেও ভালোবাসা আছে। কিন্তু কাহিনীর বিশ্বসত্মতা নাই। কোমলতা নাই। শুধুই হানাহানি আর কানাকানি। ফলে ভালোবাসা হারিয়ে যাচ্ছে। বর্তমান সিনেমা আমাদের সমাজ জীবনে অতীতের মতো আর প্রভাব ফেলছে না। অতীতের মতো আর জীবনধর্মী ছবি পাইনা বলে আমরা এখন আর সিনেমা হলে যাই না।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে সকলের সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি। বেশি করে জীবনধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণ করা জরুরি। আমি যা নই তা যেন সাজতে না চাই। আমাদের সমাজ কাঠামো আমাদের ঐতিহ্য সব কিছুকে গুরুত্ব দিয়ে জীবনধর্মী ছবি নির্মাণ করা জরুরি। দেশের টেলিভিশন মাধ্যমেরও এক্ষেত্রে ব্যাপক ভূমিকা রাখার সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি। সবশেষে সবাইকে একেবারে সাম্প্রতিক সময়ের একটি ছবি দেখার বিনীত অনুরোধ করবে।া ছবিটি সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত ‘বেলা শেষে’। ছবি দেখলেই বোঝা যাবে ভালোবাসা কাকে বলে!
সৌজন্যে আনন্দ আলো