ঢাকা : ২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল, এ ৮ বছরে ৪৩৪ জন আদিবাসী নারী ও শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। শুধু ২০১৫ সালে ১৪টি ধর্ষণ, ১২টি গণধর্ষণ, ১১টি শারীরিক লাঞ্চনা, ৬টি শারীরিক ও যৌন হয়রানি, ১৬টি ধর্ষণ চেষ্টাসহ ৬৯টি ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে পার্বত্য অঞ্চলে ৩৮টি, বাকি ২১টি সমতলে।
মঙ্গলবার ডেইলি স্টার ভবনে আয়োজিত ‘বাংলাদেশের আদিবাসী নারীদের সামগ্রিক প্রতিবেদন ২০১৫’-এর মোড়ক উন্মোচন এবং আলোচনাসভায় এসব তথ্য জনানো হয়।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ভূমি বিরোধ ও সাম্প্রদায়িক আগ্রাসনের কারণে সংখ্যালঘু আদিবাসী নারীরা সহিংসতার শিকার হয়েছেন বলে রিপোর্টে উল্লেখ করা হয়।
রিপোর্টে বলা হয়, আদিবাসী নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতার আইনি সহযোগিতা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের সহযোগিতা এখনো প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগন্য।
২০১৪ সালের তুলনায় পরের বছর আদিবাসী নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা কমলেও আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীদের জীবনে তেমন কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। শারীরিক ও যৌন সহিংসতাকে পুঁজি করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ আদিবাসী নারীদের চলাফেরা ও গতিশীলতার ওপর নিয়ন্ত্রণ চাপিয়ে তাদের কণ্ঠরোধ করার চেষ্টা করে।
এ ধরনের ঘটনা অ-আদিবাসী তথা বাঙালিরাই বেশি ঘটান বলে রিপোর্ট তুলে ধরা হয়। রিপোর্টে আরো বলা হয়, পার্বত্য শান্তি চুক্তি বাস্তায়িত না হওয়ার কারণে নারী ও শিশুরা মারাত্মকভাবে এ সহিংসতার শিকার হচ্ছে।
এর মধ্যে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি না হওয়া, অস্থায়ী সেনা ক্যাম্প না সরানো, ভারত প্রত্যাখাত জুম্ম শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ জুম্ম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসন না করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিষদগুলোকে ক্ষমতায়িত না করা, পার্বত্য চট্টগ্রামের অস্থায়ী বাসিন্দাদের নামে বরাদ্দকৃত জমির লিজ বাতিল না করা নারী ও শিশু নির্যাতনের অন্যতম কারণ।
বিশ্বয়ানের প্রভাব ও উদারনৈতিক অর্থনৈতিক নীতিসহ সামরিকীকরণ, চিরাচরিত ভিটেমাটি থেকে বারবার উচ্ছেদের ফলে আদিবাসী নারীরা বিকল্প ধারার অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত হতে বাধ্য হচ্ছে। তার মধ্যে অ-আদিবাসীদের ক্ষেতে দিনমজুরির কাজ, গার্মেন্টস, বিউটি পার্লারসহ অন্যান্য কাজে তারা অংশ নিচ্ছেন। কিন্তু বরাবরই তারা মজুরি বৈষম্য, শ্লীলতাহানি, শারীরিক সহিংসতা ইত্যাদির শিকার হচ্ছেন। ফলে বরাবরই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে আদিবাসীদের মৌলিক অধিকার।
আলোচনা সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের নির্বাহী পরিচালক অ্যাডেভোকেট সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু নামে দুটি বিভাজন দেখা দিয়েছে। এটা অত্যন্ত অনভিপ্রেত বাংলাদেশের জন্য।’
তিনি বলেন, ‘সংখ্যলঘু, সংখ্যাগুরু, ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠী, বৃহৎ গোষ্ঠী নানাধরনের যে বিভাজনের চিন্তা আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হচ্ছে। এতে করে আমাদের মৌলিক অধিকার এবং মৌলিক চিন্তাকে অসম্মান করা হচ্ছে।’
এ সময় তিনি আদিবাসী পুরুষরাও ধর্ষণের সঙ্গে জড়িত হচ্ছে বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেন, ‘ইন্টারনেট টেকনোলজির কারণে আদিবাসী পুরুষদের মধ্যে ধর্ষণ, নির্যাতন, হয়রানি করার মতো মানসিকতা ঢুকে পড়েছে।’
আদিবাসীরা প্রতিপক্ষ হিসেবে অনেক দুর্বল বলে উল্লেখ করে সুলতানা কামাল বলেন, ‘প্রতিপক্ষ হিসেবে আদিবাসীরা অনেক দুর্বল। শিশুর ওপর নির্যাতন করলে যেমন সে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে না, প্রতিহত করতে পারে না, সুরক্ষার জন্য অন্যের ওপর নির্ভর করে, ঠিক তেমনি আদিবাসী নারীদের যখন নির্যাতন করা হয় তাদের কিছু করার থাকে না। প্রতিপক্ষ হিসেবে অন্য নারীদের তুলনায় আদিবাসী নারীরা অনেক দুর্বল হয়ে থাকে।’
বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন সুলতানা কামাল। তিনি বলেন, ‘এটা শুধু আদিবাসীদের ক্ষেত্রেই না। এ ধরনের কার্যকলাপ হারহামেশাই ঘটছে। আমরা এখন বিচারহীনতার সংস্কৃতির মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। এসব অপকর্ম প্রতিরোধ করতে হলে প্রত্যেককে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘আমরা জানি ভূমি দখল, ভূমি উচ্ছেদের ক্ষেত্রে নারী ও শিশু নির্যাতন সরাসরি জড়িত। নারীর ওপর নির্যাতন করেই সহজে ভূমি থেকে উচ্ছেদ করা যায়। এবং সে কৌশলটা কখনোই ভূমিদস্যুরা ব্যবহার করতে দেরি করে না। তারা এমন একটা পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়, তখন মানুষ বাধ্য হয়ে বলে আমার ভূমি যাক, আমার মেয়েদের, বাড়ির মহিলাদের ইজ্জত রক্ষা করতে হবে। তখন তারা এ জায়গা ছেড়ে চলে যায়।’
কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক পল্লব চাকমার সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক শাহীন আনাম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম।
বাংলাদেশ ইন্ডিজেনিয়াস উইমেন নেটওয়ার্কের সদস্য সচিব কাঞ্চনা চাকমার সঞ্চালনায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন আচিক মিচিক সোসাইটির নির্বাহী পরিচালক সুলেখা মং, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ড. ওবায়দুল হক।
মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের সার্বিক সহযোগিতায় কাপিং ফাউন্ডেশন এবং বাংলাদেশ ইন্ডিজেনিয়স উইমেন বাংলাদেশের তত্ত্বাবধানে এ প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়।