ঢাকা : উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা ছাড়াই আগামী বছর রজতজয়ন্তী উদযাপন করতে যাচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ। আর্থিক সহায়তার অভাবেই মূলত বড় কোনো গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারেনি বিভাগটি।
ড. রাজীব হুমায়ুনের সভাপতিত্বে ১৯৯২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাষাতত্ত্ব বিভাগ (বর্তমান ভাষাবিজ্ঞান বিভাগ) নামে স্বতন্ত্র বিভাগটি চালু হয়। তখন শুধু এমএ, এমফিল ও পিএইচডি ডিগ্রি প্রদান করা হত। পরবর্তীতে ১৯৯৬-৯৭ শিক্ষাবর্ষ থেকে বিএ (সম্মান) শ্রেণির কার্যক্রমের সূচনা ঘটে এবং বর্তমানে তা অব্যাহত রয়েছে।
সুদীর্ঘ পথপরিক্রমায় ছোটখাটো গবেষণা, স্বল্পপরিসরে বছরে দুইটি গবেষণামূলক পত্রিকা, প্রতিমাসে একটি-দুইটি করে সেমিনার, সিম্পোজিয়াম, ভাষার মাসে আনুষ্ঠানিক কিছু প্রোগাম- এসবেই মূলত আটকে আছে ভাষা নিয়ে অধিকতর গবেষণাকল্পে প্রতিষ্ঠিত প্রতিষ্ঠানটি।
ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান বলেন, ‘গবেষণার ক্ষেত্রে আমাদের বড় সমস্যা হচ্ছে অর্থ। মাতৃভাষা হিসেবে বাংলার আলাদা একটা গুরুত্ব আছে। সে গুরুত্ব অনুযায়ী ভাষা নিয়ে যে বড় বড় কাজ হওয়ার কথা ছিল, সেটা এখনো হয়নি। আগামী বছর আমাদের বিভাগের ২৫ বছর পূর্ণ হবে। তবে এখনো পর্যন্ত বড় কোনো অবদান ভাষাবিজ্ঞান রাখতে পারেনি।
কর্মক্ষেত্রে এবং আর্থিক সহায়তা না থাকার কারণেই এমনটা হয়েছে বলে মনে করেন শাহরিয়ার রহমান। তিনি বলেন, ‘বড় গবেষণা মানে বড় আর্থিক সহায়তা থাকতে হবে। বিশ্বদ্যিালয় থেকে গবেষণার জন্য যে বরাদ্দ দেয়া হয়, তা দিয়ে বড় কোনো গবেষণা করা সম্ভব না।’
এ বিভাগে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনার জন্য যথেষ্ট শ্রেণিকক্ষ নেই। একটি মাঝারি, আরেকটি ছোট- এ দুটি কক্ষে পালাক্রমে ক্লাস পরিচালনা করা হয়। আছে শিক্ষার্থীদের কমনরুমসহ একাডেমিক নানা সংকট।
বিষয়টি সম্পর্কে সৈয়দ শাহরিয়ার রহমান বলেন, ‘আমরা ক্লাস পরিচালনা করার জন্য দুটি রুম পাই। এ দুটি রুমে আমাদের সবকিছু অ্যাডজাস্ট করতে হয়। যা খুবই টাফ। মূল সমস্যা হচ্ছে আমাদের পর্যাপ্ত ক্লাসরুম নেই।’
তিনি বলেন, ‘ভাষাবিজ্ঞান বিভাগে প্রতি বছর নতুন শিক্ষার্থী ভর্তি হতে পারে ৯০ জন। মাইগ্রেশন করে ৪/৫ অন্য বিভাগে গেলেও প্রায় ৮৫ জনের মতো শিক্ষার্থী থাকে। আমাদের ক্লাস রুমের ক্যাপাসিটি ৭০ জনের। এখন আমরা সেকশন ভাগ করে বিষয়টি বিন্যস্ত করার চেষ্টা করেছি।’
কর্মক্ষেত্রেও আছে বহুমুখি সীমাবদ্ধতা। কলেজগুলোতে ভাষাবিজ্ঞানের পোস্ট না থাকায় বিসিএস শিক্ষা ক্যাডারে নেই তাদের অর্ন্তভুক্তি। পোস্ট না থাকায় পরীক্ষা দিতে পারে না বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়ও। এর ফলে এ বিষয়ে পড়াশোনা শেষ করে তারা বিষয়ভিত্তিক কর্মসংস্থান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
এতে জ্ঞানের পরিধি সীমাবদ্ধ হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন ভাষাবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গুলশান আরা। তিনি বলেন, ‘বাংলা ২য় পত্র, ইংরেজি ২য় পত্র অর্থাৎ ব্যাকরণের যে বিষয়গুলো আছে; আমি নিশ্চিত করে বলতে পারি আমাদের ছেলেমেয়েরা যেকোনো বিভাগের শিক্ষার্থীদের চেয়ে ভালো করতে পারবে।’
‘আমরা তাদেরকে একেবারে শুরু থেকে ধরে ধেরে শেখাই। যেমন স্বরবর্ণ-ব্যঞ্চনবর্ণের উচ্চারণ কীভাবে হয়। উচ্চারণের সময় জিহ্বার ব্যবহার, চোয়ালের ব্যবহার, সবকিছু তাদের শেখানো হয়। তাদেরকে কর্মক্ষেত্রের সুযোগটা দেয়া হচ্ছে না। এ কারণে তারা যে শিক্ষা দিচ্ছি তা সর্বত্র ছড়িয়ে দিতে পারছে না।’
সঠিক শিক্ষা না পাওয়ায় ভাষাজ্ঞান সম্পর্কে পিছিয়ে যাচ্ছে বর্তমান শিক্ষার্থীরা। তিনি বলেন, ‘অনেক ছেলেমেয়ে প্রমিত বাংলা কী তাই জানে না। অতি সম্প্রতি আমি একটা কবিতা আবৃত্তির প্রোগ্রামে গিয়েছিলাম, সেখানে গিয়ে দেখলাম একটা বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছেলে প্রমিত বাংলা কী তাই জানে না।’
শিক্ষাব্যবস্থায় গলদের কারণেই এমনটা হচ্ছে বলে মনে করেন গুলশান আরা। তিনি বলেন, ‘এতদিন পড়াশোনা করার পরও তার কাছে পরিষ্কার হয়নি প্রমিত বাংলা আসলে কী। কারণ তাকে শেখানো হয়নি। যদি আমাদের সুযোগ থাকত তা হলে আমরা আমাদের অর্জিত জ্ঞান কাজে লাগাতে পারতাম।’
‘কলেজে পোস্ট না থাকার কারণে বিসিএসে আমাদের বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত হয়নি। এখন কলেজগুলোতে যদি বাংলা ২য় পত্র ও ইংরেজি ২য় পত্র পড়ানোর জন্য একটি করে দুইটি পোস্ট তৈরি করা হয় যেখানে ভাষাবিজ্ঞানের ছেলেমেয়েরা সুযোগ পাবে। তাহলে সঠিক শিক্ষাদানের মাধ্যমে সবাই উপকৃত হতে পারবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের শিক্ষার্থীরা অন্য বিষয় নিয়ে বিসিএসে অংশগ্রহণ করছে। আমি অত্যন্ত গর্বের সঙ্গে বলতে পারি তারা ভালো করছে। এত প্রতিকূলতা সত্ত্বেও তারা বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হচ্ছে। আমাদের দুর্ভাগ্য, তাদের জন্য পথটা সহজ করে দিতে পারছি না।’
গুলশান আরা আরো বলেন, ‘বেসরকারি শিক্ষক নিবন্ধন পরীক্ষায়ও আমাদের শিক্ষার্থীরা অংশ নিতে পারছে না। ভাষাবিজ্ঞান বিষয়টা অন্তর্ভুক্ত না থাকার কারণে এ সমস্যাগুলো হচ্ছে।’
সমস্যা সমাধানের বিষয়ে বিভাগটির বর্তমান চেয়ারম্যান বলেন, ‘সমন্বয়হীনতা এবং পরস্পরবিরোধী অবস্থানের কারণেই মূলত বিসিএস এবং নিবন্ধন পরীক্ষায় অংশগ্রহণের বিষয়টি ঝুলে আছে। এর একটি সুষ্ঠু সমাধান খুঁজে বের করার চেষ্টা আমরা করে যাচ্ছি।’