ভালো নেই সুন্দরবন

কৃষি, পরিবেশ ও প্রকৃতি

 

 

untitled-9_193050

 

 

 

 

 

ভালো নেই বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল ‘সুন্দরবন’। পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় অসচেতনতা, অবহেলা এবং সর্বোপরি মানুষের ক্রমাগত অত্যাচারে অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে হিমশিম খাচ্ছে এই বন। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব এবং দুর্যোগে হুমকির মুখে পড়েছে বনের প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য। নিষেধাজ্ঞা থাকা সত্ত্বেও বনের ভেতর দিয়ে পণ্যবাহী নৌ চলাচল অব্যাহত আছে। সংঘবদ্ধ চোরাকারবারিরা কেটে নিচ্ছে গাছ। শিকার করা হচ্ছে বাঘ ও হরিণসহ বিভিন্ন বন্যপ্রাণী। এসব অনিয়ম বন্ধে কোনো ব্যবস্থা নিতে পারছে না বন বিভাগ। এদিকে সাগরের পানির উচ্চতা ও লবণাক্ততা বাড়ায় কমে যাচ্ছে সুন্দরী গাছ, কমছে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র।

 

 
৫ বছর ধরে সুন্দরবনের জয়মনিরগোল থেকে শরণখোলার বগি পর্যন্ত প্রায় ৬০ কিলোমিটার নদীপথে প্রতিদিন পণ্যবাহী অসংখ্য জাহাজ চলাচল করছে। সম্প্রতি মংলা-ঘষিয়াখালী নৌ-রুট চালু হলেও সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি। এ ছাড়া মংলা বন্দরের জেটি থেকে বঙ্গোপসাগর পর্যন্ত সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে চলাচল করছে দেশি-বিদেশি জাহাজ। সুন্দরবনের ভেতরের নদী দিয়ে রায়মঙ্গল ও আংটিহারা এলাকা হয়ে জাহাজ যাওয়া-আসা করে ভারতে।

 
এসব জাহাজ চলাচলে সৃষ্ট ঢেউয়ের কারণে ভাঙছে নদীর তীর। জাহাজের ইঞ্জিনের শব্দ ও হাইড্রোলিক হর্ন আতঙ্কিত করছে বন্যপ্রাণীদের। নৌযান থেকে তেল ও বর্জ্য ছড়িয়ে পড়ছে বনের মধ্যের অসংখ্য খালে। এতে দূষিত হচ্ছে বনের মাটি ও পানি। ২০১৪ সালের ৯ ডিসেম্বর সাড়ে ৩ লাখ লিটার ফার্নেস তেল নিয়ে ট্যাঙ্কারডুবির কারণে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির মুখে পড়ে সুন্দরবন। ২০১৫ সালের মে মাসে পটাশ সার নিয়ে সুন্দরবনের ভোলা নদীতে একটি কার্গো ডুবে যায়। সর্বশেষ ২৭ অক্টোবর বনের পশুর নদে ৫১০ টন কয়লা নিয়ে ডুবেছে আরেকটি কার্গো। রামপালে কয়লাবিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হলে সুন্দরবনের মধ্য দিয়ে নৌযানে করে সেখানে প্রতি বছর নেওয়া হবে ৪৫ লাখ টন কয়লা। এত বনের প্রতিবেশের ওপর চাপ বাড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

 
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ সমিতির জ্যেষ্ঠ গবেষক মো. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, দ্রুতগতির জাহাজের ঢেউয়ের কারণে নদীর তীর ভাঙছে। সেই মাটি নদীর মোহনার বিভিন্ন গভীর পয়েন্ট ভরাট করে ফেলছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক ডা. আবদুল মতিন সমকালকে বলেন, পর র জাহাজডুবির কারণে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য হুমকির মুখে, অথচ কর্তৃপক্ষের টনক নড়ছে না।

 
সুন্দরবনের পূর্ব বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা সাহিদুল ইসলাম বলেন, সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌ চলাচল বন্ধ করা উচিত। এ জন্য সরকারের কঠোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন জরুরি।

 
সুন্দরবনে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন নিয়ে দেশি-বিদেশি চাপ বাড়ছে। ২০১৫ সালে নরওয়ের পেনশন ফান্ড কর্তৃপক্ষ রামপাল প্রকল্পের ভারতীয় অংশীদার এনটিপিসি থেকে তাদের বিনিয়োগ প্রত্যাহারের ঘোষণা দেয়। তাদের দাবি, এনটিপিসি বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের ক্ষতি করে রামপাল বিদ্যুৎ?কেন্দ্র নির্মাণ করছে। একই অভিযোগে ফ্রান্সের তিনটি শীর্ষস্থানীয় ক্রেডিট অ্যাগ্রিকোল, সোসিয়েতে জেনেরাল ও বিএনপি পারিবাস ব্যাংক রামপাল প্রকল্পে অর্থায়ন করবে না বলেও ঘোষণা দেয়। এর আগে ২০১৪ সালে ইউনেস্কো ও রামসার কর্তৃপক্ষ সুন্দরবনের পাশে শিল্প কারখানা স্থাপন ও রামপাল প্রকল্পের ব্যাপারে উদ্বেগ জানিয়েছে। কারণ প্রকল্পটি চালু হলে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে নৌযান চলাচল বাড়বে এবং বায়ু ও পানি দূষিত হওয়ার আশঙ্কাও বৃদ্ধি পাবে।

 
রামপাল প্রকল্পটি সুন্দরবন থেকে ১০ মাইলেরও কম দূরত্বে। ইউনেস্কোর একটি প্রতিনিধি দল আগামী মাসে সুন্দরবন পরিদর্শনে আসছে।

 
গাছ পাচার: নিষেধাজ্ঞার পরও সুন্দরবন থেকে প্রতিদিন সুন্দরী, গেওয়া ও গরানসহ বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নিয়ে বিক্রি করছে চোরাকারবারিরা। বন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, এক হাজারেরও বেশি লোক সম্পৃক্ত এই কাজে। অভিযোগ রয়েছে, বন বিভাগের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারী ও এর সঙ্গে জড়িত চোরাকারবরিদের পাশাপাশি কিছু জেলে, বাওয়ালি ও মৌয়াল গাছ কেটে নিচ্ছে। সুন্দরবন একাডেমির উপদেষ্টা রফিকুল ইসলাম খোকন সমকালকে বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে আবারও গাছ পাচার হচ্ছে। এই পাচার বন্ধে বন বিভাগের উদ্যোগ পুরোপুরি সফল হচ্ছে না।

 
বাঘ-হরিণ শিকার: সুন্দরবনে বাঘ ও হরিণ শিকারিরা এখনও বেপরোয়া। চোরা শিকারিদের পাশাপাশি এখন বনদস্যুরাও বাঘ এবং হরিণ মেরে এসবের হাড়, মাংস, চামড়া, পুরুষাঙ্গ ও দাঁত বিদেশে পাচার করছে। র‌্যাব-৬ (খুলনা) ও র‌্যাব-৮ (বরিশাল) সূত্র জানিয়েছে, গত ২ বছরে তারা বাঘের ৯টি চামড়া উদ্ধার করেছে। এসব ঘটনায় আটক হয়েছে ছয়জন। ২০১৫ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি বরগুনার পাথরঘাটা থেকে হরিণের ৩৬টি চামড়াসহ দু’জন এবং বাগেরহাটের শরণখোলা থেকে হরিণের একটি চামড়াসহ আটক করা হয় একজনকে। ২০ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া উপজেলার ইকড়িবাজার থেকে বাঘের একটি চামড়া ও হরিণের ১৪টি চামড়াসহ দু’জনকে আটক করে র‌্যাব। গত বছর ২৪ ফেব্রুয়ারি সাতক্ষীরার আশাশুনি উপজেলার বুধহাটা এলাকা থেকে বাঘের একটি এবং হরিণের চারটি চামড়াসহ তিনজনকে আটক করা হয়।

 
সর্বশেষ বাঘ শুমারি অনুযায়ী সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা নেমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১০৬টিতে। সুন্দরবন একাডেমির নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক আনোয়ারুল কাদির বলেন, বাঘ ও হরিণ শিকারের সব ঘটনা প্রশাসনের নজরে আসে না। চামড়া বহনকারীরা ধরা পড়লেও শিকারি এবং বন্যপ্রাণীর চামড়া ক্রেতার বেশিরভাগই রয়ে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে।

 
হুমকির মুখে ডলফিন: ২০১২ সালের জানুয়ারিতে সুন্দরবনের ঢাংমারী, চাঁদপাই ও দুধমুখী এলাকাকে ডলফিনের অভয়ারণ্য হিসেবে ঘোষণা করে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়। ওই তিনটি এলাকার প্রায় ৩১ কিলোমিটার নদীতে রয়েছে সংকটাপন্ন ইরাবতি ও শুশুক ডলফিনের বিচরণ। কিন্তু বনের মধ্য দিয়ে চলাচলকারী ভারী নৌযানের পাখার আঘাতে মারা পড়ছে ডলফিন। এ ছাড়া এসব এলাকায় জেলেদের জালে আটকা পড়েও মারা যাচ্ছে শুশুক ও ইরাবতি।

 
বিষ দিয়ে মাছ শিকার: সুন্দরবনের বিভিন্ন নদী ও খালে দীর্ঘদিন ধরে বিষ দিয়ে মাছ শিকার করছে একটি চক্র। ফলে বিভিন্ন মাছের পোনা, কাঁকড়া এবং জলজ প্রাণীও মারা যাচ্ছে। সুন্দরবনের দুবলার ফিশারম্যান গ্রুপের চেয়ারম্যান মেজর (অব.) জিয়াউদ্দিন আহমেদ বলেন, এই অপতৎরতা রোধে বন বিভাগের কার্যকর পদক্ষেপ নেই।

 
বনদস্যুদের দাপট:  র‌্যাব, কোস্টগার্ড ও পুলিশের লাগাতার অভিযানের মধ্যেও থেমে নেই সুন্দরবনের বনদস্যুদের তৎপরতা। একটি বনদস্যু বাহিনীপ্রধান নিহত হচ্ছে তো আরেকটি বাহিনী গড়ে উঠছে। প্রলোভন দিয়ে, কখনও জিম্মি করে জেলে-বাওয়ালিদের দলে ভেড়াচ্ছে বনদস্যুরা। অবৈধ অস্ত্রের পাশাপাশি লাইসেন্স করা অস্ত্র ভাড়া নিয়ে বর্তমানে ১০-১২টি বনদস্যু বাহিনী জেলে-বাওয়ালিদের কাছ থেকে চাঁদা আদায়, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়, গাছ পাচার এমনকি বন্যপ্রাণী শিকার করছে।

 
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:  বিশ্বব্যাংকের ২০১৫ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সুন্দরবনের মধ্যে নদীগুলোর পানির উচ্চতা বাড়ছে বছরে ৩ থেকে ৮ মিলিমিটার। ফলে জোয়ারের সময় বনভূমি ডুবে সংকুচিত হচ্ছে বন্যপ্রাণীর বিচরণক্ষেত্র। এ ছাড়া বেড়েই চলেছে নদীর পানির লবণাক্ততার পরিমাণ ও এর বিস্তার। সে কারণে বাড়ছে সুন্দরী গাছের আগামরা রোগ। বিভিন্ন স্থানে গাছের প্রজাতিতে ঘটছে আমূল পরিবর্তন।

 
সুন্দরবন থেকে এর আগে বিলুপ্ত হয়েছে গন্ডার, বনমহিষ, মিঠা পানির কুমির, এক প্রজাতির হরিণ, চিতাবাঘ ও ৪ প্রজাতির পাখি। হারিয়ে যাচ্ছে ১৯ প্রকারের মাছ। সুন্দরবনের গাছে গাছে আগের মতো দেখা যায় না বানর এবং বিভিন্ন প্রজাতির পাখি। কমে গেছে মৌচাকও।

 
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. আবদুল্লাহ হারুন চৌধুরী বলেন, সুন্দরবনের মাটি ও পানিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধির কারণে সাতক্ষীরা রেঞ্জে সুন্দরী গাছের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুন্দরবন রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক অধ্যাপক ড. সরদার শফিকুল ইসলাম বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সিডর ও আইলার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে গাছপালা ও বন্যপ্রাণী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। অতিরিক্ত লবণাক্ত পানি পান করে রোগাক্রান্ত হচ্ছে বাঘসহ বন্যপ্রাণী।

 
সুন্দরবনের কুমির সমীক্ষা প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়োজিত বেসরকারি সংস্থা ক্যারিনামের প্রকল্প সমন্বয়কারী আবদুল ওহাব আকন্দ বলেন, লবণাক্ততা বৃদ্ধির ফলে কুমিরের প্রজননে বিরূপ প্রভাব পড়ছে।

 
সক্ষমতা নেই বন বিভাগের: সুন্দরবনের বন্যপ্রাণী, বনজ ও জলজ সম্পদ রক্ষার সক্ষমতা নেই বন বিভাগের। জনবল, জলযান আর অস্ত্র সংকটের কারণে বনের বিশাল এলাকা পাহারা দিতে রীতিমতো হিমশিম খেতে হয় বন বিভাগকে। বনে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে তাদের নির্ভর করতে হয় কোস্টগার্ড, র‌্যাব ও পুলিশের ওপর। সুন্দরবন পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগে ১ হাজার ১৭৩টি পদের মধ্যে শূন্য রয়েছে ২৬৭টি। ১৩৫টি জলযানের মধ্যে স্পিডবোটের সংখ্যা মাত্র ৩০টি। ১০০টি ট্রলার থাকলেও চলে ধীরগতিতে। রয়েছে অস্ত্র সংকটও। প্রশিক্ষিত জনবলের অভাবে সেভাবে বনস্যুদের মোকাবেলা করতে পারছেন না বন বিভাগের কর্মীরা।

 
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক জহির উদ্দিন আহমেদ জনবল সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, কিছুদিন আগে বাঘ ও হরিণের বেশ কিছু চামড়া উদ্ধারের পর সুন্দরবনে টহল জোরদার করা হয়েছে। এ ছাড়া বনদস্যুদের গ্রেফতারের জন্য বন বিভাগ, র‌্যাব, পুলিশ ও কোস্টগার্ড যৌথভাবে অভিযান চালাচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *