কক্সবাজার: জেলার টেকনাফ সৈকতে আড়াই কিলোমিটার ঝাউবাগান থেকে গত এক মাসে প্রায় অর্ধলাখ গাছ কেটে উজাড় করে দিয়েছে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। চক্রটির নেপথ্যের ব্যক্তিদের নাম প্রকাশ না করলেও স্থানীয়দের অভিযোগ বনকর্মকর্তাদের যোগসাজশে চলে এ বৃক্ষ নিধন।
কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিনড্রাইভ সড়কের শামলাপুর ও শীলখালী সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকায় গিয়ে দেখা যায় এ দৃশ্য। সড়কের পশ্চিমে সমুদ্র সৈকতের পাশের দুটি সারি এবং সড়কের পূর্ব পাশের দুইটি সারির গাছ দেখে বুঝা যায়না আসল দৃশ্য। ভেতরে প্রবেশ করলে আড়াই কিলোমিটার এলাকা জুড়ে দেখা যায় কাটা গাছের গোঁড়ালিই যেন এ ভয়াবহতার স্বাক্ষী।
কক্সবাজার উপকূলীয় বনবিভাগ সূত্র জানায়, ২০০৬-০৭ সালে উপকূলীয় জনগণের সম্পদ রক্ষা ও সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে টেকনাফের বাহারছড়ার জাহাজপুরা থেকে শামলাপুর পর্যন্ত ১০০ হেক্টর সৈকতে তিনটি বাগানে পাঁচ লাখ ঝাউগাছ লাগানো হয়। ঘূর্ণিঝড়-জলোচ্ছ্বাসে এ বাগানের গাছগুলো দেয়াল হিসেবে উপকূলীয় এলাকাকে রক্ষা করে। এর মধ্যে শামলাপুরে দেড় কিলোমিটার ঝাউবাগানে মিয়ানমার থেকে অবৈধভাবে আসা প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গা পরিবারের ৩৫ হাজার মানুষ দখল করে বসবাস করে আসছিল। গত ২০১৫ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও বনবিভাগের কর্মীদের সহযোগিতায় উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট জাহিদ ইকবালের নেতৃত্বে অবৈধ বসবাসকারী ঝুঁপড়ি ঘর উচ্ছেদ করা হয়। কিন্তু ওখানেই চলছে ঝাউগাছ কাটার উৎসব। গত এক মাসে ৫০ হাজারের বেশি গাছ কেটে নেয়া হয়েছে।
সরেজমিনে বাহারছড়ার শামলাপুরে মনখালী খালের দক্ষিণ ও শীলখালী এলাকার সৈকতে ঝাউবাগান উজাড়ের ভয়াবহতা দেখা যায়। ঝাউবাগানের যতদূর দেখা গেছে সারি বদ্ধ গাছের বেশ কিছু দূর পর পর ফাঁকা আর কাটা গাছের গোঁড়ালি। এসব বাগানের কিছু কিছু জায়গায় কাটা গাছের গোঁড়ালি দেখা গেলেও অনেক স্থানে তা আবার বালি দিয়ে ডেকে রাখা হয়েছে।
এ সময় বন কর্মকর্তা ও পাহারাদারের দেখা পাওয়া যায়নি। তবে দেখা মিলেছে কিছু সহেন্দভাজন লোকজনের। এসব লোকজন ক্যামেরা হাতে সংবাদ কর্মীর উপস্থিতি দেখে দ্রুত পালিয়ে গেছে।
কেটে নেওয়া গাছের ডালপালা সংগ্রহ করতে কিশোরী ও নারীর একটি দলের সাথে দেখা হয়। কথা হয় রোখসানা নামের এক নারীর সাথে। তিনি জানান, কিছু লোক দিন দুপুরে বা রাতে গাছ কেটে নিয়ে যায়। কিন্তু তাদের কেউ বাধা দিচ্ছে না। কেটে রেখে যাওয়া ডাল পালা জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তিনি সংগ্রহ করতে এসেছেন বলে জানান।
স্থানীয় সূত্র জানান, বনকর্মীর লোক পরিচয় দিয়ে মুন্সি নামে এক ব্যক্তি প্রতিটি গাছের জন্য ৫০ থেকে ৮০ টাকা করে সংগ্রহ করে এসব গাছ কাটার সুযোগ করে দিচ্ছে। একটি প্রভাবশালী চক্র জমি দখলের উদ্দেশ্যে এ গাছ শ্রমিক নিয়োগ করে কাটা শুরু করেছে।
স্থানীয় নুরুল আমিন জানান, পার্শ্ববর্তী গ্রামে ঘরে ঘরে এখন এসব ঝাউগাছ। বন বিভাগের লোকজন যেন কিছু দেখছেন না।
বাহারছড়া ইউপির চেয়ারম্যান হাবিব উল্লাহ জানান, স্থানীয় বনবিভাগের গাফলতির কারণে প্রকাশ্যে দিবালোকে গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এ এলাকার তিনটি বাগানে পাঁচ লাখের মতো ঝাউগাছ ছিল। গত এক মাসে অর্ধলাখের বেশি গাছ কেটে নিয়ে গেছে।
উপকূলীয় বনবিভাগের স্থানীয় বিটের কর্মকর্তা আবুল বশর জানান, গাছ কাটার বিষয়টি তিনি জানেন। এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিচ্ছেন। কিন্তু জনবল সঙ্কটের কারণে তিনি গাছ কাটা বন্ধ করতে পারছেন না। মাদকাসক্ত কিছু লোক এসব গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছেন বলে জানিয়ে টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেন।
কক্সবাজার উপকূলীয় বন বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক মো. কবির জানান, গত এক মাসের মধ্যে তিনি ওই এলাকা পরিদর্শন করেননি। স্থানীয় বিট অফিসার এবং রেঞ্জারও গাছ কাটার বিষয়টি তাকে জানাননি। শীলখালীতে তাদের আওতাধীন এক কিলোমিটার বনায়ন রয়েছে। বাকিটা কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগের আওতাধীন।
কক্সবাজার দক্ষিণ বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, ‘টেকনাফের শামলাপুর ও শীলখালীতে কিছু গাছ কাটার খবর পেয়েছি। সহকারী বন সংরক্ষককে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে রিপোর্ট দিতে বলেছি। রিপোর্ট পাওয়া গেলে দায়ী কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
প্রসঙ্গত, টেকনাফে ঝাউ গাছ কাটার এটি প্রথম ঘটনা নয়। এর আগেও ২০১১ সালে টেকনাফের খুরের মুখ এলাকায় কাটা হয়েছিল ঝাউ বনের ৩০ হাজার গাছ। এ ঘটনা মিডিয়ায় প্রচারিত হলে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ৮৭ জনের নামে মামলা করেছিল বন বিভাগ। কিন্তু ওই মামলার অগ্রগতি তেমন হয়নি। মামলার আসামিরা সবাই প্রভাবশালী হওয়ায় আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে গেছেন।