ঢাকা : সর্বংসহা রওশন এরশাদ। স্বামী একের পর এক নারী ঘটিত কেলেঙ্কারিতে জড়িয়েছেন কিন্তু এ নিয়ে কখনো টু-শব্দটিও করেননি। প্রায় পাঁচ দশকের এ দাম্পত্য জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তিক্ততায় ভরা। সন্তান-সন্ততি না হওয়ায় এরশাদেরও কোনো পিছুটান নেই। দিনের পর দিন স্বামীর অবহেলা আর উপক্ষোর শিকার হয়ে অবশেষে ক্ষমতার চর্চাকেই বেছে নিয়ে শান্তি খুঁজেছেন তিনি। ফলে এক ছাদের নিচে থাকা না হলেও রাজনৈতিক স্বার্থেই সম্পর্কটা কখনো কখনো আপাত মধুরতায় ভরে গেছে। এরশাদও তাতে আপত্তি করেননি কখনো।
সম্প্রতি এই দুইজন প্রায়ই শিরোনাম হচ্ছেন। চলছে তাদের মান-অভিমান পর্ব। কখনো এরশাদ অভিমান করেন স্ত্রীর উপর, কখনো স্বামীর প্রতি স্ত্রী। কখনো কখনো দুইজনের মধ্যে কথাবার্তা এবং মুখ দেখা দেখি বন্ধ। কখনো রওশন বলেন, কর্মীদের চাঙা রাখার জন্য তার স্বামী নানা কথা বলেন। আবার স্ত্রীর রাজনৈতিক ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন স্বামী।
এক সঙ্গে থাকেন না অনেক দিন। দূরত্ব মাত্র দুই কিলোমিটার। এরশাদ থাকেন বারিধারার প্রেসিডেন্ট পার্কে। অপরদিকে রওশন এরশাদ থাকেন গুলশানে। কেউ কারো বাড়ি খোঁচেন না। শুধু বাসাই নয়, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা হিসেবে রওশন এরশাদের অফিস তিন তলায়। এর নিচেই রয়েছে এইচএম এরশাদের অফিস। এখানে দূরত্ব মাত্র কয়েকটি সিঁড়ি। এখানেও একজন অন্যজনের অফিসে আসেন না।
জাতীয় পার্টিতে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং রওশন এরশাদের নেতৃত্বে দুটি ভাগ হয়েছিল একএগারোর সময়। পরে অবশ্য এ দুটি অংশই এরশাদের নেতৃত্বে এক হয়ে যায়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে যাওয়া না যাওয়া নিয়ে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যে জাতীয় পার্টিতে এরশাদ ও রওশনকে কেন্দ্র করে দলে আবার দুটি শিবির তৈরি হয়। স্বামী যখন সিএমএইচে, তখন দলের একাংশ নিয়ে নির্বাচনে চলে যান রওশন। ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের পর মুক্তি মিলে এরশাদের। সংসদের বিরোধী দলের নেতা হন রওশন। তবে এরশাদের প্রাপ্তির খাতাও একেবারে শূন্য থাকেনি। প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূতের পদটি পেয়েছেন তিনি।
গত ১৭ জানুয়ারির পর থেকে দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য চলে আসে। এটার মূল কারণ, ওই দিন রংপুরে জাতীয় পার্টির কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য সাবেক মন্ত্রী জিএম কাদেরকে দলের কো-চেয়ারম্যান ঘোষণা দেন এরশাদ। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে পরদিন ১৮ জানুয়ারি রওশন এরশাদকে দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন ঘোষণা করে দলের রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত একাংশ। এর পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ জানুয়ারি রাজধানীর বনানীস্থ পার্টির চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন করে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ বলেন, ‘আনিস-বাবলু আমার সংসারে বিরোধী সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। আমাদের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।’
এরশাদ বলেন, ‘রওশন ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান হননি। হতে পারেন না। এগুলো রওশনের বক্তব্য না। বাবলু ঘোষণা দেয়ার কে? আমাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে কোনো বিরোধ নেই। উনি বিরোধী দলীয় নেত্রী। উনি সংসদে পার্টির ভূমিকা পালন করেন। আমি দল পরিচালনা করি।’
গত শনিবার পার্টির প্রসিডিয়াম সভা চলাকালে এক প্রেসিডিয়ামের পার্টির চেয়ারম্যানকে রওশন এরশাদের সঙ্গে দূরত্ব কমাতে পরামর্শ দেন। এর জবাবে এরশাদ বলেন, ‘আমার সঙ্গে তার কোনো দূরত্ব নেই। আমি প্রতেক্যকটা কাজ রওশনকে জানিয়ে করি। সে আমার সঙ্গে মাঝে মাঝে অভিমান করে! এটা সাময়িক।‘
এরপর গত বৃহস্পতিবার দুপুর। রাজধানীর গুলশানে ইমানুয়েলস কনভেনশন সেন্টারে জাতীয় পার্টির কো-চেয়ারম্যান জিএম কাদের ও মহাসচিব এবিএম রুহুল আমিন হাওলাদারের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে যোগ দেন দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। বক্তব্যের শুরুতেই এইচএম এরশাদ বলেন, ‘তোমাদের একটা কথা বলি, একটু আগে রওশন ফোন করেছিলেন। আমাকে বললেন– তুমি কোথায়? আমি বললাম- আমার ভাইয়ের সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে আছি। তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন- আমাকে নিলে না কেন? আমি বললাম- এখানে তো আমারো আসার কথা ছিল না, অনেকটা হঠাৎ করেই এসে পড়েছি।’
এর আগে গত বছর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে ফুল দিতে গিয়ে নিজের স্ত্রীর বাধার মুখে পড়েছিলেন এরশাদ। রাষ্ট্রীয় প্রটোকল লঙ্ঘন করে বিরোধী দলীয় নেতার আগে এরশাদ জাপার পক্ষে ফুল দিতে গেলে এই ঘটনা ঘটে। এনিয়ে শহীদ মিনারে রওশনের ওপর এরশাদের অভিমান!
তবে জাতীয় পার্টির নেতারা বলেছেন, দু’জনের মধ্যকার সম্পর্কে কোনো সমস্যা নেই। এটা অভিমান। রাজনীতি করতে গেলে এমন হওয়াটা স্বাভাবিক।
তবে জাতীয় পার্টির এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, পার্টির মধ্যে একটি চক্র নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে দীর্ঘদিন ধরে দলের স্যারের (চেয়ারম্যান) পরিবারের মধ্যে সবসময়ে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা লিপ্ত। এখনও তারা ব্যর্থ চেষ্টা চালাচ্ছেন। ওই চক্রটি মূলত পরিবারের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করে তারা ফায়দা লুটছেন।
তবে যাই হোক, নিঃসন্তান এরশাদ কিন্তু স্ত্রীর প্রতি যথেষ্ট অন্যায় অবিচার করেছেন। রওশন ময়মনসিংহের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান। পছন্দ করে তাকে বিয়ে করে এনে তিনি আর রওশনকে মর্যাদা দেননি। ছুটে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন নারীর কাছে। বিশেষ করে রাষ্ট্রপতি থাকাকালীন বহু নারী শয্যাসঙ্গীর হওয়ার মুখরোচক গল্প সবার মুখে মুখে। এই তালিকায় নাম এসেছে : জিনাত মোশাররফ, মিতা, সাথী আরো অনেকে। সর্বশেষ বিদিশা নামে এক নারীকে তিনি বিয়ে করেছিলেন, তাদের ঘরে একটি সন্তানও আছে। কিন্তু তৎকালীন চারদলীয় জোটের সঙ্গে আঁতাত করার ছুতোয় এরশাদ তাকে তালাক দেন। এ নিয়ে বিদিশার ক্ষোভের শেষ নেই!