মিরপুর থেকে: নেপালের ছুঁড়ে দেওয়া ২১২ রানের টার্গেটে ব্যাটিংয়ে নেমে স্বাগতিক বাংলাদেশ ৬ উইকেটের জয় তুলে নিয়েছে। সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করা মেহেদি হাসান মিরাজের দল এ ম্যাচ জিতে ইতিহাস স্পর্শ করেছেন। এই প্রথমবারের মতো যুব বিশ্বকাপের সেমিতে খেলবে টাইগাররা।
টাইগার যুবারা দুর্দান্ত ফিল্ডিংয়ের পরিচয় দেওয়ার পর ব্যাটিংয়ে নিজেদের সেরাটা দেখিয়েছেন। স্বাগতিকরা ফিল্ডিংয়ে প্রতিপক্ষের চার ব্যাটসম্যানকে বিদায় করে রানআউট করে। নির্ধারিত ৫০ ওভারে ৯ উইকেট হারিয়ে নেপালিরা ২১১ রান সংগ্রহ করে। জবাবে ১০ বল হাতে রেখেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় টাইগার যুবারা। ব্যাটিংয়ে দারুণ পারফর্ম করেন মেহেদি হাসান মিরাজ, জয়রাজ শেখ আর পিনাক ঘোষ। তবে, দলের জয়ে বিশেষ অবদান রাখেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান জাকির হাসান।
যুব বিশ্বকাপের মেগা ইভেন্টে এর আগে বাংলাদেশ তিনবার কোয়ার্টার ফাইনালে খেলেছে। তিনবারই ছিটকে পড়তে হয় টাইগার যুবাদের। এবারে ফেভারিটের তকমা লাগিয়েই মিশন শুরু করে স্বাগতিকরা। ঘরের মাঠের বিশ্বকাপকে নিজেদের কাছে রেখে দিতেই দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নাজমুল হোসেন শান্ত, সাইফ হাসান, আরিফুল ইসলাম, পিনাক ঘোষ, সালেহ আহমেদ শাওন, সাঈদ সরকাররা।
গ্রুপপর্বে চ্যাম্পিয়ন হয়েই টাইগার যুবারা কোয়ার্টারে উঠে। নিজেদের প্রথম ম্যাচে তারা হারায় ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন দক্ষিণ আফ্রিকাকে। পরের ম্যাচে স্কটল্যান্ড আর নিজেদের শেষ ম্যাচে নামিবিয়াকে উড়িয়ে দেয় মিজানুর রহমানের ছাত্ররা।
আর আগে একবারই দুইদল মুখোমুখি হয়েছিল বিশ্বমঞ্চে। ২০০২ বিশ্বকাপের আসরে প্লেট সেমিফাইনালে বাংলাদেশকে নেতৃত্ব দেওয়া নাফিস ইকবালের দলকে হারতে হয় ২৩ রানে। তবে, এবার একেবারেই ভিন্ন গল্প রচনা করলো টাইগার যুবারা।
আজকের ম্যাচে জিতে দারুণ একটি মাইলফলক স্পর্শ করলো মেহেদি হাসান মিরাজের দল। শ্রীলঙ্কায় অনুষ্ঠিত ২০০৬ সালের যুব বিশ্বকাপে মুশফিকুর রহিমের নেতৃত্বে বাংলাদেশ পঞ্চম হয়েছিল। সেটিই ছিল টাইগার যুবাদের সেরা সাফল্য।
চলতি যুব বিশ্বকাপের সেমিফাইনালের টিকিট নিশ্চিত করতে শুক্রবার (০৫ ফেব্রুয়ারি) নেপালের যুবাদের বিপক্ষে মিরপুর শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়ামে সকাল নয়টায় ফিল্ডিংয়ে নামে বাংলাদেশ অনূর্ধ্ব-১৯ দল। কোয়ার্টার ফাইনালের এ ম্যাচে টস জিতে আগে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেন নেপাল দলপতি রাজু রিজাল।
নেপালের ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন বোল্ড করে ফিরিয়ে দেন দলটির ওপেনার সন্দীপকে (৭)। ৬ বলের ব্যবধানে নেপালের দুই ব্যাটসম্যানকে ফিরিয়ে দিয়ে শুরুতেই আঘাত হানে বাংলাদেশ। পরের ওভারে বোলিং আক্রমণে এসে মেহেদি হাসান রানা ফিরিয়ে দেন যোগেন্দ্র কারকিকে (১)। রানার দুর্দান্ত বাউন্সারে দিশেহারা হয়ে কারকি ক্যাচ তুলে দেন সাইফ হাসানের হাতে। দলীয় ১৯ রানের মাথায় দুই উইকেট হারায় নেপাল।
এরপর উইকেটে জুটি বাঁধেন নেপালের দলপতি রাজু রিজাল আর ওপেনার সুনীল ধামালা। দুশ্চিন্তা বাড়াতে থাকা তৃতীয় উইকেট জুটিটি বাংলাদেশ ভেঙেছে দুর্দান্ত এক রান আউটের মাধ্যমে। ৪৪ রানের জুটি গড়ে বিদায় নেন ধামালা। দুই ব্যাটসম্যানের ভুল বোঝাবুঝিতে রানআউট হন সেট ব্যাটসম্যান ধামালা। রানআউট হওয়ার আগে তিনি ৬২ বলে দুটি চারে ২৫ রান করেন।
দলীয় ৬৩ রানের মাথায় টপঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান ফিরলেও দলকে টেনে নিয়ে চলেন নেপালের অধিনায়ক রাজু রিজাল। তাকে সঙ্গ দিতে থাকেন আরিফ শেখ। ইনিংসের ২৮তম ওভারে ৫১ রানের এই জুটি ভাঙেন মোহাম্মদ সাইফুদ্দিন। ডিপ মিডউইকেটে তুলে মারতে গিয়ে জয়রাজ শেখের অসাধারণ আর দৃষ্টিনন্দন এক ক্যাচে সাজঘরের পথ ধরেন আরিফ। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ২১ রান। ৩২ বলে দুটি চারের সাহায্যে তিনি এ রান করেন।
৩৪তম ওভারে বয়স নিয়ে বিভ্রান্ত ছড়ানো নেপালের দলপতি রাজু রিজালকে ফিরিয়ে দেয় টাইগার যুবারা। রানআউট হয়ে ফেরার আগে তিনি ৮০ বলে ৭২ রান করেন। নিজের ভুলে উইকেট বিলিয়ে সাজঘরের পথ ধরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ৮টি চার আর একটি ছক্কা।
ইনিংসের ৩৭তম ওভারে টপঅর্ডারের ষষ্ঠ ব্যাটসম্যানকে হারায় নেপাল। বিদায় নেন সালেহ আহমেদ শাওনের বলে এলবির ফাঁদে পড়া রাজবির সিং (৯)। শাওনকে সুইপ করতে গিয়ে এলবির ফাঁদে পড়েন তিনি। দলীয় ১৫৩ রানে নেপালের ষষ্ঠ উইকেটের পতন ঘটে। ইনিংসের ৪৩তম ওভারে আরেকটি রানআউটের ফাঁদে পড়ে বিদায় নেন কুশল ভুরতাল (১৪)। পিনাক ঘোষ আর মেহেদি হাসান মিরাজের দারুণ ফিল্ডিংয়ে রানআউট হন তিনি।
৪৯তম ওভারে আক্রমণে এসে মিরাজ বোল্ড করেন ২২ রান করা দীপেন্দ্র সিংকে। ইনিংসের শেষ বলে রানআউট হন সুশীল কান্দাল। ২৪ বলে ২২ রান করে অপরাজিত থাকেন প্রেম তামাং।
টাইগার বোলারদের মধ্যে একটি করে উইকেট পেয়েছেন সালেহ আহমেদ শাওন, মেহেদি রানা ও মেহেদি হাসান মিরাজ। আর সাইফুদ্দিন পেয়েছেন দুটি উইকেট।
স্বাগতিক যুবাদের হয়ে ব্যাটিং উদ্বোধন করতে নামেন পিনাক ঘোষ ও সাইফ হাসান। ইনিংসের সপ্তম ওভারে বাংলাদেশ ব্যাটিংয়ে আঘাত হানেন ধামালা। টাইগার ওপেনার সাইফ হাসানকে এলবির ফাঁদে ফেলেন তিনি। বিদায়ের আগে সাইফের ব্যাট থেকে ৫ রান আসে।
ওপেনার সাইফ হাসান ফিরে গেলেও জুটি বাঁধেন পিনাক ঘোষ ও জয়রাজ শেখ। তবে, ইনিংসের ২০তম ওভারে ডাবল রান নিতে গিয়ে নিজেদের ভুল বোঝাবুঝিতে রান আউট হয়ে ফেরেন পিনাক ঘোষ। তিনি বিদায় নেওয়ার আগে জয়রাজের সঙ্গে ৪৬ রান যোগ করেন স্কোরবোর্ডে। পিনাকের ব্যাট থেকে আসে ৩২ রান। ৫৪ বলে সাজানো তার ইনিংসে ছিল দুটি বাউন্ডারি।
দুই ওপেনার সাইফ হাসান ও পিনাক ঘোষ ফিরে গেলে তাদের পথ ধরেন নতুন আসা ইনফর্ম ব্যাটসম্যান নাজমুল হোসেন শান্ত। ২৩তম ওভারে প্রেম তামাংয়ের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফেরেন ৬ বলে ৮ রান করা শান্ত।
দলীয় ৭৫ রানে স্বাগতিকদের টপঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যান বিদায় নেন। উইকেটে সেট ব্যাটসম্যান জয়রাজের সঙ্গে জুটি বাঁধেন মেহেদি হাসান মিরাজ। এ জুটি থেকে আসে আরও ২৩ রান। ধামালার বলে ইনিংসের ২৯তম ওভারে এলবির ফাঁদে পড়েন ৬৭ বলে চারটি চারে ৩৮ রান করা জয়রাজ।
৬৭ বলে নিজের অর্ধশতক পূর্ণ করেন জাকির হাসান। আর ৫৯ বলে অর্ধশতকের দেখা পান টাইগার দলপতি মেহেদি হাসান মিরাজ।
দলীয় ৯৮ রানে টাইগাররা টপঅর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে হারায়। পিনাক ঘোষ, সাইফ হাসান, জয়রাজ শেখ আর নাজমুল হোসেন শান্ত ফিরে গেলেও টাইগারদের রানের চাকা ঘোরান জাকির হাসান ও দলপতি মিরাজ। স্নায়ু চাপ কাটিয়ে ১১৭ রানের অবিচ্ছিন্ন জুটি গড়ে দলকে জয়ের পথে নেন তারা।
মিরাজ ৬৫ বলে তিনটি বাউন্ডারিতে ৫৫ রান করে অপরাজিত থাকেন। আর ৭৭ বলে ৫টি চার ও একটি ছক্কায় ৭৫ রান করে অপরাজিত থাকেন উইকেটরক্ষক ব্যাটসম্যান জাকির হাসান। জয়ের পথে দলকে নিয়ে যাওয়া জাকির তার একমাত্র ছক্কাটি মেরে বাংলাদেশকে জয় পাইয়ে দেন।
ম্যাচ সেরার পুরস্কার উঠে মেহেদি হাসান মিরাজের হাতে।