ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী বাছাই নিয়ে আওয়ামী লীগে নতুন করে দুশ্চিন্তা বেড়েছে। তৃণমূল পর্যায়ের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের অনেকেই প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখানোর পর সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে।
গত শনিবার প্রধানমন্ত্রী ও দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে আওয়ামী লীগের কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে এ নিয়ে আলোচনা হয়। এ অবস্থায় তৃণমূল পর্যায়ের মনোনয়ন বোর্ডের কাঠামোতে কিছুটা পরিবর্তন আনারও চিন্তাভাবনা করা হচ্ছে।
শনিবারের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ডা. দীপু মনি, সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, কৃষি ও সমবায়বিষয়ক সম্পাদক ড. আবদুর রাজ্জাক, দপ্তর সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খান, কার্যনির্বাহী সদস্য সুজিত রায় নন্দী ও এস এম কামাল হোসেন উপস্থিত ছিলেন।
এই নেতাদের তিনজন সঙ্গে আলাপকালে বলেছেন, বেশির ভাগ ইউনিয়নেই কমপক্ষে দু’জন করে শক্তিশালী চেয়ারম্যান প্রার্থী রয়েছেন। যেসব ইউনিয়নে বিএনপির প্রার্থী নেই, সেখানকার চিত্র আরও বিব্রতকর। ওই সব ইউনিয়নে গড়পড়তা পাঁচ থেকে সাতজন করে প্রার্থী দলের মনোনয়ন চাইছেন। সেইসঙ্গে অনেক ইউনিয়নে উপজেলা ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরাও আগ্রহ দেখাচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, ইউপি চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করবে জেলা, উপজেলা এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের সমন্বয়ে গড়া তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ড। এই মনোনয়ন বোর্ড প্রার্থী বাছাইয়ে সংকটে পড়লে কেন্দ্রীয়ভাবে সমাধান করা হবে। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় পর্যায় থেকেই সংকটে থাকা ইউনিয়নের প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়া হবে। স্থানীয় এমপিদের মনোনয়ন এই বোর্ডে রাখা হয়নি।
শনিবারের অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় মূলত তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের ইউপি নির্বাচনে অংশগ্রহণের আগ্রহের বিষয়টি স্থান পেয়েছে। ইউনিয়ন পর্যায়ের চিত্র তুলে ধরে নেতাদের অনেকেই বলেছেন, ইউনিয়ন পরিষদে দলীয় মনোনয়নে নতুন নির্বাচন হচ্ছে। তাই দলীয়ভাবে অভিজ্ঞতাও নতুন। সেইসঙ্গে বেশির ভাগ ইউনিয়নে একাধিক যোগ্য ও দক্ষ প্রার্থী থাকায় সংকট প্রকট রূপ নিয়েছে।
এ অবস্থায় উপজেলা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের অনেকেই প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখানোর পর থেকে বাড়তি বিড়ম্বনা তৈরি হয়েছে। তারা সবাই তৃণমূল মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য। এ ক্ষেত্রে নিজেরাই মনোনয়ন চাইলে প্রার্থী বাছাইয়ের নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। তা ছাড়া মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হলেও অনেক জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের পক্ষে ইউনিয়ন পর্যায়ের সম্ভাব্য প্রার্থীদের যাচাই করাটা দুরূহ।
এ কারণে নেতারা মনে করছেন, কোনো ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নিজেই প্রার্থী হতে চাইলে ওই ইউনিয়নের মনোনয়ন বোর্ডে নতুন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। তখন সভাপতির বিকল্প হিসেবে সিনিয়র সহসভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকের বিকল্প হিসেবে এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হতে পারেন। নেতারা এ প্রস্তাব দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ বৈঠকের দিনক্ষণ এখনও নির্ধারণ করা হয়নি।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে খুলনা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বি এম মোজাম্মেল হক জানিয়েছেন, অনেক উপজেলা ও ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক প্রার্থী হতে চাইছেন। তারা মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য হওয়ায় এ নিয়ে এক ধরনের সমস্যা তৈরি হবে। এ সমস্যা নিরসনের প্রক্রিয়া নিয়ে আলোচনা চলছে।
বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, ইউনিয়ন শাখার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা প্রার্থী হতে চাইলে সংশ্লিষ্ট মনোনয়ন বোর্ডে বিকল্প সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সিনিয়র সহসভাপতি ও এক নম্বর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য করা যেতে পারে।
এই প্রস্তাবনা নিয়ে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার সঙ্গে কথা বলবেন আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম। তিনি জানিয়েছেন, প্রতিটি ইউনিয়নে একাধিক যোগ্য প্রার্থী থাকায় কিছুটা ঝামেলা তৈরি হয়েছে। এর সমাধানও হবে। এরই মধ্যে তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ডে বিকল্প সদস্য অন্তর্ভুক্তি নিয়ে একটা অভিমত তৈরি হয়েছে। এই অভিমত কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে উপস্থাপনের প্রস্তুতি রয়েছে।
রাজশাহী বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেছেন, আওয়ামী লীগ বড় রাজনৈতিক দল। এই দলে প্রার্থিতা নিয়ে সংকট থাকবেই। তবে সংকট নিরসন করে একক প্রার্থী দেওয়া হবে। তিনি জানিয়েছেন, তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ড নিয়ে কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আলোচনা হবে। প্রয়োজনে কিছুটা রদবদলও হতে পারে।
অবশ্য এ ক্ষেত্রে কোনো সংকট দেখছেন না ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন। তিনি বলেছেন, মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা প্রার্থী হলে কোনো ক্ষতি নেই। তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ড একক প্রার্থী নির্ধারণ করবে। তারা ব্যর্থ হলে সব প্রার্থীর তালিকা কেন্দ্রে পাঠাবে। পরে কেন্দ্র চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।
প্রায় একই কথা বলেছেন রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী। তার ভাষায়, একাধিক প্রার্থী থাকায় এক ধরনের জটিলতা তৈরি হয়েছে। তবে তৃণমূলের মনোনয়ন বোর্ড এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবে। এর পরও প্রার্থী বাছাইয়ে আপত্তি কিংবা কোনো ধরনের সীমাবদ্ধতা তৈরি হলে কেন্দ্রীয়ভাবে সমাধান দেওয়া হবে।