ঢাকা: বাংলাদেশ থেকে হালাল পোল্ট্রি মাংস রপ্তানির অপার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। ২০১৭ সাল থেকে মাংস রপ্তানির জন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছে পোল্ট্রি শিল্প সংশ্লিষ্টরা।
এরমাধ্যমে অর্জিত হবে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা। সমৃদ্ধ হবে জাতীয় অর্থনীতি। তবে এ মাংস রপ্তানির ক্ষেত্রে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে হালাল এবং কোয়ালিটি সনদপত্র।
চলতি অর্থবছর ‘করছাড়’ অপসারণ, কাঁচামাল আমদানিতে নতুন শুল্কারোপ, অগ্রিম আয়কর, পোল্ট্রি আয়ের ওপর নতুন করারোপ করায় উদ্যোক্তারা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছেন।
আগামী ছয়মাসের মধ্যে সনদপত্র সংগ্রহ, করছাড় এবং সরকারি সহায়তা পেলে ২০১৭ সাল থেকে রপ্তানি শুরু সম্ভব হবে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পোল্ট্রি শিল্প সমন্বয় কমিটি (বিপিআইসিসি) এর আহ্বায়ক মসিউর রহমান।
তিনি জানান, বাংলাদেশ ২০১৫ সাল থেকে বার্ড ফ্লু মুক্ত হয়েছে। ওয়ার্ল্ড অরগানাইজেশন ফর অ্যানিমেল হেলথ (ওআইই) এর নিয়মানুয়ী নতুন করে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জার প্রাদুর্ভাব না ঘটলে ২০১৯ সাল থেকে একদিন বয়সী বাচ্চা, পোল্ট্রি ফিড, মাংস কিংবা ডিম রপ্তানির ক্ষেত্রে আর কোন বাধা থাকবে না। তবে ওআইই এর অনুমতি পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারকে উদ্যোগী হতে হবে।
বিপিআইসিসি সূত্র জানায়, বাংলাদেশে মাংসের মোট চাহিদার ৫০ শতাংশের বেশি যোগান দিচ্ছে পোল্ট্রি মাংস। পোল্ট্রি মাংসের চাহিদা এবং উৎপাদন যে হারে বাড়ছে তাতে শীঘ্রই পোল্ট্রি মাংস ভোক্তার পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করবে।
বাংলাদেশে বর্তমানে প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার ৮৮০ মেট্রিক টন অর্থাৎ বছরে প্রায় ৬ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন মুরগির মাংস উৎপাদিত হচ্ছে। জনপ্রতি বছরে মাংস খাওয়ার পরিমাণ ৩.৯৯ কেজি।
দেশিয় পোল্ট্রি মাংসের উৎপাদন দিন দিন বাড়ছে। আগের সনাতনী পদ্ধতির চেয়ে বর্তমানে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিকে কাজে লাগিয়ে উৎপাদিত হচ্ছে মানসম্মত পোল্ট্রি মাংস।
সূত্র আরো জানায়, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলোতে হালাল মুরগির মাংসের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তাছাড়া বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিশেষ করে মুসলিম কমিউনিটিতে হালাল মাংসের চাহিদা আছে।
ইতোমধ্যে সেসব কমিউনিটি থেকে রপ্তানি শুরু করার জন্য অনুরোধ করেছে। চাহিদার এ সুযোগকে কাজে লাগাতে উদ্যোগী হয়েছে বেসরকারি পর্যায়ের পোল্ট্রি উদ্যোক্তারা।
হালাল সনদ, কোয়ালিটি সনদ ছাড়াও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশে রপ্তানির ক্ষেত্রে আলাদা সনদপত্র নিতে হবে। সেক্ষেত্রে সরকারি সহায়তা খুবই প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, দেশের খামারগুলো বর্তমানের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি উৎপাদনে সক্ষম। রপ্তানি বাজার উন্মুক্ত হলে দেশিয় চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করার মত যথেষ্ট সক্ষমতা রয়েছে।
রপ্তানি শুরু হলে মান আরো উন্নত হয়ে যাবে। উৎপাদনও বাড়বে। সেক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় কাঁচামাল, ওষুধ ও যন্ত্রপাতি আমদানি করতে হবে। এতে বিদ্যমান শুল্ক বাধা দূর করতে হবে।
সূত্র আরো জানায়, দেশে আফতাব, ব্র্যাক, কাজী ফার্ম, সিপিসহ আরও কয়েকটি কোম্পানি ‘ড্রেসড ও প্রসেসড চিকেন মিট’ তৈরি ও বাজারজাত করছে। আরও বেশ কয়েকটি কোম্পানি শিগগিরই উৎপাদন শুরু করবে।
বাংলাদেশে এখন শুধু মাংস নয়, বরং ডিম, বাচ্চা ও খাদ্য উৎপাদনেও বিশ্বের সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। খামার ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। গড়ে উঠেছে উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর ল্যাব।
খামারগুলোতে কঠোরভাবে বায়োসিকিউরিটি মেনে চলা হচ্ছে। আর এসব কিছুই দেশিয় পোল্ট্রি পণ্যের রপ্তানির সম্ভাবনাকে এগিয়ে নেবে।
সূত্র জানায়, সরকার এ শিল্পকে বাঁচাতে ২০১৪-১৫ অর্থবছর পর্যন্ত ট্যাক্স হলিডে দিয়েছে। কিন্তু চলতি অর্থবছর থেকে সে সুবিধা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
পোল্ট্রি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সারাদেশকে কয়েকটি পোল্ট্রি জোনে ভাগ করতে হবে। রপ্তানি নির্দেশনা অনুযায়ী, জোনে ভাগ করলে কোন একটি জোনে রোগ-বালাই দেখা দিলেও অপরাপর জোন থেকে রপ্তানির ক্ষেত্রে কোন বাধা থাকবে না। ফলে নিরবচ্ছিন্ন রপ্তানি সম্ভবপর হবে।
সম্প্রতি ফ্রান্সে এভিয়ান ইনফ্লুয়েঞ্জা বা বার্ড ফ্লুর প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়া সত্ত্বেও রপ্তানিতে খুব বড় ধরনের প্রভাব পড়েনি। কারণ ইউরোপের আমদানিকারক দেশগুলো পোল্ট্রি জোনিং অনুমোদন করেছিল। বাংলাদেশকে কয়েকটি পোল্ট্রি জোনে ভাগ করতে তাই সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।
সূত্র জানায়, মুসলিম দেশগুলোতে মাংস রপ্তানির ক্ষেত্রে হালাল সনদ জরুরি। তাই হালাল বোর্ড গঠন জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারকে দ্রুতই সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
তাছাড়া কূটনৈতিক মিশনের মাধ্যমে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। যাতে কোন একটি দেশে রপ্তানি বন্ধ হয়ে গেলেও যেন এর প্রভাব কিংবা রপ্তানি বিঘ্নিত না হয়।
মসিউর বলেন, রপ্তানির ক্ষেত্রে শুল্ক ও কর বড় বাধা হয়ে দাঁড়াবে। কারণ উৎপাদন খরচ কমাতে না পারলে প্রতিযোগিতামূলক বাজারে টিকে থাকা কঠিন হবে। তাই রপ্তানির সুযোগ দিতে এ খাতকে আবারও করছাড় ও রপ্তানির ক্ষেত্রে বিদ্যমান বাধাগুলো দূর করতে হবে।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এর রিসার্চ ফেলো ড. সুবীর কান্তি বৈরাগী বলেন, পোল্ট্রি মাংস রপ্তানি করতে হলে খামার ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন ও সরকারি সহায়তা খুবই জরুরি।
রপ্তানির ক্ষেত্রে ইতিবাচক দিক জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশ মুরগির মাংস রপ্তানিতে সক্ষম। তবে এ শিল্পের গবেষণা কাজে অর্থায়ন আরও বাড়াতে হবে।