ঢাকা : টেন্ডার ছাড়াই সমঝোতার ভিত্তিতে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়া হবে। দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দিতে বেশি সময় ব্যয় হয় বলে এ সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে সরকার। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইনের আওতায় এ কাজ করা হবে। শিগগিরই এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাবনা প্রধানমন্ত্রীর কাছে পাঠানো হবে, যিনি বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রীও।
জ্বালানি বিভাগের একটি সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দরপত্র ছাড়াই গ্যাস ব্লক ইজারার বিষয়টি এ খাতের দুর্নীতিতে আরও উৎসাহিত করবে।
পেট্রোবাংলার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘তেল-গ্যাস অনুসন্ধান একটি দীর্ঘমেয়াদী প্রক্রিয়া। দর প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তেলে-গ্যাস অনুসন্ধানের কার্যক্রম শুরু করতেই তিন চার বছর লেগে যায়। এরপর অনুসন্ধান কার্যক্রম চলে আরো কয়েক বছর। কিন্তু দেশে জ্বালানি সঙ্কট দিনে দিনে প্রকট হচ্ছে। এর প্রেক্ষিতে সরকার দ্রুত তেল-গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম শুরু করতে চাইছে। তাই সমঝোতার মাধ্যমে উপযুক্ত কোম্পানিকে গ্যাস ব্লক ইজারা দেয়ার কথা ভাবা হচ্ছে।’
জ্বালানি বিভাগের একজন কর্মকর্তাও নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বিশেষ আইনে তো এ সুযোগ (সমঝোতা) রয়েছে। বিদ্যুৎ খাতে এ আইনের প্রয়োগে সুফলও পাওয়া গেছে। আশা করছি আমরাও সফল হবো।’ প্রধানমন্ত্রীর কাছে এ সংক্রান্ত একটি প্রস্তাব শিগগিরই পাঠানো হবে বলে জানান তিনি।
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিদ্যালয়ের (বুয়েট) শিক্ষক ড. ম তামিম এ বিষয়ে বাংলামেইলকে বলেন, ‘এ প্রক্রিয়া দুর্নীতিকে উৎসাহিত করবে। সরাকরি কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক ব্যক্তিদের পছন্দের কোম্পানিকে কাজ দেয়ারও তোড়জোড় শুরু হবে।’
তিনি বলেন, ‘এমনিতেই দরপত্রের মাধ্যমে গ্যাস খাতে যেসব চুক্তি হয়েছে তা নিয়েই অনেক সমালোচনা আছে। টেন্ডার ছাড়া কাজ দেয়া হলে তা আরো ভয়ঙ্কর হবে।’
বিদ্যুৎ খাতে বিশেষ আইনের আওতায় নানান কাজ দেয়া হলেও তা নিয়ে সমালোচনা হয়েছে বিস্তর। এ প্রসঙ্গে ম. তামিম বলেন, ‘বিদ্যুতের যেসব কাজ টেন্ডার ছাড়া দেয়া হয়েছে, সেগেুলো বিশেষ প্রয়োজনে। আর এগুলো ছোটো ছোটো প্রকল্প। কিন্তু গ্যাসের বিষয়টি ভিন্ন। এতে দেশের স্বার্থ জড়িত।’
তেল-গ্যাস খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, ‘দুর্নীতিতে নিমজ্জিত জ্বালানি খাতকে অনিয়মের চূড়ান্ত ধাপে নিয়ে যেতেই এ উদ্যোগ।’
জ্বালানি বিভাগের তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে ৭টি উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) আওতায় ৫টি বিদেশি কোম্পানি ৮টি ব্লকে কাজ করছে। এর মধ্যে স্থলভাগের জন্য তিনটি পিএসসি ও সমুদ্রের ব্লকের জন্য ৪টি পিএসসি স্বাক্ষর হয়েছে।
স্থলভাগের ১২ (বিবিয়ানা), ১৩ ও ১৪ (জালালাবাদ ও মৌরভীবাজার) ব্লকে যুক্তরাষ্ট্রের শেভরন এবং ৯ নম্বর (বাঙ্গুরা) ব্লকে তাল্লো ও কৃস এনার্জি এবং সমুদ্রের ১৬ নম্বর ব্লকে (মাগনামা) সান্তোস কাজ করছে।
আর অগভীর সমুদ্রের ১১ ব্লক সান্তোস ও ক্রিস এনার্জি এবং ৪ ও ৯ নম্বর ব্লক ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেড (ওআইএল) ইজারা নিয়েছে।
উল্লেখ্য, এ ভূখণ্ডে প্রথম তেলে গ্যাস অনুসন্ধান শুরু ১৯১০ সালে। ব্রিটিশ মালিকানাধীন ইন্ডিয়ান পেট্রোলিয়াম প্রসপেক্টিং কোম্পানি চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে প্রথম অনুসন্ধানী কূপ খনন করে। তবে প্রথম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে বার্মা অয়েল কোম্পানি। ১৯৫৫ সালে সিলেটে ও ১৯৫৯ সালে ছাতকে। স্ট্যানভ্যাক নামের আরেকটি কোম্পানি ১৯৫৯-৬০ সালে দেশের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে তিনটি কূপ খনন করলেও কোনো গ্যাস পায়নি। ব্রিটিশ শেল অয়েল কোম্পানি ষাট দশকে দেশের পূর্বাঞ্চলে তিতাস, রশিদপুর, হবিগঞ্জ, কৈলাশটিলা ও বাখরাবাদের মতো ৫টি বড় গ্যাসক্ষেত্রের সন্ধান পায়।
স্বাধীনতার পর দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আন্তর্জাতিক কোম্পনিকে সম্পৃক্ত করার প্রথম উদ্যোগ নেয়া হয় ১৯৭৪ সালে। নির্ধারিত শর্তের অধীনে ৭টি কোম্পানির সঙ্গে দেশের সমুদ্রবক্ষে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের অনুমতি দেয়া হয়। এ কোম্পানিগুলো হলো যুক্তরাষ্ট্রের আটলান্টিক রিচফিল্ড, ইউনিয়ন অয়েল অব ক্যালিফোর্নিয়া, (ইউনোক্যাল) এবং অ্যাশফিল্ড, কানাডার সুপিরিয়র অয়েল, ইউরোপের ডেমিনেক্স ও ইনা-ন্যাপথালিন এবং একটি জাপানি নিপ্পন অয়েল। এদের মধ্যে ইউনোক্যাল ১৯৭৭ সালে কুতুবদিয়ার নিকটবর্তী সমুদ্রবক্ষে একটি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। তবে বাণিজ্যিক বিবেচনায় সেটি লাভজনক না হওয়ায় গ্যাস উত্তোলন শুরু করা হয়নি। সে সময় বিশ্ব প্রেক্ষাপটে তেলের চহিদা বাড়ায় বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে আগ্রহ হারাতে শুরু করে। কারণ এখানে তেলের চেয়ে গ্যাস প্রাপ্তির সম্ভাবনা বেশি। ১৯৭৮ সালের মধ্যে সব বিদেশি কোম্পানিই বাংলাদেশ পরিত্যাগ করে।
পেট্রোবাংলার অধীনস্ত ন্যাশনাল অয়েল কোম্পানি ১৯৭৭ সালে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে। ১৯৮১ সালে ব্রিটিশ শেল অয়েল কোম্পানি দেশের স্থলভাগে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানের চুক্তি করে। পার্বত্য অঞ্চলে কাজ করে এই কোম্পানি। ১৯৯০ সালের দিকে চট্টগ্রামের পাহাড়ে একটা শুকনো কূপ খননের পর শেল এদেশ ছেড়ে চলে যায়। এরমধ্যে পেট্রোবাংলাই ১৯৮১ সালে বিয়ানীবাজার, কামতা ও ফেনী গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে।
১৯৮৬ সালে পেট্রোবাংলাই সিলেট জেলার হরিপুরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডের প্রথম তেলক্ষেত্র আবিষ্কার করে। যা ১৯৯৭ সালে অখ্যাত কোম্পানি সিমিটারের কাছে ইজারা দেয়া হয়। কোম্পানিটি এ ক্ষেত্রের উন্নয়নে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেও সিলেটের জালালাবাদ গ্যাসক্ষেত্রটি আবিষ্কার করে। তবে নানা অনিয়মের কারণে সিমিটারের সঙ্গে চুক্তি বাতিল করে সরকার।
গ্যাস অনুসন্ধান উৎসহিত করার লক্ষ্যে ১৯৮৮ সালে গ্যাস উত্তোলন নীতিমালায় পরিবর্তন আনা হয়। ১৯৯৩ সালে প্রথম মডেল উৎপাদন বণ্টন চুক্তির (পিএসসি) অধীনে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করা হয়। ব্রিটিশ-ডাচ যৌথ উদ্যোগের কেয়ার্ন এনার্জি ও হল্যান্ড সি সার্চের সঙ্গে ১৯৯৪ সালের মে মাসে ১৬ নম্বর ব্লক ও ৯৫ সালের জুন মাসে ১৫নং ব্লকের জন্য পিএসসি স্বাক্ষর হয়। ১৯৯৬ সালে তারা সাগরে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রটি (১৬ নং ব্লক) আবিষ্কার করে। এখন ১৫ ও ১৬ নম্বর ব্লক পরিত্যক্ত।
১৯৯৫ সালে অক্সিডেন্টাল সিলেট অঞ্চলের ১২, ১৩ ও ১৪নং ব্লকের জন্য পিএসসি স্বাক্ষর করে। যা ১৯৯৯ সালে ইউনোক্যাল ও পরবর্তীতে যুক্তরাষ্ট্রের কোম্পানি শেভরনের কাছে হস্তান্তরিত হয়। অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে অক্সিডেন্টাল ১৯৯৬ সালে মৌলভীবাজারের মাগুরছড়ায় বড় ধরনের বিস্ফোরণ ঘটায়। অক্সিডেন্টাল ও ইউনিকোল যৌথভাবে ১৯৯৮ সালে বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার করে।
১৯৯৭ সালে দ্বিতীয়বারের মতো আন্তর্জাতিক দরপত্র ডাকা হয়। ১৯৯৭ সালের জানুয়ারি মাসে যুক্তরাষ্ট্রের অখ্যাত দুটি কোম্পানি রেক্সউড এবং অকল্যান্ড কক্সবাজার, টেকনাফ অঞ্চলের (৮০ সমুদ্র এলাকা) ১৭ ও ১৮নং ব্লকের জন্য পিএসসি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে রেক্সউড ও অকল্যান্ড একীভূত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের আরেক ছোট কোম্পানি ইউনাইটেড মেরিডিয়ান করপোরেশন (ইউএমসি) ১৯৯৬ সালে পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল নিয়ে গঠিত ২২নং ব্লকে পিএসসি স্বাক্ষর করে। পরবর্তীতে ইউএমসি যুক্তরাষ্ট্রের আরেক কোম্পানি ওশেন এনার্জির কাছে তার শেয়ার হস্তান্তর করে। বর্তমানে ১৭ ও ১৮নং ব্লক পরিত্যক্ত হয়েছে।
১৯৯৭ সালের এপ্রিল মাসে ১৫টি ব্লকের জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়। এরমধ্যে ২০০১ সালে ইউনিক্যাল ৭নং ব্লক ইজারা পায়, যা শেভরনের কাছে কস্তান্তর করে, এটা এখন পরিত্যক্ত। একই সময় তাল্লো ও নাইকোর সঙ্গে ৯ নম্বর ব্লকের চুক্তি হয়। এরমধ্যে কানাডিয়ান কোম্পানি নাইকোর অদক্ষতার কারণে ২০০৫ সালের জানুয়ারি ও জুন মাসে টেংরাটিলা গ্যাসক্ষেত্রে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এছাড়া স্থালভাগের ৫ ও ১০ নম্বর ব্লক পেয়েছিল শেল ও কেয়ার্ন, এগুলোও এখন পরিত্যক্ত।
মডেল পিএসসি ২০০৮ এর অধীনে সমুদ্র সীমার ২৮ ব্লকে তেল ও গ্যাস অনুসন্ধানে ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। ৭টি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আগ্রহ করলেও চুক্তি হয় মাত্র দু’টি ব্লকের জন্য। এ সময় ১২টি ব্লকের জন্য কোনো দরপত্র জমা পড়েনি। ২০১১ সালের ১৬ জুন সাগরের ১০ ও ১১ নম্বর ব্লকের জন্য কনোকো ফিলিপসের সঙ্গে চুক্তি করে পেট্রোবাংলা। দু’বছর কাজ করার পর ২০১৪ সালে ব্লক দু’টো ছেড়ে দেয় কনোকো।
পিএসসি ২০১২-এর আওতায় ২০১৩ সালে অগভীর সমুদ্রে ৯টি ও গভীর সমুদ্রে ৩টি ব্লকের জন্য চতুর্থ দফা দরপত্র ডাকে পেট্রোবাংলা। এ দরপত্রে চার ব্লকে তিনটি দরপত্র জমা পড়ে। অগভীর সমুদ্রে ৪ ও ৯ নম্বর ব্লকে ভারতীয় দুই কোম্পানি ওএনজিসি ভিদেশ লিমিটেড (ওভিএল) ও অয়েল ইন্ডিয়া লিমিটেডের (ওআইএল), ব্লক ৭ এ কনকো ফিলিপস এবং ব্লক ১১-তে স্যান্টোস-ক্রিস এনার্জি দর প্রস্তাব জমা দেয়। এরমধ্যে স্যান্টোস-ক্রিস এনার্জির সঙ্গে ২০১৪ সালের মার্চে চুক্তি হয়। ভারতীয় কোম্পানির সঙ্গে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে চুক্তি হয়েছে। অনুসন্ধান কাজ এ মাসেই শুরু হতে পারে। তবে কনোকো ফিলিস ব্লক ৭ ছেড়ে দিয়েছে।
২০১৩ সালের ডিসেম্বরে গভীর সমুদ্রে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে আরেকটি আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করে পেট্রোবাংলা। একমাত্র দরদাতা হিসেবে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে ডিএস-১২, ডিএস-১৬ ও ডিএস-২১ এই তিন ব্লকের জন্য যৌথভাবে দরপ্রস্তাব জমা দিয়েছিল কনোকো ও স্টেট ওয়েল। তবে এখান থেকেও কনোকো নিজেকে সরিয়ে নেয়। ব্লক তিনটিতে স্টেট অয়েল কাজ করতে আগ্রহী।