মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর মাছ আমদানি বন্ধ হচ্ছে না। মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে আনা সামুদ্রিক মাছের নমুনা পরীক্ষা করে গত বছর প্রথম ক্ষতিকর উপাদান পায় মৎস্য অধিদপ্তর। এর পরিপ্রেক্ষিতে এ জাতীয় মাছ আমদানি না করতে আমদানিকারকদের পরামর্শ দেওয়া হয়। আমদানিকারকরা তা শোনেননি। গত মাসে নমুনা পরীক্ষা করেও পাওয়া গেছে ক্ষতিকর উপাদান। এ অবস্থায় হিমায়িত মিঠাপানির মাছ ছাড়া সামুদ্রিক মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে মৎস্য মন্ত্রণালয়। আমদানি করা মাছ বন্দর থেকে খালাসের আগে সব ধরনের উপাদানের মাত্রা যাচাই করে মান পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করারও প্রস্তাব দিয়েছে মন্ত্রণালয়।
মৎস্য অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, আমদানি করা মাছের নমুনা মাসে একবার পরীক্ষা করে এখনও মাত্রাতিরিক্ত ক্যাডমিয়াম ও লেডের (হেভি মেটাল) উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদানযুক্ত মাছ বাজারে বিক্রি হওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য হুমকি। চট্টগ্রাম বন্দরের কর্মকর্তারা মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছেন, আমদানিনীতি আদেশে ফরমালিন ছাড়া অন্য কিছু পরীক্ষার বিষয় উল্লেখ না থাকায় ওই মাছ ছাড় করাতে পারছেন আমদানিকারকরা। এ ক্ষেত্রে তেমন কোনো পদক্ষেপ নিতে পারছেন না বন্দরে পরীক্ষার দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তারা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিসিন অনুষদের ডিন ডা. এবিএম আবদুল্লাহ সমকালকে বলেন, মাছে অতিরিক্ত মাত্রায় ক্যাডমিয়াম ও লেডের উপস্থিতি থাকলে তা মানবদেহের জন্য ক্ষতিকারক। এর ফলে কিডনিতে সমস্যা হতে পারে। নার্ভে রক্ত তৈরিতে সমস্যার কারণে রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। মেধার বিকাশ বাধাগ্রস্ত হতে পারে। গর্ভবতী মা ও বাচ্চাদের ক্ষেত্রে নানা সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে। অল্প সময় এসব উপাদান তেমন ক্ষতির কারণ নাও হতে পারে। তবে দীর্ঘদিন এসব মাছ খেলে তা বড় ধরনের সমস্যা সৃষ্টি করবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় জানায়, ওমান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, ইয়েমেন, পাকিস্তান, মিয়ানমার, ভিয়েতনাম, ভারতসহ বিভিন্ন দেশ থেকে নানা প্রজাতির হিমায়িত সামুদ্রিক মাছ আমদানি হচ্ছে। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৪১ হাজার টন সামুদ্রিক মাছ আমদানি হয়। আর দেশে মোট মাছ আমদানি হয় প্রায় ৭০ হাজার টন। গত অর্থবছরে সামুদ্রিক মাছের আমদানি বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার টনে। আমদানি হওয়া সামুদ্রিক মাছের বেশিরভাগই আসছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো থেকে। সাম্প্রতিক সামুদ্রিক রাসায়নিক উপাদানযুক্ত ক্ষতিকর মাছ আমদানি বাড়ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, এসব মাছের দাম তুলনামূলক কম হওয়ায় আমদানি বেশি হচ্ছে। যেসব দেশ থেকে আমদানি হচ্ছে সে সব দেশের বাজারে এ মাছ বিক্রি হচ্ছে না। কম দামে পেয়ে এ দেশের বাজারে এনে বিক্রি করছেন আমদানিকারকরা। প্রতি কেজি মাছ গড়ে ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় আমদানি করে ৬০ থেকে ৬৫ টাকা কেজিতে বিক্রি করছেন তারা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘদিন থেকেই ছোট ইলিশ বা চান্দিনা ইলিশ আমদানি হচ্ছে। ইলিশ প্রজাতিভুক্ত ফ্রোজেন গিজার্ড শাড ফিশ, হোয়াইট গিজার্ড শাড ফিশ, সার্ডিন, চাকোরি ও ডটেড গিজার্ড শাড নামের এসব গভীর সামুদ্রিক মাছ আসছে। তবে দেশের বাজারে এসব নাম তেমন পরিচিতি পায়নি।
রাজধানীর বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এখন প্রচুর বিদেশি মাছ বিক্রি হচ্ছে। আগে দেশি সামুদ্রিক মাছ বিক্রি হলেও তা দাম ছিল বেশি। এখন আমদানি করা সামুদ্রিক মাছ কম দামে বিক্রি হচ্ছে। বাজারে এসব মাছ চান্দিনা ইলিশ, দাতিন, কোরাল, পোয়া, লাক, বাদাসহ বিভিন্ন নামে বিক্রি হচ্ছে।
সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে দেওয়া এক চিঠিতে মৎস্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দেশের মানুষের স্বাস্থ্যের দিক বিবেচনা করে আমদানি করা মাছ বন্দর থেকে ছাড় করার আগে ভৌত মান, জীবাণুতাত্তি্বক ও রাসায়নিক পরীক্ষা করা প্রয়োজন। এ ছাড়া হিমায়িত মিঠাপানির মাছ ছাড়া অতিমাত্রায় ক্ষতিকারক উপাদানযুক্ত সামুদ্রিক মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত। আমদানিনীতিতে এসব সংশোধনী আনতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ জানানো হয়।
বাংলাদেশ ফিশ ইম্পোটার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি আশ্রাব হোসেন মাসুদ জানান, সামুদ্রিক মাছ আমদানি বন্ধ করার পরিবর্তে এর মান যাচাই করা উচিত। ক্ষতিকারক উপাদানের মাত্রা সরকারি ল্যাবে পরীক্ষা করে আমদানি করা মাছ স্থানীয় বাজারে ছাড়ার সুযোগ থাকা প্রয়োজন।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব হেদায়েতুল্লাহ আল মামুন সমকালকে বলেন, আমদানিনীতিতে উল্লেখ রয়েছে, যেটা ক্ষতিকারক খাদ্য তা আমদানি-নিষিদ্ধ। এর পরও কোনো উপাদানের বিষয় আলাদা করে পরীক্ষা বা আমদানি-নিষিদ্ধ করার প্রয়োজন হলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তিনি বলেন, মৎস্য মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাব নিয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে আগামী সপ্তাহে বৈঠক করা হবে। বিশেষ করে মৎস্য অধিদপ্তরের পরীক্ষকদের সঙ্গে আলাদা বৈঠক করে আলোচনার মাধ্যমে বিষয়টি সমাধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মো. আনিছুর রহমান সমকালকে বলেন, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক রাসায়নিক পদার্থ ধরা পড়ায় আমদানি করা মাছ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করার অনুরোধ করা হয়েছে। এ কারণে অন্য পরীক্ষা করে ক্ষতিকারক উপাদান পেলেও সেসব বিষাক্ত মাছ বাজারে আসছে। এ অবস্থায় ক্ষতিকারক উপাদানযুক্ত সামুদ্রিক মাছ আমদানি নিষিদ্ধ করা উচিত।
কনজিউমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ-ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান সমকালকে বলেন, বিশ্ববাণিজ্য চুক্তি অনুযায়ী ক্ষতিকর উপাদানযুক্ত পণ্য নিষিদ্ধ করতে কোনো বাধা নেই। তিনি বলেন, জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে এ বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। ক্রেতাদের না জেনে অনেক কিছু খেতে হচ্ছে। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে দায়িত্বে থাকা সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর যথাযথ তদারকি প্রয়োজন।