উপাখ্যান-১: সন্ন্যাসী রাজা ও ভাওয়াল রাজবাড়ি

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ

vawal-1

শাহান সাহাবুদ্দিন: ভাওয়াল রাজবংশ পূর্ববঙ্গের ভাওয়াল পরগণার ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ আখ্যান ও ঐতিহাসিক বাস্তবতা সুপ্রতিষ্ঠা করার ভেতর দিয়ে ইতিহাসবেত্ত্বা, লেখক, কবি, গবেষক, শিল্পী ও ভাবুকের কাছে গুরুত্ত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়ে আসছে। ভাওয়াল রাজবংশ তথা রাজবাড়ি ও ভাওয়ালের মধ্যম কুমার রাজা রমেন্দ্র নারায়ণ রায়কে ঘিরে তৈরী হওয়া বিভিন্ন ইতিহিাস ও মিথ এতদ অঞ্চলের মানুষের কাছে এখনো সমান ভাবে আদৃত ।

মধ্যম কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের রহস্যময় মৃত্যু,মৃত্যুর পর শশ্মান হতে নিরুদ্দেশ ও বার বছর পর ফের ভাওয়ালে চাঞ্চল্যকর প্রত্যাবর্তনের উপাখ্যান এখনো পৌরণিক কাহিনীর মতোই শ্রোতাদের অপার আগ্রহ সৃষ্টি করে।  বছরের পর বছর ধরে অবিশ্বাস্য এই কাহিনী এখনো রুপকথার গল্পের মতোই লোকমুখ থেকে পালাগান, নাটক, পুঁথি, গাঁথা,কাব্য ও উপন্যাসে স্থান পেয়ে এসেছে। ইতিহাস খুঁড়ে সন্ন্যাসী রাজার উপাখ্যান যা পাওয়া যায় তাতে এই ঘটনা প্রবাহের নেপথ্যে ভাওয়ালের মধ্যম কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের স্ত্রী রানী বিভাবতীর সঙ্গে তাদেরই রাজ কর্মচারী ডা. আশুতোষের পরকীয়া সম্পর্ককেই বড় করে দেখা হয়। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন, কালি নারায়ণের মৃত্যুর পর ভাওয়ালের জমিদার হন রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়। শিকারের হিংস্র উত্তেজনা, মদ্যপান, অবাধ যৌনাচারে ক্রমশঃ কৃষ্ণ পক্ষের দখলে যাওয়া রাজা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের জন্য যথোপযুক্ত উত্তর সূরী রেখে যাওয়া প্রায় দুঃসাধ্য হয়ে পরে। রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের স্ত্রী রাণী বিলাসমণি দেবী মেধা, মনিষা ও দানশীলতায় সমুজ্জ্বল ব্যক্তিত্ত্বের অধিকারিণী ছিলেন। কিন্তু রাজ নারায়ণের প্রত্যক্ষ উত্তরাধিকারগণ যথা রণেন্দ্র, রমেন্দ্র ও রবীন্দ্র নারায়ণ রায় মায়ের ব্যক্তিত্ত্বের আলোয় নিজেদের ছায়াকে মেলে ধরতে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়ে বিপথগামী ইন্দ্রিয় সেবী বাবা রাজেন্দ্র নারায়ণ রায়ের চরিত্রকেই আত্বস্থ করলেন। ফলশ্রুতিতে রাণী বিলাসমণি কর্তৃক কুমারদের বিদ্যাদানের জন্য নিয়োজিত দেশী শিক্ষক ছাড়াও দুজন বিদেশী সাহেব শিক্ষকের সকল রকম প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হলো। তার নমুনা শিক্ষক মি. হোয়াটনের রাণী বিভাবতীকে লেখা চিঠি-‘আমার শত ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আপনার তিন পুত্রকে আমি এতোটুকু আলো দান করতে পারলামনা। পড়াশুনায় তাদের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই। আর তাছাড়া তারা আমার কথা শুনেওনা।’ অপর এক শিক্ষক মি. মায়ার লিখেছেন-‘ পিতার মৃত্যুর পর মধ্যম কুমার যৎসামান্য লেখাপড়া শিখেছেন। কিন্তু অপর দুজনের সম্বন্ধে কিছু না বলাই ভালো। এরা সব সময় নিম্ন শ্রেণীর ও দুষ্ট শ্রেণীর লোকদের সঙ্গে মেলামেশা করে কুশিক্ষাই লাভ করছে। বড় কুমারও এই বয়সেই গণিকাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ভাবে মেলা মেশা করছে।’

উত্তর পাড়ার ফুল কুমারীদেবীর অনিন্দ্য সুন্দরী কণ্যা বিভাবতীর সঙ্গে মধ্যম কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়ের বিয়ে হলো ১৯০২ সালে। কুলীন ব্রাষ্মন বিষ্ণু বন্দ্যোপাধ্যায়ের মেয়ে বিভাবতীর সৌন্দর্য যেন দোল পূর্ণিমার রাত্রির অপার মনোরম দৃশ্যের সঙ্গেই তুলনীয়। কিন্তু হায়, বৌয়ের দিকে তাকাবার অবসরই নেই মধ্যম কুমার রমেন্দ্র নারায়ণের। ঘোড়া টমটম হাকানো, শিকারে মগ্নতা, বার বাড়িতে যাওয়া, সেখানেই গণিকাদের সঙ্গে রাত কাটানো, আকন্ঠ নেশায় ডুবে থাকা, জোয়ার আসরে সময় কাটানোর পাশাপাশি ইয়ার বকিক্সদের নিয়ে প্রায়ই কলকাতায় পাড়ি জমানো; সেখানে সঙ্গী বলতে মদ, বেগম বাজারের একাধিক সুন্দরী মহিলা, মোসাহেব বন্ধুবর্গ ইত্যাদির সান্নিধ্যেই কেটে যায় দিন। তাছাড়া রক্ষিতা এলোকেশী তো অষ্টপ্রহর সঙ্গ দানের নিমিত্তে প্রস্তুত আছেই। ফলে স্বামীর সঙ্গ বঞ্চিতা বিভাবতীর যৌবন ছাই চাপা আগুনের মতোই ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকলো প্রাসাদের অন্তঃপুরে নিভৃতে। স্বামী কর্তৃক উপেক্ষিত হয়ে তাদেরই রাজকর্মচারী ড. আশুতোষের সঙ্গে ইতোমধ্যে সম্পর্কে জড়িয়ে পরেন রাণী বিভাবতী। রাণী বিভাবতীকে একান্তে পাবার মানসে ডা. আশুতোষ চাইলেন রাজা রমেন্দ্রকে কৌশলে সরিয়ে দিতে। এই ষড়যন্ত্রে মীরজাফরের পোশাক পরে ভাওয়ালের রাজ প্রাসাদে প্রবেশ করলেন বিভাবতীর ভাই ল’ কলেজের আইনের ছাত্র সত্যেন মূখার্জি। কুমার রমেন্দ্রের শরীর খারাপের কারণ দেখিয়ে রাজ পরিবারের চিকিৎসক আশু ডাক্তার হাওয়া বদলাতে কুমারকে দার্জিলিং যাবার পরামর্শ দিলেন। ডাক্তারের পরামর্শ ক্রমে ১৯০৯ সালের ২০ এপ্রিল কুমার রাণী বিভাবতী, সত্যবাবু ও আশু ডাক্তার সহ ২০/২২ জনের বহর নিয়ে উপস্থিত হলেন দার্জিলিংয়ে। সেখানে ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ নামক বাড়ি ভাড়া করা হলো কুমারের থাকবার জন্য। এখানে এসেই কুমার টাইগার হিলে পাহাড়ি ভাল্লুক শিকার, বিলিয়ার্ড খেলা, তাস পেটানো, ঘোড়ায় চড়ে বেড়ানো ইত্যাদিতে মগ্ন হয়ে গেলেন। এরই ফাঁকে কুমারকে সরিয়ে দেবার ষড়যন্ত্রের জাল বিস্তার করতে থাকে বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্র ও আশুতোষ ডাক্তার।

শেক্্রপিয়রের ট্র্যাজিক নাটকের নায়িকাদের মতো স্বামীকে হত্যা করার ষড়যন্ত্রকে সফলকাম করার জন্যে ধীরপায়ে অতিসন্তর্পণে এগিয়ে আসেন বিশ বছর বয়সী রাণী বিভাবতী। একরাত্রিতে পেট ফাঁপা যন্ত্রনায় কুমার কাতরাতে থাকলে ডা. আশুতোষের দেয়া মৃত্যুর অনুকুলে ওষুধ খাওয়ালে রাজা রমেন্দ্রের মৃত্যু হয়। তড়িঘড়ি করে সৎকারের জন্য কুমারের নিথর দেহটাকে পাঠিয়ে দেয়া হলো চিতায়। হঠাৎ আকাশে মেঘ দেখা দিলে, দমকা হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি পড়তে শুরু করলে মৃতদেহ দাহ না করেই শবদেহ বহন কারীরা কুমারের লাশটাকে রেখেই ঘরে ফিরে যায় এবং কুমারের সৎকার হয়েছে বলে রাণীকে জানায়। প্রচন্ড বর্ষনে ওষুধের সঙ্গে দেয়া  দেহের বিষ ক্রিয়া নষ্ট হয়ে গেলে কুমার জ্ঞান ফিরে কিছু বলতে চেষ্টা করেন। কুমারের রা’য়ের শব্দ শুনে শশ্মানের পাশেই গোহার ভেতরে ধর্মালোচনা রত ধরমদাস,পিতদাস,লোকদাস ও দর্শনদাস নাগা নামের চারজন সন্ন্যাসী বেরিয়ে আসেন। তাদের সেবা শশ্রুষায় নতুন জন্ম পেয়ে ধরম দাসকে গুরু জ্ঞানে গ্রহণ করে তাদের সঙ্গে মিশে যান কুমার। নতুন জীবন দর্শন ভাওয়াল রাজাকে সন্ন্যাসীতে পরিনত করলো। ধর্ম দর্শন অতিন্দ্রীয়বাদে দীক্ষা নিয়ে সন্ন্যাসীদের সঙ্গে কাশিধাম, আসিঘাট, বিন্ধ্যাচল, চিত্রকুট, এলাহাবাদ, বৃন্দাবন, হরিদ্বার, ঋষিকেশ, লছমনঝোলা, কাশ্মীর, শ্রীনগর, অমরনাথ, তিব্বত, নেপাল, কামাক্ষ্যা থেকে গৌহাটি পর্যন্ত চষে বেড়ালেন ।

ইতোমধ্যে গুরু ধরমদাস নাগা হতে মন্ত্র নিয়ে কুমার যখন ব্রষ্মচারী হয়ে উঠেছেন তখন থেকেই তার অতীত স্মৃতি ক্ষণভাবে ফিরে আসতে থাকে এবং একদিন গুরুকে তার পরিচয় ও ঠিকানা জানাতেই ফেরার যথোপযুক্ত সময়ে একদিন ধরম দাস ভাওয়ালে প্রত্যাবর্তনের ইঙ্গিত করেন। সে মতে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় একদিন বরাহছত্তর থেকে পূর্ণিমা, রংপুর, কামাখ্যা,গৌহাটি, ফুলছড়ি হয়ে ট্রেনে ঢাকায় এসে নামলেন। তখন কুমারের সম্বল বলতে কৌপিন, চিমটে, কমন্ডলূ, আর বেশ বলতে জটাজূটদাড়ি শুশ্রু গোঁফ বিশিষ্ট পুরোদস্তুর সন্ন্যাসী। ষ্টেশন থেকে পরদিন সকাল দশ ঘটিকায় সোজা চলে গেলেন  বাকল্যান্ড বাঁধে। সেখানে আস্তানা গেড়ে থাকলেন প্রায় তিন মাস। এই সময়ে বহু লোক তাঁকে দেখতে যেতো, এমনকি ভাওয়ালের মধ্যম কুমার হিসেবে অনেকেই তাঁকে চিনেছে। গুরুর নির্দেশে তখন তিনি বাংলায় কথা না বলে হিন্দিতে কথা বলতেন। একদিন কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় তাঁকে চিনতে পেরে কাশিমপুর নিয়ে এলেন। এইটুকু করেই তিনি ক্ষান্ত হলেননা, জয়দেবপুরে হাতির পিঠে সওয়ার করিয়ে খাস জমিদারের মতোই সেখানে প্রত্যাবর্তনের সুযোগ করে দেন। জয়দেবপুরে এসে রমেন্দ্র নারায়ণ রায় যখন প্রাসাতে আতিথিয়েতা নিয়ে খাচ্ছিলেন তখন সন্ন্যাসীকে তর্জুনি উঠিয়ে খেতে দেখে ভুলুর কাকা বললেন,‘এ মেজ কুমার’। চারদিকে তখন প্রজা ও দর্শনার্থীদের মাঝে হৈ চৈ পড়ে গেছে। বিকেলের দিকে মেজকুমারকে যখন তাঁর বোন জ্যোতির্ময়ীর বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হলো সেখানে ঠাকুরমা সত্যভামা দেবী সহ ছোট বোন, ভাগ্নী ও বড় বোনকে দেখে আবেগ্লাপুত হয়ে পড়েন তিনি, তাঁর চোখ দিয়ে জল গড়াতে থাকে, দীর্ঘ পঁচিশ বছরের যাপীত দিনের স্মৃতি এক এক করে তাঁর চোখের সামনে ছায়াছবির মতো ভাসতে থাকে, বুকের ভেতরের আবেগী নদীদে উঠে ঢেউ, শুরু হয় প্লাবন; এক পর্যায়ে সন্নাসী ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায়ের ছবি দেখে উচ্চস্বরে কাঁদতে শুরু করলে বোন জ্যোতির্ময়ী দেবী সহ হাজার হাজার মানুষের উপস্থিতিতে ষ্পষ্ট স্বরে সন্ন্যাসী জনতার চাপে নিজের পরিচয় তুলে ধরেন এইভাবে-‘ আমি মেজ কুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী’। উত্তর শুনে উপস্থিত জনতা ‘জয় মেজ কুমারের জয়’ শ্লোগানে ও উলু ধ্বণিতে রাজ বাড়ি কাঁপিয়ে তুললো।

পরবতি অংশ ২ এ দেখুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *