ঢাকা: যেকোনো উৎসবকে ঘিরে আয়োজনই তাকে উপযুক্ত সংজ্ঞায়িত করে। ধরুন, ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান করবেন। এ উপলক্ষ্যে নতুন পোশাক পরিচ্ছদ, সাজগোজের অনুষঙ্গ, একে অপরকে উপহার দেয়া-নেয়া, খাবার দাবারে বিশেষ আয়োজন এবং সবশেষে ঘোরাফেরা আড্ডাবাজির পরিকল্পনা মাথার মধ্যে ঘুরঘুর করতে থাকে। আর সব পরিকল্পনা হয় উৎসবের মূল দিন থেকে আগের কয়েকদিন জুড়ে। পুরো বিশ্বজুড়ে এমনি এক উৎসব মূখর দিন ইংরেজি বছরের শেষ এবং নতুন বছরের প্রথম দিনটি। সব মিলে পুরোনো বছরের শেষ প্রহর আর নতুন বছরের প্রথম প্রহরকে বেছে নেয়া হয় আনন্দ উপভোগের মাহেন্দ্রক্ষণ হিসেবে। জীবন থেকে একটি দিন, মাস বা বছর ঝরে যাওয়া নিঃসন্দেহে আফসোসের কিন্তু নতুনকে সাদরে গ্রহণ করার আনন্দ সবকিছুকে ছাপিয়ে যায়।
দিনপঞ্জিকার পাতা বলছে চলতি বছরের বাকি মাত্র কয়েক ঘণ্টা। এরই মধ্যে উৎসব প্রিয় ব্যক্তিরা নতুন বছরকে সাদরে গ্রহণ করতে আয়োজন করেছেন অনেক কিছুই। তবে দেশ বা জাতি ভেদে আয়োজনের রয়েছে ভিন্নতা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এই দিনটি ঘিরে প্রচলিত আছে নানা রীতি-নীতি। আসুন দেখে নেয়া যাক।
আমেরিকার বর্ষবরণ
রমরমা পার্টিতে শ্যাম্পেনের মুখ উন্মোচন, কেক কাটা, হাজারো খাবার আয়োজন, হালের চোখ রগড়ানো পার্টি পোশাক পরিধান, পার্টি উন্মাদনা, রঙিন কাগজ-জরি উড়ানো, আতশবাজি ফোটানো, উচ্চশব্দে ভুভুজেলা বাঁশি বাজানো, একে অপরকে আলিঙ্গন, পার্টি মিউজিকে রাতভর নাচ আর ঠাট্টা তামাশায় মেতে থাকা আমেরিকার বর্ষবরণের উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। পুরো দেশজুড়ে ফুটবল খেলা সম্প্রচার এই দিনের একটি উল্লেখযোগ্য রীতি। অনেক আমেরিকান পরিবারের সদস্য বা বন্ধুদের নিয়ে খেলাটি দেখতে পছন্দ করেন। এই ঐতিহ্য চলে আসেছে ১৯১৬ সাল থেকে।
ইংল্যান্ডের বর্ষবরণ
রীতি অনুযায়ী এই দেশে নতুন বছরকে স্বাগত জানায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের পাতা উন্মোচনের ভেতর দিয়ে। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন বা পরিবারের লোকজন মিলে খুব উল্লাসের সঙ্গে সময়টা উপভোগ করা হয়। এসময় মজার খাবারের সঙ্গে মদের আয়োজনও থাকে। লন্ডনের ওয়েস্টমিনস্টার এলাকার সংসদ ভবনের উত্তরাংশে অবস্থিত সুবিশাল বিগ বেনের নিচে বিশাল ভিড় জমে। বিগ বেনের ঘণ্টাটি ঠিক বারোটার ঘণ্টা বাজালে হাজার হাজার আতশবাজিতে টেমস পাড় আলোকিত হয়ে যায়। সেখানে উৎসব মুখর পরিবেশ বিরাজ করে। সার্কাস, বাজি, বাঁশি, পার্টি মিউজিক, নাচ সবই চলে। মিশ ভয়েসে “পুরানো সেই দিনের কথা গেয়ে” অতীত দিনের সম্মানও জানানো হয়।
বর্ষবরণের অপর ঐতিহ্য হল প্রথম পদচারণা। এজন্য একজন লম্বা, সুঠামদেহি কালোবর্ণের পুরুষ বছরের প্রথম প্রহর অর্থাৎ মধ্যরাতে জনগনের বাড়ি পরিদর্শণে যান। রীতি অনুযায়ী তার হাতে একটুকরো রুটি, এক বতল হুয়িস্কি, কিছু জ্বালানি এবং লবণ থাকে। জ্বালানির উদ্দেশ্য খাবার তৈরির জন্য আগুনের ব্যবস্থা, খাবারের জন্য রুটি, পানের জন্য হুয়িস্কি এবং নববর্ষের শুভেচ্ছা জ্ঞাপনে ওই দূত প্রত্যেকের বাড়ি পরিদর্শণ করেন। তিনি বাড়ির সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করেন এবং পেছনের দরজা দিয়ে বেরিয়ে যান। এই দূত আসে বাড়ির সুখ সমৃদ্ধি কামনা করতে।
ফ্রান্সের বর্ষবরণ
বছরের শেষ দিন মানে ঘরে থাকা সব মদ শেষ করতেই হবে। নতুন বছরে ঘরে পুরনো মদ পড়ে থাকা অশুভ লক্ষণ। আর অশুভ ঘরে থাকলে সৌভাগ্য আসবে না। তবে ঘরে-থাকা মদ ফেলে দিলেও তো চলবে না। খেয়েই শেষ করতে হবে পুরোটা। মদে মশগুল রাত, হাসি আর আনন্দ, নিমিষে রাত পার, এলো নতুন ভোর, আ..হা!
প্যারাগুয়ের বর্ষবরণ
প্যারাগুয়েতে বছরের শেষ পাঁচদিন ঘরের চুলায় কোনো আগুন জ্বলবে না। তাই কোনো রান্নাও হয় না। বিশেষ এই পাঁচদিনকে তারা পালন করে ঠাণ্ডা খাবার খাওয়ার দিন হিসেবে। ৩১ ডিসেম্বর রাত ১২টার পর নতুন বছরের ঘণ্টা বাজলে আগুন জ্বেলে রান্না শুরু নতুন পদের, পরিবারের সবাই একসঙ্গে খেয়ে নতুন বছরে পা রাখা।
পোল্যান্ডের বর্ষবরণ
পোল্যান্ডের বর্ষবরণটা বেশ মজার। এখানকার তরুণীরা বর্ষবরণের রাতে খরগোশের মতো পোশাক পরে জড়ো হয়। এরপর খরগোশের মতো লাফিয়ে লাফিয়ে বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি জোগাড়ের পালা। তারপর ওই শাকসবজির যতোটা সম্ভব চিবিয়ে খায়! তাদের ধারণা, শাকসবজি খেয়ে নতুন বছরে পা দিলে আগামী দিন সুন্দর হবে। থাকবে প্রশান্তি।
বুলগেরিয়ার বর্ষবরণ
আমাদের দেশে হাঁচি নিয়ে নানা সংস্কার আছে। কথার মাঝে হাঁচি পড়লে সেটা সত্যি ধরে নেয়া হয়। আবার কোথাও বের হওয়ার সময় হাঁচি পড়ল, তো সেটা অমঙ্গলসূচক। কিন্তু বুলগেরিয়াবাসীর কাছে বর্ষবরণের দিন হাঁচি দেয়াটা বেশ মঙ্গলের। বর্ষবরণের দিন তাদের বাড়িতে আসা কোনো অতিথি যদি হাঁচি দেন, তাহলে বাড়ির কর্তা তাকে নিজের খামারে নিয়ে যান। এরপর সেই ব্যক্তির প্রথম নজর খামারে যে পশুটির ওপর পড়বে, সেই পশুটিকে গৃহকর্তা তাকে উপহার দেন। ভাগ্য সঙ্গ দিলে অনেক অতিথি ঘোড়াও উপহার হিসেবে পেয়ে থাকেন। বুলগেরিয়ানদের ধারণা, হেঁচে-ফেলা অতিথি পুরো পরিবারের জন্য সুখ ও সমৃদ্ধি নিয়ে আসবেন।
হাঙ্গেরির বর্ষবরণ
বছরের শেষ দিন হাঙ্গেরিবাসী হাঁস, মুরগি বা কোনো ধরনের পাখির মাংস খান না। তাদের মতে, ওইদিন উড়তে পারে এমন পাখির মাংস খেলে নতুন বছরে জীবন থেকে সব সৌভাগ্য উড়ে যাবে! এর পাশাপাশি, তারা নতুন বছরে পরিচিত বা বন্ধুদের যে উপহার দেন, তাতে চিমনি পরিষ্কার করছেন এমন একজন শ্রমিকের ছবি থাকে। তাদের ব্যাখ্যা, উপহারে এই ছবিটি থাকলে পুরনো বছরের সমস্ত দুঃখ নতুন বছরে মুছে যাবে।
ভিয়েতনামর বর্ষবরণ
দেশটির উত্তরে কিছু সংখ্যালঘু জাতি রয়েছে, যারা বছরের শেষ দিনে জলাধারে দল বেধে গিয়ে মোমবাতি জ্বেলে মাটিতে মাথা ছুঁইয়ে প্রণাম করে। পরে তারা সেই জলাধার থেকে এক কলসি পানি নিয়ে আসে। এরপর ওই পানি দিয়ে বছরের প্রথম দিন রান্না করে পূর্বপুরুষদের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে। তারপর নিজেরা খায়। তবে বছরের প্রথম দিনের রান্নায় স্যুপ জাতীয় খাবার থাকা চলবে না। বছরের প্রথম দিন স্যুপ জাতীয় খাবার খেলে নাকি মাঠের ফসল বন্যায় ভেসে যাবে।
মাদাগাস্কারের বর্ষবরণ
আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারে নতুন বছর শুরুর সাতদিন আগে থেকে মাংস খাওয়া বন্ধ। বছরে প্রথম দিন বাড়িতে মুরগির মাংস রান্না হবে। প্রথমে তা খেতে দেয়া হয় বাবা-মাকে। তাদের দেয়া হয় মুরগির লেজের দিকের অংশটা আর ভাই-বোনেদের দেয়া হয় মুরগির পা।