ঢাকা: মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা এবং মুক্তিযুদ্ধের মহানায়কের ভূমিকা সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক বক্তব্য কিংবা প্রচারণা রোধে মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন প্রণয়নের দাবি জানিয়েছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের বিতর্কিত মন্তব্য ঘিরে তুমুল সমালোচনার মধ্যে এ দাবি জানালো সংগঠনটি।
শনিবার বিকেলে ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনী মিলনায়তনে এক সংবাদ সম্মেলনে এ দাবি জানানো হয়। এছাড়া মানবতাবিরোধী অপরাধীদের স্থাবর-অস্থার সম্পত্তি এবং ব্যাংকে গচ্ছিত অর্থ বাজেয়াপ্ত করে তা মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিম ও পরিবারের কল্যাণে ব্যয় করারও দাবি জানানো হয়েছে। সংবাদ সম্মেলনে লিখিত বক্তব্য পাঠ করেন একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির।
সংবাদ সম্মেলনে বক্তারা বলেন, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস পাকিস্তানি সৈন্য এবং তাদের এদেশীয় দোসররা আমাদের উপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়েছে। স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর এসে একটি রাজনৈতিক দলের প্রধান মুক্তিযুদ্ধে শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তিকর বক্তব্য দিচ্ছেন। আমরা তার এই মানসিক নির্যাতন সহ্য করতে চাই না। তাই সরকারের কাছে দাবি, ১৯৭৩ সালের আইনে একটি অধ্যায় সংযোজন করে দ্রুত ‘মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইন এবং মুক্তিযুদ্ধের ভিকটিমদের ক্ষতিপূরণ আইন’ প্রণয়ন করুন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুনতাসির মামুন বলেন, শহীদের সংখ্যা বিষয়ে সংশয় প্রকাশ করে খালেদা জিয়া এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, রাজনৈতিক বক্তব্য এমন হতে পারে না। এগুলো এক ধরনের পরিকল্পিত ইতরামি ছাড়া কিছু নয়। এমন বক্তব্য হঠাৎ করে মুখ ফসকে বেরিয়ে এসেছে, এমনটি নয়।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লক্ষ শহীদের সংখ্যাটি বঙ্গবন্ধুর আগেও বিদেশি গণমাধ্যমে উঠে এসেছিল। যতদূর মনে পরে, অস্ট্রেলিয়ান রেডিওতে এমনটি শুনেছিলাম। তাছাড়া তৎকালীন সরকার (মুজিবনগর সরকার) যখন শহীদের সংখ্যা ত্রিশ লক্ষ বলে বলেছিল, তখন তারা খোঁজ-খবর নিয়েই বলেছে। সামান্য কিছু এদিক-সেদিক হতে পারে। কারণ সেই মুহূর্তে লাশ গুনে গুনে শহীদের সংখ্যা নির্ধারণের মতো পরিস্থিতি ছিল না।
খাদেলা জিয়া ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যা বক্তব্য দিচ্ছেন তার মধ্যে যোগসূত্র রয়েছে উল্লেখ করে মুনতাসির মামুন বলেন, যতই প্রতিবাদ করা হোক না কেন, খালেদা ও গয়েশ্বর কি এমন বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকবেন? উনারা আগেও এমন নানা বক্তব্য দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ অস্বীকার অপরাধ আইনটি পাস করা হলে, এ ধরনের কথাবার্তা বন্ধ হবে। আইনটি দ্রুত পাস করে এর পক্ষে জনমত সৃষ্টি করতে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তিনি।
সাংবাদিকের প্রশ্নের জবাবে শাহরিয়ার কবির বলেন, কোনো খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা যদি একাত্তরের গণহত্যা নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য বা সংশয় প্রকাশ করেন, তাহলে তার খেতাব কেড়ে নেয়ার জন্যও একটি আইন করতে হবে। পাকিস্তান রাষ্ট্র তাদের মিথ্যাচার চালিয়ে যাবেই। কিন্তু আমাদের দেশে কেউ এমনটি করলে ফৌজদারি আইনে তার সাজা নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়া ইন্টারনেটের (ইউটিউব বার্তা) মাধ্যমে কেউ অপপ্রচার চালালে তার বিরুদ্ধে আইসিটি আইনে ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশ সুপ্রিক কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, জানা মতে বিশ্বের ১৪টি দেশে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধীতাকারীদের শাস্তির আইন প্রত্যক্ষভাবে রয়েছে। এছাড়া আরো অনেক দেশে পরোক্ষভাবে তাদের দেশীয় আইনে শাস্তির ব্যবস্থা রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা হচ্ছে এক ধরনের ঘৃণা প্রচারের শামিল। এর ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও সংশয় সৃষ্টি হবে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যখন ক্ষমতায় আছে, তখন দাবি জানাই তারা যেন আর কালবিলম্ব না করে। খালেদা জিয়া এবং ডেভিড বার্গম্যানের মতো লোকদের যেন দ্রুত শাস্তির আওতায় আনা হয়।
বাংলাদেশের গণহত্যার শিকার যারা হয়েছেন তাদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দিতে পাকিস্তানের উপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগসহ ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা এবং একাত্তরের যুদ্ধশিশুদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব গ্রহণে আগ্রহী তাদের নাগরিকত্ব প্রদানের জন্যও সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়।
সংবাদ সম্মেলনে আরো উপস্থিত ছিলেন, ভাস্কর ফেরদৌসী প্রিয়ভাষীণী, ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ, শ্যামলী নাসরিন প্রমুখ।