চট্টগ্রাম: কর্ণফুলী নদীতে বহুল আলোচিত টানেলের সংযোগ সড়কের জন্য উদ্বাস্তু হওয়ার আশংকা করছে প্রায় সাড়ে তিন’শ পরিবার। তাদের আশংকা সংযোগ সড়ক নির্মিত হলে তাদের বাড়িঘর, জমিজমা, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, স্কুল এমনকি শহীদ মিনার পর্যন্ত বিলিন হয়ে যাবে।
বাড়িভিটা হারানোর আশংকায় কর্ণফুলীর দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলার বৈরাগ ইউনিয়নের দক্ষিণ বন্দর গ্রামের বাসিন্দারা এখন প্রশাসনের দ্বারে দ্বারে ঘুরছেন। জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে স্মারকলিপি দিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।
এলাকার বাসিন্দা দোদুল দত্ত বলেন, টানেল নির্মাণের ফলে কর্ণফুলীর দুই তীর সংযুক্ত হবে। এটা আমাদের জন্য অনেক বড় একটা পাওয়া। আমরা এতে আনন্দিত। কিন্তু আমরা জানতে পেরেছি, টানেলের সংযোগ সড়কের জন্য যে স্থান নির্ধারণ করা হয়েছে তা আমাদের বাড়িঘরের উপরে।
‘অতীতে সিইউএফএল, কাফকো, কেইপিজেড এর জন্য আমরা জায়গা দিয়েছি। যেটুকু অবশিষ্ট আছে তা টানেলের সংযোগ সড়ক নির্মাণ হলে চলে যাবে। আমরা তো উদ্বাস্তু হয়ে যাব। পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে আমরা কোথায় যাব ?’ বলেন দোদুল দত্ত।
বন্দরনগরী চট্টগ্রামে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার দীর্ঘ টানেল নির্মাণ করে কর্ণফুলী নদীর দুই তীরকে যুক্ত করতে গত ২৪ নভেম্বর সাড়ে আট হাজার কোটি টাকার একটি প্রকল্প অনুমোদন করেছে সরকার। টানেল নির্মাণের জন্য ২০১৪ সালের ১০ জুন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে বেইজিংয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছিল।
এরপর বাংলাদেশ সেতু র্কতৃপক্ষ, চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) ও অভি অরুপ অ্যান্ড পার্টনার্স হংকং লিমিটেড যৌথভাবে টানেলের কারিগরি ও অর্থনৈতিক সমীক্ষা করে। চলতি বছরের ৩০ জুন সেতু কর্তৃপক্ষ ও সিসিসিসির মধ্যে হয় বাণিজ্যিক চুক্তি। ২০২০ সালের মধ্যে টানেলের কাজ শেষ করার টার্গেট নিয়ে এখন জমি অধিগ্রহণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
দোদুল দত্ত জানান, নভেম্বরের শুরুতে তাদের এলাকায় গিয়ে ভূমি পরিমাপ করা হয়। এরপরই মূলত লোকজনের মধ্যে ভিটেমাটি হারানোর শংকা সৃষ্টি হয়েছে।
এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, মুক্তিযুদ্ধের সময় দক্ষিণ বন্দর গ্রামের অনেক লোক শহীদ হয়েছিলেন। পুরো এলাকা গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণের জন্য গ্রামে নির্মাণ করা হয়েছিল শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্স। সংযোগ সড়ক যদি দক্ষিণ বন্দর গ্রামের ভেতর দিয়ে যায় তাহলে শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্সটিও বিলিন হবে। শহীদদের কবরও বিলিন হবে।
স্থানীয় এক বাসিন্দা বলেন, আমাদের গ্রামের অধিকাংশ লোক গরীব। মুক্তিযুদ্ধের যাদের বাড়ি পুড়ে দেয়া হয়েছিল তাদের অনেকেই এখনও বাড়িঘর তৈরি করতে পারেননি। উচ্ছেদ করলে আমরা কোথায় যাব? আমাদের জমিজমা যদি নিয়ে যাওয়া হয় আমরা কিভাবে চলব ?
পিতৃপুরুষের ভিটে হারানোর আশংকায় ১৫ নভেম্বর দক্ষিণ বন্দর গ্রামের বাসিন্দারা এলাকা সংসদ সদস্য ও ভূমি প্রতিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদের কাছে স্বারকলিপি দেন। প্রতিমন্ত্রী এ বিষয়ে চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মেজবাহ উদ্দিন আহমেদকে দায়িত্ব দেন। জেলা প্রশাসক আনোয়ারা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ সাইফুল ইসলামকে সংশ্লিষ্ট এলাকা পরিদর্শন করার নির্দেশ দেন।
ইউএনও মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম মজুমদার বলেন, আমি এলাকায় গিয়ে গ্রামবাসীর বক্তব্য শুনেছি। তারা বাড়িঘর হারানোর আশংকা করছেন। তাদের এ বিষয়ে আবেদন করতে বলেছি। যেহেতু আমি সরকারি পদে আছি আমাকে তো সরকারের নির্দেশ অনুযায়ীই কাজ করতে হবে। তারা যদি আবেদন করে সেটি আমি সরকারের কাছে পাঠিয়ে দেব।
ভিটেমাটি রক্ষায় এখন দক্ষিণ বন্দর গ্রামে নিয়মিত মিছিল-সমাবেশ করছেন বাসিন্দারা। ১৫ ডিসেম্বর তারা জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়েছেন।
দোদুল দত্ত বলেন, সংযোগ সড়ক নির্মাণের জন্য বিকল্প রাস্তা আছে। কিন্তু সেটা বাদ দিয়ে আমাদের বাড়িঘরের উপর দিয়ে কেন সেটা নির্মাণের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে সেটা আমরা জানিনা। এটা সাড়ে তিন’শ পরিবারকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র বলে আমরা মনে করছি। আমরা অসহায় মানুষ। আমরা এখন মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি।