ছন থেকে, “কে ও? ঘাটে কে রে?”
বটুক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে বেনেপুকুরের ধীরেন খুড়ো। মোলো যা – আর আসবার সময় পেল না! মরতে এখনই উদয় হতে হল? বুড়োর নব্বইয়ের কাছে বয়স। সারাদিন এপাড়া ওপাড়া টইটই করছে। চোখেও তো ভাল দেখেনা। এমন আদাড়বাদাড়ে সেঁধোল কেমন করে?
– তুই কে বাপ?
– “বটুক। তুমি এখানে কী করছ?” বটুক খেঁকিয়ে ওঠে।
– বটুক? ঢ্যামনা বটুক?
কথাটা শুনে বটুক একটু গলা খাঁকড়ে ইতস্তত করে আশপাশ দেখে আস্তে করে বলল, “হ্যাঁ!”
– “অ, তাই বল। তা বসি একটু তোর পাশে,” বুড়ো সাবধানে ঘাটের সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসে বটুকের পাশে।
– কেন? আমার পাশে বসে কী করবে?
– “নাহ্, করার কিছুই নেই। একটু কথা কই,” বুড়ো বসে বলে, “তা তুই সক্কাল সক্কাল এখানে যে বড়?”
– মরতে এসেছি!
– তা ভাল! আমার তো আর আসে না, তোরাই যারা যারা পারিস চলে যা।
– তা তুমি এখানে কী করছ? চোখেও তো দ্যাখো না – ছাতার মাথা কোথাও পড়ে থাকলে দেখবে কে?
– না না, দেখবে আবার কে? এতকাল ধরে ছেলেরা দেখে এল – এখনও দেখবে? ওকথা মুখে আনাও পাপ! তা যাকগে আমার কথা। বলছিলাম কী ছান করবি তো?
– তুমি তোমার কাজে যাও তো!
– “বলে দ্যাকো! এক আমি, তায় আমার আবার কাজ। দে, একটা বিড়ি দে দেখি,” ধীরেন হাত পাতে।
বটুক অনিচ্ছাসত্ত্বেও নমো নমো করে একটা বিড়ি এগিয়ে দেয়। মেলা জ্বালা! যদিও এক বান্ডিল আছে, তবু অমন দুমদাম বিলোলে চলবে কেন? বটুক অনেক ভেবেচিন্তে বড় বান্ডিল কিনেছে, সঙ্গে গোটা দেশলাই। মরার পরক্ষণ থেকে মরে থিতু হওয়া পর্যন্ত কতটা সময় বা কেমনতর রাস্তা – কিছুই জানা নেই। বিড়ি দেশলাই থাকা ভাল!
– তা হ্যাঁরে ঢ্যামনা, ন-টা তো বেজে গেছে সেই কখন। আজ দোকান খুলবি না?
– “গেলে তুমি?” বটুক এবার চেঁচিয়ে ওঠে।
– দ্যাকো কান্ড! রাগ করলি নাকি বাপ?
– থাক! এখন বিড়ি খেয়ে দয়া করে বিদেয় হও।
– ও কী কথা! বিদেয় হব কোন চুলোয়? তার চেয়ে আমি বরং এখানে বসে তোর চটিজোড়া পাহারা দিই। তুই ছান-টান সেরে নে। তারপর একসাথে চলা যাবে। পারলে গামছাটাও রেখে যা। উদোম হয়ে পুকুরে ছান – ওহ্, সে ভারী মজা!
– “আহ্, তুমি থামো তো দেখি!” উদোম হয়ে নামতে বটুকের বয়েই গেছে। গামছার গিঁটে বিড়ি দেশলাই বেঁধে নিতে হবে না? চিন্তা একটাই, শালা জলে ভিজে বিড়িগুলো ফের জ্বলবে তো? অবিশ্যি মরার পর যদি বটুক ফের জেগে উঠে বিড়ি ধরাতে পারে, তবে ভেজা দেশলাইও বা জ্বলবে না কেন? ঠিক কথা, এ হাতছাড়া করা যাবে না। খুড়োটা পাগলাটে মেরে গেছে। বয়স বেশি বেড়ে গেলে এইই হয়! গলাটা একটু খাঁকরে বটুক বলল, “তোমায় কে বলল চান করতে নামব? বললাম না তখন মরতে এসেছি? এখানে ডুবে মরব।”
– হ্যাঁ, তা তো বললি। তুইও বললি – আমিও শুনলাম। ভেবেছিলাম রসিকতা করছিস!
– না, রসিকতা নয়।
– “আহা! কতদিন যে মরণ দেখি না। তা তুই মর, আমি দুচোখ ভরে দেখি!” তারপর নিজের মনেই বিড়বিড় করে বুড়ো, “তাই বা কী করে। শালা চোখেও তো ঠিকমত…” পরক্ষণেই ফের বটুকের দিকে ফিরে, “তা সে যাই হোক। তুই মর বাবা মর…নিশ্চিন্তে মর দেখি!”
– আমি মরব আর তুমি দেখবে? আমায় বাঁচাবে না?
– রাম রাম! ও কেউ করে? সেই যেবার সান্নিপাতিক হল, তুই বগলদাবা করে ভবেন ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলি। ওহ্ – সে সারারাত ধরে ওষুধ গিলিয়ে সেবা করে তবে আবার ফিরিয়ে আনলি। আছোলা দিয়েছিলি বাপ! তখন বুঝিনি। সেই যে ফিরে এলাম – চারটে বচ্ছর গড়িয়ে গেল – আর যাওয়ার নাম করি না গো।
– যাবে কেন? দিব্যি তো আছ।
– তা থাকলেই বা। তাই বলে যাব না? রয়েই যাব?
– আহা তা যাবে না কেন? যাবে তো সবাই। কিন্তু একটা কারণ থাকবে তো? অমন ফস করে যাওয়া যায় নাকি?
– বুড়ো মানুষের আবার কারণের অভাব? এই তো, কাল রাত থেকে বুকের বাঁদিকটা চিন চিন করছে। এর ধাক্কাতেই তো যেতে পারি। তার ওপর হাঁপানি জাপানি নাকানি চোবানি – কত কিছু। থেকে থেকে মাথা ঘুরে পড়ে যাই। সেদিন পঞ্চা বলল আমি নাকি খাটেই হেগেমুতে একসা করেছি। তবে? ওরে আমার কি যাওয়ার কারণের অভাব?
– অ!
– তা আমার কথা ছাড়ান দে। তোর কথা বল। দিব্যি তো সংসার করছিলি। আবার যাওয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগলি যে বড়?
ফুরফুরে হাওয়ায় বসে বটুক ভাবে, তা বটে – এক্কেবারে চলে যাওয়ার মত কারণ ঘটেনি বটে, তবে জীবনটা বড় পানসে ঠেকছে। থেকেও যে সে বিশেষ কিছু করে উঠতে পারবে না, তা বটুক বেশ বুঝে গেছে। সবই কেমন যেন নিয়মমাফিক ঘটছে। শালা কোনও ওঠাপড়া নেই। সেই এক সকালে ওঠো, বাজার কর, চান কর, দোকান খোল, সারাদিন ব্যাবসা কর, সন্ধেবেলা পরানটা ছুক ছুক করলে দু-পাত্তর গেল, বাড়ি ফিরে হত্তুকির সঙ্গে একটু খুনসুটি কর, তার মেজাজ ভাল না থাকলে দু-চারটে চোখা চোখা বিশেষণ শোন, রাতে গান্ডেপিন্ডে গেল, চোখ বোজ। ব্যস, ফের সকাল চলে এল। এই একই কেত্তন চলেই চলেছে। ধুর ধুর!
হত্তুকিটাও যেন কেমন! বর শান্তিতে আত্মহত্যা করতে পারবে, এমন দু-একটা কাজও কী করতে নেই রে ভালমানুষের মেয়ে? কই, দিগম্বরের বউ তো অমন নয়। এটা চাই ওটা চাই করে – তারপর এর ওর সাথে ফষ্টিনষ্টি করে দিগম্বরকে জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষমেশ গলায় দড়ি দেওয়ালো তো! তারপর হচ্ছে গিয়ে চাষিপাড়ার হারাধনের বউ – সেই প্রোমোটার মদনের সঙ্গে ভেগে গিয়ে পোয়াতি হয়ে ফিরে এল। হারাধন দা দিয়ে কোপাতে গেছিল। আহা, শুনেও শান্তি! জীবনে কেমন সুন্দর একটা ওঠাপড়া আছে।
আর বটুক? নাহ্, এভাবে বাঁচার কোনও মানে নেই।
অবিশ্যি বটুক চাইলে অমন দু-একটা সন্দেহ জুটতেই পারে। এই যে কাগজ দেয় মৃত্যুঞ্জয় – হুঁ হুঁ, বটুক কি কিছু বোঝে না নাকি! অমন না চাইতেও রোজ বাড়িতে এসে “বটুকদাদা বটুকদাদা” করে বিক্রি না হওয়া কাগজ বিনি পয়সায় ধরিয়ে দিয়ে যাচ্ছে, সে কি এমনি এমনি? তারপর যাওয়ার সময় অমন অহেতুক ‘ক্রিং ক্রিং’ করে বেল বাজানোরই বা মানেটা কী? তা আসুক। বটুকের সেসবে আপত্তি নেই। জ্বালা হয়েছে এই এক হত্তুকি। এই যে ছোকরা রোজ এসে কাগজ পড়িয়ে যায়, তা তার সামনে কি একবারও বেরোতে নেই? এক-দুদিন তো একটু চা নিয়েও সাধাসাধি করতে হয়! তা না, নবাবের বেটি ভেতরে হেঁসেল সামলাচ্ছে। শালা বউটা মহা খচ্চর!
ফলে সন্দেহটা পাকব পাকব করেও পেকে উঠছে না। বটুক ভেবেছিল, দুটো দিন যাক। আপসে একটা গল্প তৈরি হবে। সে গুড়ে বালি! সেদিন দোকানের মেকানিক সুবল চারু সাইকেলে হাওয়া দিতে দিতে বলল, “ওহ্, এই হচ্ছে বৌদি! হাটে মিত্যুঞ্জয়কে ধরেছিল, ‘তোমায় ভাই টাকা নিতে হবে…না না, অমন রোজ রোজ বিনি পয়সায় কাগজ নিতে পারব না। আমার বর কাগজ নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে ভালবাসে, আর তুমি কাগজ বিক্রি কর…আমার বরং পয়সা দিয়েই পড়বো!’ ওহ্ – মিত্যুঞ্জয় একেবারে শুকিয়ে আমসি…কড়কড়ে নোটগুলো গুনে ধরিয়ে দিয়ে চলে গেল!”
বটুক ক্যাশ কাউন্টারে বসে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে সুবলের বক্তব্য শুনছিল। সুবল দেখে বলল, “কী হল? মুখখানা অমন করে রেখেছ কেন?”
– “ঠিক করে পাম দে!” বটুক খেঁকিয়ে উঠেছিল।
বিড়িটা পুকুরের জলে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে বটুক আবার ভাবতে বসল, সবাই মিলে এলাকা পানসে করে ছেড়ে দিল। এই যে সুবল – চার বছর ধরে বটুকের দোকানে সাইকেল মেরামতি করে। শালা যুধিষ্ঠিরের বাচ্চা! ওরে নিজে দোকান খুলিস, ব্যাবসা সামলাস, উদয়াস্ত খাটিস – তা ক্যাশবাক্স থেকে কি কখনও একটু আধটু টাকা পয়সা সরাতে নেই রে? আদ্দেক সময় তো বটুক দোকানেই থাকে না। ফিরে এসে দেখে যে কে সেই – পাই পয়সা গোনা। সুবল স্ক্রু টাইট দিচ্ছে। কই টাকাপয়সা মেরে দিয়ে ফেরার হয়ে যাবি বা নিজের দোকান বলে কোনও ধুরন্ধর কাউকে বেচে দিবি, সেই নিয়ে বটুক অথৈ জলে পড়বে, কোর্ট কাছারি হবে, মামলা মোকোদ্দমা…শেষমেশ রাস্তায় নামবে বটুক – নাহ্ অত সুখ বটুকের কপালে নেই। শালা উল্টে বউদির কেত্তন গাইছে।মুখে আগুন!
না না, অনেক হয়ে গেছে। অভাগা যেদিকে চায়, সাগর শুকিয়ে যায়। এখন শালা এই দিঘি শুকিয়ে যাওয়ার আগে এর ভেতরে গিয়ে পড়তে হবে।
– বললি না বাপ? মরতে এলি কেন?
– সুখের চোটে!
– তা ভাল। সবসময় অমন কষ্টেই মরতে হবে – না, এমন মাথার দিব্যি কেউ দেয়নি।
– তুমি কি আরেকটা বিড়ি খাবে?
– কেন বল তো? মানে দিলে খাব, কিন্তু হঠাৎ জানতে চাইলি যে বড়? আরেকটা বিড়ি কি খাওয়া উচিৎ?
বটুক ঝাঁঝিয়ে উঠল, “না, এবার দয়া করে এস। তুমি তো মাইরি আচ্ছা খুড়ো! সেই কখন থেকে বলছি যাও যাও, তা ওঠার নামই কর না। বলি গিয়ে লোকজনকে খবরটা দেবে তো – বটুক ডুবে মরেছে, লাশ তুলতে হবে!
– না না, তা তো বটেই। তবে তাই যাই। মানে চলেই যেতাম। তা তুই আবার ফস করে বিড়ি নিয়ে সাধাসাধি করলি কিনা – তা দে, বলছিস যখন, আরেকটা দে। টেনেই যাই।
বটুক অগত্যা আবারও একটা বিড়ি বার করল।
ধীরেন আয়েস করে বিড়িটা ধরাতে যাবে, দূর থেকে খোনা গলায় আওয়াজ এল, “ঘাটে কোন ঘাটের মরা রে?”
কাত্যায়নী – ফটিকের মেজোপিসি। দূরে বারান্দা থেকে ঠিক দেখেছে। অগত্যা বটুককে চেঁচিয়ে জবাব দিতে হল, “আমি বটুক, পিসিমা।”
– বটুক? কোন বটুক? ও – আমাদের চন্ডীতলার বটুক? চান করতে এলি বুঝি?
– না গো – মরতে এসেছে। বলছে ডুবে মরবে…
– “আহ্, কী হচ্ছে কী খুড়ো,” বটুক আলতো করে দাবড়ানি দেয়, “হ্যাঁ পিসিমা।”
– তা কর। যাওয়ার আগে ডানদিকের কচুরিপানাগুলো একটু তুলে দিস তো বাপ।
– “দেব পিসিমা,” শালা শান্তিতে মরারও কি জো আছে? বটুক ধীরেনের দিকে ফিরে বলল, “তোমার জ্বালায় দেখছি মরাটাই না বেহাত হয়ে যায়। তুমি চেঁচিয়ে জানান দিতে গেলে, আমি মরতে এসেছি?”
– অ, বলব না বলছিস?
– না, আগে মরি। তারপর লোকজন ডেক।
– আচ্ছা আচ্ছা। ভুল করে বলে ফেলেছি – এ কোন দোকানের বিড়ি রে? শালা টানতে গেলে হাঁপ ধরে যাচ্ছে। অ বটুক, বলছিলাম কী, বুকের ব্যথাটা যে বাড়ল বাপ।
– সে আবার কী? তা বুকে ব্যথা হচ্ছে তো বিড়ি খাচ্ছ কেন?
– নাহ্, পাক দিয়ে উঠছে বড়!
নাও – এবার বুড়োকে সামলাও। তার ওপর ডানদিকের কচুরিপানাও তুলতে হবে। হাজার ঝামেলার মধ্যেও বটুকের একটা সূক্ষ্ম আনন্দ হচ্ছিল। সেটা এই ভেবে যে, মরার আগেও কচুরিপানা তুলতে হচ্ছে – মরার জন্য বোধহয় এই কারণই যথেষ্ঠ!
বটুক ঝপাস করে জলে লাফ মারল। ধীরেন একবার চমকে উঠে আবার সামলে নিয়ে বলল, “অ বটুক, বলি চললি নাকি?”
বটুক ততক্ষণে সাঁতরে ডানদিকটায় চলে এসেছে। কচুরিপানা ডাঁটিগুলো ধরে টান মারতে মারতে বলল, “না, চললাম আর কোথায়? শুনলে না কচুরিপানাগুলো তুলে দিতে বলল?”
– তাই বল, আমি ভাবলাম বুঝি…তা ভাল কথা মনে পড়ে গেল। পঞ্চাননতলার সরস্বতী ঠাকুর এখনও বিসর্জন যায়নি, এই বলে রাখলাম। এ পুকুরেই ফেলে কিন্তু। তা তুই মরবি, তার পর ভাসান হবে তো এখানে? নাকি ঠাকুর আবার গঙ্গায় নিতে হবে?
– কেন? এ পুকুরে ফেলবে কেন? কালুদের পুকুর কী হল?
– সে আমি কী জানি? নব বলছিল ফটিকদের পুকুরের কথা – ফস করে মনে পড়ে গেল, তাই বললাম।
নাহ্, ভগবানও আজ বাঁশ দেওয়ার মুডে আছে। সাতে নেই পাঁচে নেই – নিজের মনে বেলাবেলি একটু মরব, তাতেও রাজ্যের ক্যাচাল – ফটিকের আনন্দ মেশান বিরক্তিটা আস্তে আস্তে বাড়ছে। ফটিক অবিশ্যি এটাই চায়। বেঁচে থাকার মত মরাটাও পানসে হবে, সে বড় যন্ত্রণার! চারপাশে সৎ আর ভালমানুষের ঠেলা বড্ড চাপের। কী – না বউটা সতী, দোকানে কাজের ছেলেটা সৎ! ব্যাবসা রম রম করে চলছে, অতএব পয়সার দুঃখুও এড়িয়ে গেল। শরীরে রোগভোগও বাসা বাঁধল না। এমন নির্ঝঞ্ঝাট জীবন নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে চলে যাওয়া ঢের ভাল। সেই যেতে গিয়ে সকাল থেকে কেত্তন। টিক টিক করে বুড়ো দেরি করিয়ে দিল। এখন কচুরিপানার চাপ। সেটা সামলাতে না সামলাতে বলছে ভাসান হবে কোথায়!
– ও বটুক! মরলি নাকি?
– ধুত্তোর!
– যাক, আমি ভাবলাম গেলি বোধহয়!
– কী হয়েছে?
– না, ধুতিটা কেমন জানি পেসল পেসল লাগে। আমি কি করে ফেললাম?
– অ্যাঁ, কী বিপদ? আরে পাশটাতে আমার চটিজোড়া যে। দেখো খুড়ো, আবার লেবড়ে-ঝেবড়ে একাকার কোর না। মেলা জ্বালা!
– পেটটাও কাল রাত থেকে কেমন কেমন যেন…
– “তুমি মরতে সকালে বেরোতে গেলে কেন,” বটুক তারস্বরে চেঁচিয়ে ওঠে।
– না না, করে ফেলব জানলে কী আর বেরোতাম? সকালে অবিশ্যি কুমোরপাড়ার পুটুও এক কথা বলল, ‘তুমি এ শরীর নিয়ে বেরিয়েছ কেন?’ বেরুবো না? না বেরুলে আর পাঁচটা লোকের সঙ্গে দেখা হয়? সারাক্ষণ ঘরে থাকতে…পুটু – ওমা তুই পুটুকে চিনলি না? হারান পোদ্দারের মেয়ে। সেই যে বচ্ছর দুই আগে বে হল। তা মেয়ে তো বেধবা হয়েছে। এখন আবার বাপের ভিটেতে এসে গেঁড়ে বসেছে। আরে পুটু রে…
– “জানি জানি,” বটুক বিড়বিড় করে।
…অ্যাদ্দিন পর আবার পুরনো কাসুন্দি…এতকিছু কি আজই জানার ছিল? বটুক চুপচাপ কোমর জলে দাঁড়িয়ে থাকে।
পুটু…
বটুকের প্রথম প্রেম। সেই চার বছর আগে রাসমনির মাঠে ফুচকা খেতে খেতে বটুক যাকে প্রথম বলেছিল, “পুটু, তোমাকে আমার…”
– ও বটুক, পেটটা বোধহয় সত্যিই…
বটুক দিঘির জলের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। ওহ্, সে কী চলাফেরা। পেছনে ছেলেছোকরাদের লাইন লেগে যেত। সে কী ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখা – ওরে বাবা, সে কী চাহনি! পুটু বলেছিল, “আমায় বিয়ে করবে, তা খাওয়াবে কী?”
– বাবা, বুকের ব্যথাটাও যে…ও বটুক!
তারপর সেই গোষ্টদের বাগান…রাত্তিরবেলা।
…পুটুর সে কী খিল খিল করে হাসি।
…বটুক বলদের মত বোঝাতে গেছিল যে সে পুটুকে কতটা ভালবাসে। পুটু হেসে বলেছিল, “ধুর, তুমি পার না!” ওহ্, কথাটা কাঁটার মত বিঁধেছিল গো!
– ওরে বাবা, ও বটুক…আমার ভেতরে কেমন যেন হচ্ছে রে…
সেই পুটু বেধবা হল? এখানে এসে উঠল আবার?
…মানে আবারও আশপাশে ঘুরঘুর করবে?
মাঝ দিঘিতে কী বেশ একটা ঘাই মারল।
– ওরে বটকে রে…আমি গেছি!
চটক ভাঙে বটুকের। “কী হলটা কী? তুমি তো আচ্ছা জ্বালালে দেখ…” ধীরেনের দিকে তাকিয়ে চুপ করে যায় বটুক। সব্বোনাশ! বুড়ো তো ঘাটে চিৎ হয়ে পড়ে আছে! ওমা, এ যে গোঁ গোঁ করছে! বটুক হ্যাঁচোড়প্যাঁচোড় করে এগিয়ে আসে, “ও খুড়ো, কী হল গো?”
– বুকটা…নিশ্বাস নিতে…অফ!
বটুক তড়িঘড়ি জল থেকে উঠে আসে। এ কী অবস্থা! বুড়োর চোখমুখ উল্টে এ কী কাণ্ড, “ও খুড়ো, ও খুড়ো! আরে হচ্ছেটা কী? অমন করছ কেন?”
– “আমি আর নেই রে,” কোনওরকমে জবাব দেয় বুড়ো। হাত দিয়ে বুকের কাছটা ডলতে থাকে।
সব্বোনাশ! “ভেবো না, ভেবো না” বলতে বলতে বটুক চকিতে ধীরেনকে কাঁধে পাশবালিশের মত তুলে ফেলে। দূরে ফটিকদের বাড়ির বারান্দা থেকে আওয়াজ আসে, “ও বটুক, ও কাকে কোলে নিচ্ছিস রে? কচুরিপানাগুলো…”
– “বিকেলে করে দেব পিসিমা,” ধীরেনকে বইতে বইতে বটুক পুকুরপাড় ধরে হন হন করে রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। মরবে? অত সোজা? চেঁচায় সে, “ধীরেন খুড়ো ফিট হয়ে গেছে গো! ওই রতন – রতনাআআআ!”
রতন ভ্যানওয়ালা ইস্কুল মাঠে ইঁট ফেলে ফাঁকা গাড়ি নিয়ে স্টেশনের দিকে যাচ্ছিল। আওয়াজ শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়, ভ্যান আস্তে করে, “এ কী গো? কী হল?”
– পুটু বেধবা হয়েছে!
– অ্যাঁ?
– “না না, বলছি ধীরেন খুড়ো ফিট গেছে রে,” বটুক দৌড়োতে দৌড়োতে বলে, “চল চল, হাসপাতালে নিতে হবে। দেরি হলে বাঁচান যাবে না।”