কবরটি মিথ্যে কথা বলেছিল:
যুবক শেয়ালটা তার মুখ দিয়ে ক্ষুধা প্রকাশ হতে পারে অথবা ক্ষুধার্ত থাকলে যে ধরনের আওয়াজ হতে পারে তেমন একটা আওয়াজ করে। এরপর ঝোঁপটির ভেতরেই শুয়ে থাকে নির্জীবের মত। ধুকধুক করতে থাকে তার পেট আর বুক। চোখ দুটো বুঁজে থাকে। কিছুক্ষণ চোখ বুঁজে থাকার পর আবার ক্ষুধামাখা দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকায় যেদিকে যেভাবে মুখ আছে সেদিকে সেভাবেই। চোখ বোঁজা আর চোখ খোলা ব্যাপারটা চলছে। কিছুক্ষণ জীব আর কিছুক্ষণ নির্জীব খেলার ভেতর রয়েছে শেয়ালটা। প্রচুর গরম রয়েছে চারদিকে। এই গোরস্থানটিই যা একটু ছায়াঘন আর শুনশান শান্তির আবাসের মত। যে গোরস্থানটি সে ছেড়ে এসেছে অথবা যে গোরস্থান থেকে তার জ্ঞাতিরা তাকে তাড়িয়ে দিয়েছে সে গোরস্থানটিও ভাল ছিল।
শেয়ালটি একবার লেজ নাড়ল অলসভাবে, মাছি বা পিঁপড়া তাড়াতে অথবা নিজের অস্তিত্ব নিজেকে জানান দিতে। যখন বুঝল, সে তার ভূগোলে আছে তখন যুবক শেয়ালটি আসন পরিবর্তন করে লম্বা হয়ে শোয়। সামনের পা দুটো সামনে সোজা করে, অনেকটা রেললাইনের মত, পায়ের রেললাইনের মধ্যে মাথাটিকে সোজা করে শুইয়ে রাখে। একটা মাছি তার মাথার কাছে বা মগজের কাছে বা মগজের ভেতর গুনগুন করছে। মাছিটিকে তাড়ানোর মত তার শক্তি নেই। নির্লিপ্তভাবে সে মাছির উপদেশ শুনছে। মাছিটা কী কী জানি বলতেই আছে। ভনভন করতে করতে মাছিটা নাকের সামনে এলে জোরে একটা শ্বাসের তীর ছুঁড়ে তাড়াতে চাইল মাছিকে। শ্বাসের তীর মাছিকে বিদ্ধ করল না। শ্বাস-তীর মাছিটার গায়ে আলতো সুড়সুড়ি তৈরি করলে মাছিটা বুঝে নেয় শেয়ালটার ভূগোলে একটা মৃত্যুশিশু জন্ম নিয়েছে। মৃত্যুশিশুটি বড় হচ্ছে-
………………………………………………………………………………………………………………..
মৃত্যুশিশুটি কিছুক্ষণের মধ্যেই যুবক হয়ে গেলে যুবক শেয়ালটির সাথে আয়ু নিয়ে ফুটবল খেলা শুরু করবে। শেয়ালটির নিজের শরীরও মৃত্যুর কাছে হেরে যাবার জন্য শেয়ালের বিরুদ্ধে শক্তি সঞ্চয় করছে।
…………………………………………………………………………………………………………
মাছিটা যুবক শেয়ালের কানের কাছে বলতে থাকে- ‘তুমি মরে যাচ্ছ না কি হে? ভাল ভাল, মরে যাওয়াই ভাল, তুমি মরে গেলেই তোমার উপর ডিম পাড়ব, আমার বাচ্চা হবে, তখন আমি মরে যাব।’ ক্ষুধাক্লান্ত শেয়াল তার মনোযোগের স্টিয়ারিং মাছির দিক থেকে অন্যদিকে ফেরানোর উদ্যোগ করে। আগের গোরস্থান, যে গোরস্থানটি সে ছেড়ে এসেছে তার স্মৃতিসিনেমা দেখার চেষ্টা করে। ঐ লাশস্থানের পাশ দিয়েই রেললাইন গেছে দূরের দিকে। মানুষ কাটা পড়ত না তেমন কারণ সেখানে কোনো স্টেশন ছিল না। তবে মাঝে মাঝে কেউ কেউ আত্মহত্যা করতে আসত শেষরাতের দিকে। আত্মহত্যা সমাপ্ত হবার পর, শেয়ালেরা বুঝে উঠতে উঠতেই ভোর হয়ে যেত, লোকজন চলে আসত। কোনো কোনো ক্ষেত্রে এক-আধ কামড় মাংস বা রক্ত চেটে নেয়া যেত আত্মত্যাগীর আত্মীয়গণ চলে আসার আগেই।
ট্রেনের তলায় যে লোকেরা আত্মহত্যা করে তারা তবু কিছুটা ভাল, তাদের আত্মহত্যার জন্য অল্প হলেও টাটকা মাংস বা রক্তের মত জিনিসের স্বাদ পাওয়া যায়। কিন্তু অনেকেই আছে যারা আত্মহত্যা করে বিষ খেয়ে অথবা গলায় দড়ি দিয়ে গাছে বা নিজেদের ঘরে। এধরনের আত্মহত্যাকারীগণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কোনো কাজে আসে না। যারা ঘরের ভেতর আত্মহত্যা করে তারা বেশি অভিমানি, সংসারীয় বাস্তবজ্ঞান তাদের কম আর ঘরে আত্মহত্যা করার কারণে তাদের মাংস খেতে পাওয়া যায় না, কবর দেবার আগে। যারা বাইরে, গাছের সাথে দড়ি বেঁধে আত্মহত্যা করে তারা বেশ ভেবে চিন্তেই আত্মহত্যা করে। তারা বেশ বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ। যুবক শেয়াল এগুলো ভাবে। ভাবতে ভাবতে, বাইরে আত্মহত্যা করার একটা ঘটনা তার মনে পড়ে, সে রাতে সে একটা বাড়ির দিকে যাচ্ছিল মুরগি চুরি করার জন্য এবং ডিঁহিতে পা দেয়া মাত্রই খিড়কির কাঁঠালগাছটির কাছে আত্মহত্যেচ্ছু লোকটিকে দেখতে পাই। প্রথমে সে লোকটিকে চোর ভেবেছিল। তারপর ভেবেছিল প্রেমিক। তারপর ভেবেছিল গৃহেরই কেউ একজন। যাই হোক, লোকটিকে দেখে সতর্কতার সাথে সে যেখানে ছিল সেখানেই নিঃশব্দে বসে যায়।
লোকটার গাছে দড়ি বাঁধা আর এদিক ওদিক তাকিয়ে ঝুলে পড়ার দৃশ্যগুলো খুব মনোযোগ দিয়ে, লালা ঝরাতে ঝরাতে দেখেছিল যুবক শেয়াল। লোকটির দেহের সাথে মৃত্যুর সিলমোহরের স্থায়ি ছাপ পড়েছে কি না তা পাঠ করে সে। কিছুক্ষণ পর লোকটির শরীর নিথর হয়ে গেছে বুঝতে পারলে খুসি হয়ে ওঠে আর গুটি গুটি পায়ে সেদিকে এগিয়ে যায়। গিয়ে দেখে লোকটির শরীর ঈশপের গল্পের আঙ্গুরের থোকা হয়ে গেছে। অনেকক্ষণ চেষ্টা করেও সে লোকটির পায়ে একটা চাটাও দিতে পারে না। খুব উঁচুতে লোকটি তার ফাঁস বেঁধেছে। লোকটির মাংস ক্ষিধের সাথে তো মিললই না, ফাঁকতালে মুরগির হিসাবটিও বিয়োগপ্রাপ্ত হলো। সুতরাং সে রাত তাকে অভুক্ত থাকতে হয়েছিল। আর বিষ খেয়ে আত্মহত্যাকারী লোকতো আরও একটা হত্যাকারী। একজন খুনি। ঐ গোরস্থান এলাকার একজন বিষ খেয়ে মরেছিল এবং তার মাংস খেয়ে শেয়ালদের কেউ কেউ অসুস্থ হয়ে মারা গেছিল। পোকামাকড়ও নিশ্চয় কিছু কিছু মারা যায় বিষ খাওয়া মানুষের বিষাক্ত শরীর ভোজন করতে গিয়ে। শেয়ালটা এখানে আসার পর একটা কবরও হয়নি। পরে বুঝতে পেরেছে এটা একটা পরিত্যক্ত লাশখানা।
শেয়ালটি আবারও ক্ষুধা কাতর একটি আওয়াজ করে এবং জোরে জোরে শ্বাস নেবার চেষ্টা করে। শুয়ে থাকে। দু’তিন দিন সে কিছু খেতে পাইনি। ‘ঢুকে যাচ্ছি ক্ষুধার ভেতর, ক্ষুধার খর স্রোতে ভেসে যাচ্ছি’ ঠিক এধরনের ভাবনার সময় বেশকিছু মানুষের পদধ্বনি শুনতে পেল। ঝোঁপের আড়ালেই যুবক শেয়ালটি শিশুর মত টলমল পায়ে উঠে দাঁড়ায়, জুল জুল করে তাকিয়ে দেখে ক্ষুধাভাঙ্গা চোখে। কয়েকজন লোক এসে, উত্তরের দিকের কোণে একটা কবর খুঁড়তে শুরু করল। শেয়ালটার চোখ একটু উজ্জ্বল হয় এবং ক্ষুধাটা আরো একটু চাগা দিয়ে উঠলে বুঝতে পারে, সে বেঁচে আছে। শুয়ে শুয়ে ধুকধুকায়। চোখ বন্ধ করে।
কোদালের কোপের শব্দ তার কাছে একধরণের সঙ্গীতের মত বাজে। সে কোদালের কোপ গুনে, সে মিষ্টি কোদালছন্দ গুনে এক… দুই… তিন…। বিড়ির গন্ধ দূর থেকে ভেসে আসে। চার… পাঁচ… ছয়। মানুষের মাংসের সুগন্ধ তার মগজের কল্পনার ভেতর মৃদু পায়ে হাঁটে। সাত… আট… নয়…। দু’একজন বিড়ি টানছে। কোদাল-মাটির ছন্দগন্ধ মাংসের গন্ধে রূপান্তরিত হয়ে তার পেটকে, নাককে, মনকে উত্তেজিত করে তুলছে। যারা বাঁশ কাটছে আর যে কবরকর কবর খুঁড়ছে সে বিড়ি টানছে না। শেয়ালটা শুয়ে শুয়ে গা ঘঁষটে ঘঁষটে একটা অবস্থান তৈরি করে, যাতে ঝোঁপের ভেতর থেকে শুয়ে শুয়েই কবর খোঁড়ার জায়গাটা সম্পূর্ণ দেখা যায়। একহাত মাটি শক্ত তারপরে বালু। খুব সহজেই খোঁড়া যাচ্ছে। কবর খোঁড়া লোকটি ধীরে ধীরে কোমর সোজা করে দাঁড়ায় আর হাঁপায়- ‘লাহু হামাকে বিড়ির আর্ধেকটা দিস’। লাহু বলে- ‘লিয়্যা যাও- কদ্দুর আগাইলো গোরের?’ ‘এই হয়্যা গেছে, বালু চলাইসসে আর বেশিক্ষণ লাগবে না কবরকারিগর বললে, লাহু নিজেই এসে বিড়িটা তার হাতে দেয় আর কবরের গভীরতা দেখে।
কিছুক্ষণের জন্য কোদালের কোপ সঙ্গীত বন্ধ হলে শেয়ালটা চোখ খোলে। পেটের ভেতর ক্ষুধার করুণ বিষাক্ত সাপের ছোবলের মত গান তার প্রাণ ধরে উপড়ে নিতে চায়। বিড়ি বিরতীর পর আবার কবর খোঁড়া শুরু হয়। শেয়ালটি চোখ বন্ধ করে। কিছুক্ষণের মধ্যে কবর খোঁড়া সম্পন্ন হলে খননকারী কবর থেকে উঠে দাঁড়ায় আর শান্ত ক্লান্ত হাসি নিয়ে বাঁশ কাটাদের কাছে যায় ‘হামারতো হয়্যা গেছে, তোরঘে আর কদ্দুর কী?’ ‘এই হয়ে গেছে , বাঁশের পাটাতনে শেষ পেরেকটি ঠোঁকে, যে পাটাতন করছিল সে। লাশ আসার অপেক্ষায় গোরস্থানের আমগাছটির নিচে বসে তারা। কিছুক্ষণের মধ্যে একটা লাশবাহী খাটিয়া আসে আগে আগে আর পেছনে রয়েছে কয়েকজন। কোনো দোয়া দরুদ ছাড়ায় লাশ দাফন করে লোকগুলো চলে যায়। শেয়ালটা একধরনের লোভের ভেতর পড়ে। সে উঠে দাঁড়ায় লোকগুলো চলে যাবার পরপরই আর ধীরে ধীরে হেঁটে যায় উত্তরের কোণার দিকে যেখানে নতুন কবরটি দেয়া হয়েছে। শরীরের প্রায় সব শক্তি সে পায়ে এনে জমা করে এবং বেশ সংযমির মত হাঁটে লোভটাকে চেপে রেখে কিন্তু আরও উগ্র করে। হাঁটছে ধীরে ধীরে। কবরটার কাছে পৌঁছে গিয়ে আতর বা গোলাপ জল বা চন্দনের গন্ধ সে পায় না। শত গরীব হলেও মৃতদেহের জন্য একটা বিলাসিতা করা হয়। এক্ষেত্রে কিছুই করা হয়নি।
শেয়ালটা পাশের ভাঙ্গা কবরটার দিক থেকে খোঁড়া শুরু করবে বলে ঠিক করে। লোকজন যখন চলে গেছে আর শেয়ালটা যখন কবরটার কাছে পৌঁছে গেছে তখন দূরে কোথাও মাগরিবের আজান শুরু হয়েছে। কবরের উপর দড়ি দিয়ে একটা কবরপ্যাঁচ করা হয় আর খেজুরের কাঁটা যুক্ত ডাল পুঁতে দেয়া হয়। এ কবরের ক্ষেত্রে তাও করা হয়নি। কবরটা সম্পর্কে একধরণের সংশয় জাগলেও সেটাকে তার পেটের ভেতরের ক্ষিধেটা টুটি টিপে ধরে এবং সংশয়টাকেই খাবার জন্য ব্যস্ত হয়। কিন্তু সংশয়কে খাওয়া যায় না। ক্ষিধেটা তার শক্তি নিয়ে পায়ের ভেতর এসে হাজির হয় আর শেয়ালটা আঁচড়ে আঁচড়ে ভাঙ্গা কবরের দেয়াল দিয়ে নতুন কবরের দিকে একটি সুড়ঙ্গ খুঁড়তে থাকে। খুঁড়তে খুঁড়তে এক একবার সে উপরের দিকে তাকায়, কেউ আসছে কিনা দেখার জন্য।
সংশয়টা বেশ ভারী হয়ে ওঠে যা অন্য সময় হলে বহণ করা কঠিন হতো। কিন্তু ক্ষিধেটা বেশ ধারাল ছুরির মত হয়ে সংশয়টাকে কেটে টুকরো টুকরো করে আর পা দিয়ে খুঁড়তে থাকে কবরের গা। নতুন কবরের গহ্বরে ঢুকতে খুব বেশি সময় লাগে না। মাংসগন্ধহীন লাশের কাফন ছিঁড়ে ফেলতে সময় লাগে না। কিন্তু অবাক হয় শেয়ালটা, বেকুব বনে যায় শেয়ালটা, কবরটির আচরণে। তখনের সেই সংশয়টি এবার একটি বাস্তবতার রূপ ধরে খামচে ধরে তাকে, তার টুঁটি টিপে ধরে। কবরের ভেতর থেকে সে আর বের হয়ে আসে না। সংশয়টি অসংশয় হয়ে বিরাট এক হা করে তাকে গিলে নেয়। বাঘের মত ক্ষিধেটা পেটের ভেতর থেকে বেরিয়ে, যুবক শেয়ালের টুঁটিতে দাঁত বসায়। ক্ষিধেটা তাকে আর বের হতে দেয় না কবর থেকে। সমগ্র শরীরে ক্ষিধের কলা, ক্ষিধের লাল লাল সুর। ক্ষিধেটা কটমট করে তার হাড় মাংস খায়। শেয়ালটি কবরের ভেতর থাকল আর বাইরে নিস্তরঙ্গ অন্ধকার।
কবরটির মিথ্যে বলার কারণ:
মৃতদেহ সামনে নিয়ে বসে ছিল রইসুদ্দীন ঘরামির বউ আর যারা আশেপাশের বাড়ি বা পাড়া থেকে এসেছিল সেই মহিলাগুলো। রইস ঘরামির বউ একরাশ পাতলা পোঁটা নাক থেকে পরণের কাপড়ে মুছে নিয়ে বলে-‘সকালে উঠে মনসুর মহাজনের বাড়ির চালা ছাওয়ার জন্য বের হবার সময় মালেকের বাপ “শরীর ভাল লাগছে না” বলে বারান্দার মাটিতেই শুয়ে পড়ে।’ রইস ঘরামির এমন হবার ঠিক আগক্ষণে রইস ঘরামির বড় ছেলে মালেক তার জন্মানো বাচ্চা-কাচ্চাদের ঝগড়া থামানোর চেষ্টা করছিল। মালেক যখন দেখে তার বাপ অসুস্থ হয়ে গেছে তখন বাচ্চাদের ঝগড়া থামানোর ঝগড়া বন্ধ রেখে বাপের বারান্দার কাছে আসে। মালেকের ছেলেগুলোও তার দাদার কী হয়েছে দেখার জন্য ঝগড়া বন্ধ করে দিয়ে বিস্ফোরিত চোখ নিয়ে বারান্দায় এসে দাদার দিকে তাকিয়ে থাকে।
রইস ঘরামির বউ একটা দড়ির খাট ঘর থেকে বের করে আনে আর একাজে সাহায্য করছিল তার ছোট পুত্রবধুটা। দড়ির খাটে সবাই মিলে ধরাধরি করে রইস ঘরামিকে ওঠায় এবং মাথায় পানি ঢালার আয়োজন করে। রইস ঘরামির বড় ছেলে মালেক তখনই তার বড় ছেলে ভুলনকে মনু কবরেজের বাড়িতে পাঠায়, তাকে ডেকে আনার জন্য। পানি ঢালতে ঢালতেই মনু কবরেজ এসে হাজির হয়। সে নাড়ি পরীক্ষা করে এবং ‘রইস ঘরামি মরে গেছে’ বলে মত জানায়। এটা শুনে প্রথমেই কান্না শুরু করে ঘরামির বউ এবং পরে পরে অন্যরাও কান্নার কাজটি শুরু করে দেয়। কান্নার শব্দপিঁপড়া পাড়ার অলিগলিতে ঢুকে আর মহিলাগুলোকে মুখে করে নিয়ে এসে ফেলে দেয় রইস ঘরামির বাড়িতে।
তারা রইস ঘরামির মৃত মুখের বাতাসের আওতায় চলে আসে। এসব পাড়াপড়শি মহিলারা এসে তাদের কান্নার ভেতরে একধরণের মন ভারী করা ভাব আনতে পারে কয়েকমিনিটের মধ্যেই। ছোট মসজিদের বড় এমাম এসে ‘লাশ বেশিক্ষণ রাখা ঠিক হবে না’ বলে ধোয়া দিতে বলে। মহিলাদের কান্না বন্ধ করতে বলে। ‘উচ্চস্বরে কান্না করা গুনাহ এতে মুর্দার কষ্ট আরো বেড়ে যায়’ একথা ছোট মসজিদের বড় এমাম বললে কান্নাটা হঠাৎ করেই উঁচু হয়ে যায় আরো। এবং কিছুক্ষণ পর কান্নাটা ধীর হতে থাকে। লাশকে নিয়ে কেউ কেউ গোসল করানোর জন্য আঙ্গিনায় নামায় এবং বিছানার চারটা চাদর দিয়ে একটা চৌকোণা ঘর তৈরি করে লাশ ধোয়ানোর ব্যবস্থা হয়। কয়েকজনকে কবর খোঁড়ার জন্য পাঠানোর আগে এমাম সাহেবকে জিজ্ঞাসা করে মালেক- ‘কোথায় কবর দেয়া যেতে পারে?’ এমাম সাহেব বলে- ‘ওদের গোরস্থানে কবর দেবার প্রশ্নই আসে না।’ ক’দিন আগে মোড়লপাড়ার জামায়াতের সাথে গন্ডগোল হয়েছে, তাই ঐ নতুন গোরস্থান বাদ দিয়ে পুরাতন কবরস্থানেই দাফনের ব্যবস্থাপত্র দিল এমাম। এই গোরস্থানটি ছোট, তাই উভয় জামায়াতের লোকজন মিলে একটা নতুন মাটি কিনে নতুন গোরস্থান প্রতিষ্ঠা করে কয়েক বছর আগে।
দু’জামাতের গন্ডগোল হয়েছে ফলে ‘এই লুত্তাপাড়া জামায়াত আবার পুরাতন গোরস্থান ব্যবহার করবে’ এই মর্মে কয়েকদিন আগে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। এর মধ্যে এই পুরাতন কবরস্থানে কবর নেবার জন্য কেউ মারা যায়নি। আজকেই রইস ঘরামির কবর হতে যাচ্ছে। রইস ঘরামির লাশ বরইপাতা গরমজলে ধোয়াতে নিয়ে যাওয়া হয় ঘণ্টাখানেক পর।
ধোয়ানোর এক ফাঁকে, যারা ধোয়াচ্ছিল তাদের মধ্যে একজন হঠাৎ চমকে উঠে আর ‘সোবহানাল্লাহ’ বলে চিৎকার করে উঠে। আর একজন ধোয়নকারী, চমকে ওঠার কারণ জিজ্ঞাসা করলে ‘সোবহানাল্লাহ’ বলা ধোয়নকারী ‘লাশটি নড়ে উঠেছে’ বলে তোঁতলাতে শুরু করে।
তখন অন্য লোকটি অবিশ্বাসের মৃদু হাসির রেখা মুখে এঁকেছে ঠিক সেই মূহুর্তে সেও ব্যাপারটি লক্ষ করে এবং জন্ম নিতে যাওয়া হাসিটি মূহুর্তেরও আগে মিলিয়ে যায়। তারা দুজনই লাশ ধোয়ার জন্য চাদর দিয়ে তৈরি ঘর থেকে বের হয়ে আসে এবং সকলকে কথাটি জানায়- ‘লাশ নড়ে উঠেছে, লাশ জিন্দা আছে।’ বাড়ি ভরা সকল মানুষই একসাথে কয়েক মূহুর্তের জন্য চুপ মেরে যায় এবং আবার সরব হয়ে রইস ঘরামিকে বের করে। আবার মনু কবরেজকে ডেকে আনে। মনু কবরেজ এসে রইসের চেতন ফেরানোর জন্য এবং সুস্থতা দানের জন্য চিকিৎসা শুরু করে।
রইসুদ্দীন এখন আর মৃত নয়। কিন্তু এবং কাফন আর কবর খোঁড়ার কাজ চলছে। ‘এখন কী করা যায়?’ সেটা ভাবতে যাবার আগেই এমাম এসে হাজির হয়। ‘এখন কী করা দরকার?’ এমামকে এই প্রশ্ন করা হলে, সে, কবর এমনি এমনি বন্ধ করতে নিষেধ করে এবং কবরের ভেতরে একটি কলাগাছের শরীর কাফন মুড়িয়ে দাফন করতে বলে। এমাম আরো বলে- ‘যে কবর খোঁড়া হয়ে গেছে সে কবর এমনি এমনি বুঁজিয়ে দিলে কবর গোস্বা করে’। কবরের গোস্বা থামাতে পারে এমন একটি হৃষ্টপুষ্ট কলাগাছ কাটার জন্য কয়েকজন লোক বেরিয়ে পড়ে আর এমাম নিজেই উদ্যোগী হয়ে রইসুদ্দীনের সুস্থতার জন্য একটি দোয়া পরিচালনা করে। সকলেই মোনাজাতে হাত তুলে এবং রইস ঘরামির সুস্থতা কামনা করে। দোয়া শেষ হলে ছয় মাস বয়সী বা নয় মাস বয়সী একটা কলাগাছকে কাফনমোড়া করে কবরস্থানে নিয়ে গিয়ে কবর দেয় কয়েকজন লোক। শেয়ালটি এ কবরের ভেতর ঢুকেছে।
রইসুদ্দীন আর তার কবরের কথোপকথন:
কয়েকদিন পরে রইসুদ্দীন চলার মত সুস্থ হলে, নিজের মরা বৃত্তান্ত, নড়া বৃত্তান্ত, কবর আর কলাগাছ বৃত্তান্ত শোনে বাড়ির লোকের কাছে। রাত হলে, রাতের শরীরে অন্ধকার মাংস পুষ্ট হলে, রইস চুপি চুপি তার জন্য খোঁড়া কবরটি দেখার জন্য গোরস্থানে যায়। ছোট একটা কুপি জ্বালিয়ে কবরের কিনারে দাঁড়ায়। কবরের গায়ের ফুটোটা তার নজরে আসে। ফুটো দিয়ে লাশ পচা গন্ধও বের হচ্ছে। সে অবাক- ‘সে তো কবরের ভেতর নাই, ভেতরে আছে কলাগাছ, তবে এমন গন্ধ কেন? কলাগাছের গন্ধ কি লাশের মত হতে পারে?’ সে তার কবরকে এমন একটি প্রশ্ন করলে আরও কিছু গন্ধপোকা কবর খুঁড়ে বের হয়ে এসে তার নাককে বেশ যখম করে দেয়, তার ফুসফুস এবং হৃদপিন্ডকে যখম করে দেয়।
সে তার নাকে আর বুকে হাত বুলিয়ে বিড় বিড় করে বলে- ‘মানুষ ছাড়া আর কেউ কথা বলতে পারে না, কবর মানুষকে পেটে নিয়ে থেকেও কথা বলতে পারে না, এ কবরটাতো পেটে ধরে আছে বোবা কলাগাছ। গরু ছাগল বিড়াল কুকুর মানুষের এত কাছাকাছি থাকে, তারাও কোনো কথা শিখে নিতে পারেনি।’ এরপর, সে তার চিন্তাটিকে বিড়ির আগুন দিয়ে পুড়ায় আর কথা বলা বিষয়ে ভাবনাটাকে উল্টে দেখে- ‘সবকিছুই কথা। গরু ছাগল কুকুর বিড়াল যেসব শব্দ করে সেসবও কথা। গন্ধও কথা। গন্ধকথা। কবর থেকে আসা গন্ধ বলছে-‘‘সে কলা গাছ নয়’’। বুকের ভেতর আরো জোরে শ্বাস টেনে নিয়ে সে নিশ্চিত হয়, খুবই নিশ্চিত হয়, গন্ধ যে বাক্য তাকে দেয় সে ব্যাপারে। সে অনিশ্চিত হয়ে পড়ে- আমি কি আমি? আমি রইসুদ্দীন ঘরামি? এই কবরঘরের ভেতরে আমি নাই? এই কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আমি নাই? কলাগাছ কবরের ধারে দাঁড়িয়ে আর কবরে আমি? আমার শরীরের দুর্গন্ধ কলাগাছ পাচ্ছে? না কি শেয়াল? এই ‘শেয়াল’ কথাটি হঠাৎ করেই মনে এলে তার ভাবনা এলোমেলোমি বাদ দেয়। শেয়াল তার অন্তর দখল করে নেয়।
তার চোখ লাল হয়ে আসে। অন্ধকার হয়ে আসে। তার চোখ জ্বলজ্বল করে ওঠে। তার চোখ পাগলা হয়ে আসে, মাংস হয়ে আসে। শেয়াল হয়ে আসে। তার চোখ ঝড় হয়ে আসে। তার চোখ দিয়ে ঝড় আসে। ভেতর বাহিরে তার ঝড় ওঠে। কবরখানা থেকে সে যখন ফিরে আসে তখনও তার গায়ে রোঁয়া ওঠেনি।