একাত্তরের গণহত্যার অপরাধ অস্বীকার করায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ‘মূল্যায়ন’ করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী।
কূটনৈতিক সম্পর্ক ‘একটি চলমান প্রক্রিয়া’ মন্তব্য করে মন্ত্রী বলেন, “পাকিস্তানের সাবেক সামরিক শাসক, প্রেসিডেন্ট পারভেজ মোশাররফ তো ক্ষমাও চেয়েছেন; যদিও ভাষাটা অতো শক্ত ছিল না। আসমা জাহাঙ্গীর ও সাংবাদিক হামিদ মীরের মতো স্বাধীনচেতা ও মানবাধিকারকর্মীরা এটা নিয়ে কথা বলেছেন। হামুদুর রহমান কমিশনের প্রতিবেদনেও কিন্তু বিষয়টা আছে।”
মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ২২ নভেম্বর প্রথম প্রহরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদের মৃতুদণ্ড কার্যকর করার পর এক বিবৃতিতে উদ্বেগ জানায় পাকিস্তান। এরপর ঢাকায় দেশটির হাই কমিশনারকে তলব করে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলার কড়া প্রতিবাদ জানায় বাংলাদেশ সরকার।
এর এক সপ্তাহ পর ইসলামাবাদে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত হাই কমিশনারকে তলব করে দেশটি। একাত্তরের গণহত্যার অপরাধও অস্বীকার করা হয়।
এরপর সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম, গণজাগরণ মঞ্চসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ওঠে।
পাকিস্তানের বহু লোক গণহত্যার বিষয়টি ‘স্বীকার করেছেন’ মন্তব্য করে মাহমুদ আলী বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের, বিশেষ করে জামায়াত-বিএনপির অনেক টাকা। সারা পৃথিবীতে অনেক টাকা খরচ করেছে কিন্তু বিশেষ কিছু করতে পারেনি এবং কোনো আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টি করতে পারেনি।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “ইউরোপীয় ইউনিয়নের সবগুলো দেশ কিন্তু বাংলাদেশের যুদ্ধাপরাধে বিচারের বিরোধিতা করেনি। ইউরোপীয় পার্লামেন্টে তারা যে প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল, সেখানেও তারা বলেছিল, হ্যাঁ কিছু সমস্যা ছিল এবং যেসব পরিবার বিচার পায়নি, একাত্তরে ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে, তারাও বিচার পাচ্ছে।”
যুদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থানও নমনীয় হয়েছে বলে মনে করেন মাহমুদ আলী।
“আমেরিকার অ্যাম্বাসেডর অ্যাট লার্জ স্টিফেন র্যাপ গত বছরের অগাস্টে যখন বাংলাদেশে এসেছিলেন তখন তিনি বিচারকদের স্যালুট করেছিলেন। তাদের সঙ্গে দেখা করেছিলেন এবং তাদের সম্পর্কে একটি পজিটিভ রিঅ্যাকশন দেখিয়েছেন।”
বাংলাদেশকে ভারতের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ৪৪তম বার্ষিকী উপলক্ষে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত ‘কালের কষ্টিপাথরে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক’ শিরোনামের আলোচনা সভায় বক্তব্য দেন মাহমুদ আলী।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন তিনি।
“বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক এতো শক্ত সেটা কোনোভাবে নষ্ট করা যাবে না। এটা অন্তরের গভীরে। এটাকে বাস্তবে রূপ দিতে হবে,” বলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দুই দেশের সম্পর্ক নষ্ট করা হয়েছিল মন্তব্য করে মাহমুদ আলী বলেন, এখন আবার সেই সম্পর্ক নতুন মাত্রা পেয়েছে।
“এখন যে সম্পর্ক, এতো ভাল সম্পর্ক পঁচাত্তরের পর আর হয়নি। সেটাই আমাদের সমগ্র জনগণের এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকারের সাফল্য।
“এখন বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক শুধু নতুন উচ্চতায় নেওয়া হয়নি, সম্পর্কে গুণগত পরিবর্তনও আমরা এনেছি।”
বাংলাদেশ-ভারতের সমুদ্রসীমা বিরোধের মীমাংসা, ছিটমহল বিনিময়, ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানিসহ দুই দেশের সম্পর্কের নানা দিক তুলে ধরেন মন্ত্রী।
ভারতের ত্রিপুরার রাজধানীর আগরতলায় একজন সহকারী হাই কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হয়েছে জানিয়ে মাহমুদ আলী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধকালে ত্রিপুরার মানুষের সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষের সম্পর্কের ধারাবাহিকতায় এটা করা হয়েছে। কিছুদিনের মধ্যে আসামের গৌহাটিতেও একজন ডেপুটি হাই কমিশনার নিয়োগ দেওয়া হবে।”
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলামের সভাপতিত্বে সংগঠনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন।অন্যদের মধ্যে হিউম্যান রাইটস কংগ্রেস ফর বাংলাদেশ মাইনোরিটিজের সভাপতি অধ্যাপক অজয় রায়, নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদজায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী বক্তব্য দেন।
ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে আলোচনা সভায় মূল প্রবন্ধে মুনতাসীর মামুন বলেন, “বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যকার সমস্যাগুলোর সমাধানের সূত্রপাত করেছেন বঙ্গবন্ধু। আর বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেগুলো একেকটা করে নিষ্পত্তি করছেন।”
তিনি বলেন, “২০০৬ সাল থেকে ক্ষমতা থাকায় শেখ হাসিনার সরকারের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ভিন্নমাত্রা পায়। যখন যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্য সরকার বিএনপি-জামায়াতকে সমর্থন করে, তখন জ্বালাও-পোড়াওয়ের সমর্থন ভারত করেনি। এ কারণে ওই সময়ে পরিস্থিতির উত্তরণ ঘটানো সম্ভব হয়েছে।
“ভারতে ক্ষমতার পালাবদলে বিজেপি এলে শেখ হাসিনা সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক খারাপ হওয়ার একটা আশঙ্কা আমরা একাডেমিক দিক থেকে করেছিলাম। কিন্তু মোদি সরকার বাংলাদেশের ক্ষেত্রে তাদের পররাষ্ট্র নীতি আগের মতোই রেখেছে। এখন আমাদের তাত্ত্বিক নীতি বদলাতে হবে।”
মুনতাসীর মামুন বলেন, “বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন এমন এক পর্যায়ে গেছে, বাংলাদেশে ডানপন্থি, মধ্যমপন্থি বা বিএনপি-জামায়াত যারাই ক্ষমতায় আসুক না কেন, এটা অব্যাহত রাখতেই হবে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলোর সম্পর্কে যে পরিবর্তন এসেছিল, তেমন পরিবর্তন এখানেও হয়েছে।”
সীমান্ত হত্যা বন্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়ার জন্য সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “সীমান্ত হত্যা এখনও অব্যাহত আছে, আমরা এটা কোনোভাবে মেনে নিতে পারি না।”
বাংলাদেশে মৌলবাদবিরোধী আন্দোলন নিয়ে হতাশা প্রকাশ করে অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, “স্বাধীনতার ৪৪ বছরেও আমরা কাঠমোল্লাদের বিরুদ্ধে জনগণকে বিপুল আন্দোলনে একীভূত করতে পারছি না। প্রগতিশীল সংগঠনগুলো বড় রকমের জনমত তৈরি করতে পারছে না।”
ধর্মান্ধদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “ঘরের সভায় আর নয়, মাঠের আন্দোলনে নেমে আসুন। প্রয়োজন হলে সশস্ত্র হামলা চালান।”
অনুষ্ঠানের সভাপতি বিচারপতি সৈয়দ আমিরুল ইসলাম ভারতের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে বিদ্যমান সমস্যা সমাধানে উদ্যোগ নিতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।