আসন্ন পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে দলীয় প্রার্থী মনোনয়ন নিয়ে ক্ষুব্ধ বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতারা। তারা দাবি করছেন, প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করার ক্ষেত্রে কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হয়নি। প্রথমত, তৃণমূল থেকে সর্বসম্মতিক্রমে প্রার্থী বাছাই করা হয়নি। দ্বিতীয়ত, কেন্দ্রে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি বা অন্য কোনো দলীয় ফোরামে আনুষ্ঠানিক বৈঠকে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্তস্ন হয়নি। তৃতীয়ত, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনী আসনে দলের সাবেক সাংসদ ও প্রার্থীর মতামতও নেওয়া হয়নি। অবশ্য প্রার্থী মনোনয়নে মতামত না নিলেও নির্বাচনী প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার কর্মকৌশল নির্ধারণে শিগগির দলের সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া বৈঠক করবেন বলে সূত্র জানিয়েছে। জানা গেছে, শুধু কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সমন্বয়ে ৭টি টিম টেলিফোনে সম্ভাব্য মেয়র প্রার্থী নাম সংগ্রহ করে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার হাতে হস্তান্তর করা
হয়েছে। টেলিফোনে দলের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক একজনের নাম, জেলার সভাপতি একজন আবার সাধারণ সম্পাদক অন্য জনের নাম প্রস্তাব করেন। এমন ঘোলাটে পরিস্থিতিতে চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এবং সমন্বয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত টিমের নেতারা খোঁজখবর নিয়ে এলাকায় ‘জনপ্রিয়, যোগ্য, আন্দোলনে ত্যাগী ও সাহসী’ ভূমিকার কথা বিবেচনা করে মনোনয়ন দিয়েছেন।
এ প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো পৌরসভায় স্থায়ী কমিটির সদস্য, উপদেষ্টা পরিষদ ও সাবেক সাংসদদের পছন্দের এবং তৃণমূলের পছন্দের প্রার্থী মনোনয়ন পাননি। দলের ‘চেইন অব কমান্ড’ ভঙ্গের ভয়ে প্রকাশ্যে কেউ মুখ খুলতে নারাজ।
অবশ্য বিএনপির প্রার্থী প্রত্যয়নপত্র দেওয়ার দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা দলের যুগ্ম মহাসচিব মোহাম্মদ শাজাহান সমকালকে বলেন, বর্তমানে বিএনপির ক্রান্তিকাল চলছে। দলে নেতাকর্মীরা গ্রেফতার, মামলা-হামলায় জর্জরিত। এ পরিস্থিতিতে বিএনপি নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সিদ্ধান্তের পর মাত্র ৩-৪ দিনের মধ্যে মনোনয়ন প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়েছে। দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এলাকায় জনপ্রিয়, যোগ্য, ত্যাগী ও সাহসী ভূমিকার কথা বিবেচনা করে প্রার্থী মনোনয়ন দিয়েছেন। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে এতগুলো পৌরসভায় প্রার্থী মনোনয়ন দিতে গিয়ে দুই-একটি ভুল হলেও হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেনের নির্বাচনী এলাকায় তার পছন্দের প্রার্থী পৌর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক নূরুল আমীন সরকারকে (নাঈম সরকার) মনোনয়ন না দিয়ে দেওয়া হয়েছে কেন্দ্রীয় যুবদলের সহসভাপতি কেএমআই খলিলকে। কারাগার থেকে ড. মোশাররফ দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার কাছে বার্তা পাঠানোর পর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেও তা কার্যকর হয়নি। এটি ‘লোক দেখানো নাটক’ বলে মন্তব্য করেছেন মোশাররফের অনুসারীরা।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট খন্দকার মাহবুব হোসেনের নির্বাচনী এলাকা বরগুনার পাথরঘাটায়ও তার এবং তৃণমূল নেতাদের পছন্দের প্রার্থীকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। তাদের পছন্দের প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করা হয়েছিল অ্যাডভোকেট মনিরুজ্জামানের নাম। সেখানে মনোনয়ন পেয়েছেন বিগত নির্বাচনে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে বিজয়ী মেয়র মলি্লক মো. আইয়ুব।
বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নির্বাচনী এলাকা ফেনীর পরশুরাম পৌরসভায়ও উপজেলা বিএনপির প্রস্তাবিত প্রার্থী মো. শাহজাহানকে মনোনয়ন দেওয়া হয়নি। সেখানে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে পৌর যুবদল নেতা মোস্তাফিজুর রহমান মাসুদকে। জামানতের ১৫ হাজার টাকার স্থলে ১০ হাজার টাকা দেওয়ায় বাছাই প্রক্রিয়ায় তার প্রার্থিতা বাতিল হয়। সেখানে বিএনপি বা অন্য কোনো দলের মেয়র প্রার্থী না থাকায় আওয়ামী লীগ প্রার্থী নিজামউদ্দিন আহমেদ চৌধুরী সজল বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পথে রয়েছেন। উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবু তালেব ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে সমকালকে জানান, উপজেলা ও পৌর বিএনপির পক্ষ থেকে তারা মো. শাহজাহানের নাম প্রস্তাব করেছিলেন। কিন্তু তাদের সঙ্গে কোনো আলাপ না করেই ‘আওয়ামী লীগের দালাল’কে মনোনয়ন দেওয়ায় এ ওয়াকওভারের ঘটনা ঘটেছে।
‘বিদ্রোহীদের’ সঙ্গে কথা বলবেন খালেদা: বর্তমানে অর্ধশতাধিক আসনে বিকল্প বা বিদ্রোহী প্রার্থী দৃশ্যমান থাকলেও বাস্তবে ১০-১৫ জন প্রকৃত বিদ্রোহী প্রার্থীকে নিয়ে চিন্তিত বিএনপি। এসব বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে রয়েছেন জয়পুরহাটের আলমগীর হোসেন চৌধুরী, রাজশাহীর কাটাখালীর সিরাজুল ইসলাম, আড়ানীর নজরুল ইসলাম। দল যাকে মনোনয়ন দিয়েছে তাদের চেয়ে বিদ্রোহীরা কম শক্তিশালী নন। তাদেরও প্রাথমিকভাবে দলের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতারা মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করবেন। তাতে তারাও সরে না দাঁড়ালে দলের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া ঢাকায় ডেকে আনবেন। তাদের দলের দুঃসময়ের কথা বুঝিয়ে দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে মনোনয়পত্র প্রত্যাহারের অনুরোধ করবেন। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে দলের গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দেওয়ার আশ্বাস দেবেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে দলের সমন্বয়কারী মো. শাজাহান বলেন, আগামী ১৩ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ দিনের পর বিদ্রোহী প্রার্থী খুব বেশি থাকবেন না। ইতিমধ্যে তারা বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনা করে সরে দাঁড়ানোর পরামর্শ দিচ্ছেন। তার পরও সরে না দাঁড়ালে দলের হাইকমান্ড পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন।
শিগগির সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক: সূত্র জানিয়েছে, পৌর নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী চূড়ান্ত করতে স্থায়ী কমিটির পরামর্শ না নিলেও প্রচারের কর্মকৌশল নির্ধারণে শিগগির দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন খালেদা জিয়া। বৈঠকে সিনিয়র নেতাদের বিভাগওয়ারি টিম করে প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করবেন তিনি। খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারে নামার কথা আলোচিত হলেও শেষ পর্যন্ত তা মাঠের পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করবে। বিগত ঢাকা সিটি করপোরেশনে দল সমর্থিত মেয়র প্রার্থী তাবিথ আউয়ালের প্রচারে নেমে কারওয়ান বাজারে হামলা হয় তার ওপর