চবি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসগুলোর সবকটিই চারতলা ভবন। এই হলগুলোর বেশিরভাগেরই অবস্থা এমন যে, সেগুলো যে আদতেও একটা ছাত্রাবাস তা বুঝতে কষ্ট হওয়াটাই স্বাভাবিক। স্যাঁতসেতে শ্যাওলা পড়া দেয়াল দেখে মনে হবে পরিত্যক্ত কোনো ভবন হয়তো।
এ তো গেল এই ছাত্রাবাসের বাহ্যিক একটা দৃশ্যপট মাত্র। ছাত্রাবাসে যারা থাকেন অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মূল সঙ্কটটা শুরু হয় ওই ছাত্রাবাসে থাকার সুযোগ মেলার পর থেকে। মানুষের মৌলিক অধিকারগুলোর চতুর্থটি অর্জন করতে গিয়ে এ ছাত্রাবাসের ছাত্ররা প্রায় বঞ্চিত প্রথমটি থেকে।
আর এ বিষয়ে প্রভোস্ট কমিটির আহ্বায়ক প্রফেসর মো. সোলতান আহমেদের বক্তব্য, ২০ টাকা দিয়ে তো আর বিরিয়ানি খাওয়ানো যাবে না।
কথা সত্য। ২০ টাকা দিয়ে শিক্ষার্থীদের বিরিয়ানি খাওয়ানো সম্ভব না। তাই বলে দিনের পর দিন ‘হলুদ মেশানো গরম পানি’ খাবেন সরকারি একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা?
সোলতান আহমেদ বলছেন, ‘শিক্ষার্থীরা টাকা দেয় ২০। আর ২০ টাকা দিয়ে বিরিয়ানি খাওয়ানো অসম্ভব। তারপরও আমরা চেষ্টা করছি খাবারের মানটা বাড়ানোর জন্য। আজকে সিন্ডিকেট সভায় এ বিষয়ে কথাও হয়েছে।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, গুটিকয়েক শিক্ষার্থীরা ছাড়া কেউ-ই ডাইনিংয়ের খাবার খান না। কিন্তু কারণটা কী? কেন শিক্ষার্থীরা ডাইনিংয়ের খাবার খাচ্ছেন না? উত্তর- নিম্নমানের চালের ভাতের সঙ্গে ডাইনিংয়ের খাবারের তালিকায় থাকা ডাল তো যেন ডাল না। সে যেন হলুদ মেশানো গরম পানি, যার নেই কোন স্বাদ। আর এর সঙ্গে থাকে খুবই নিম্নমানের তরকারি।
একজন পূর্ণবয়স্ক মানুষের দৈনিক ১ হাজার ৮০০ ক্যালরির খাদ্য প্রয়োজন। কিন্তু হলের ছোট এক টুকরা মাংস ও মাছে সে চাহিদা পূরণ হয় না। তাই হলের শিক্ষার্থীরা অপুষ্টিজনিত রোগে ভুগবেন এটাই স্বাভাবিক। তাদের জন্য একটু ভালো খাবারের ব্যবস্থা করার যেন কেউ নেই। অথচ প্রতিবছর এ শিক্ষার্থীদের জন্য বিরাট অংকের শিক্ষা বাজেট ঘোষণা করা হয়। কিন্তু তা প্রয়োগ করারও কেউ নেই।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শাহ জালাল ,শাহ আমানত ,আলাওল, এ এফ রহমান হল ও আব্দুর রব হল ঘুরে দেখা গেছে- খাবারের সময় ডাইনিংয়ে শিক্ষার্থী সংখ্যা মাত্র হাতে গোনা কয়েকজন। ডাইনিং টেবিলে খাবার বলতে যা থাকে: তরকারি বলতে এক টুকরো আলুর সঙ্গে ছোট্ট মাছ কিংবা মাংস। মাঝে-মধ্যে আবার তাও থাকে না। আর ডাল বলতে যা থাকে তা যেন হলুদ রঙের পানিই। অনেক সময় আবার ভাতের সঙ্গে তরকারি হিসেবে থাকে কেবল বুটের ডাল। এসব দিয়ে একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে পেট ভরে খাবার খাওয়া অসম্ভব।
আর এসব কারণে বাধ্য হয়ে শিক্ষার্থীরা নিজেরাই রান্না করার দায়িত্ব নিয়েছেন। অনেকেই আবার আশপাশের হোটেলগুলোতে ছুটে যায় খাবারের সন্ধানে। কিন্তু সেখানেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন করা হয়। অপরিচ্ছন্ন টেবিল ও প্লেট। খাবারের ওপর মাছি ভনভন করে। স্যাঁতসেতে রান্নাঘরে করা হয় রান্না। চারপাশে ময়লা ছড়ানো-ছেটানো। যা খেলে একজন শিক্ষার্থী নানা রোগে আক্রান্ত হতে পারে। হোটেলগুলোতেও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে খাবার পরিবেশন করা হয়
এছাড়াও ওই হোটেলগুলোতে খাবারের দামও রাখা হয় তুলনামূলক বেশি। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ ওখানে তিনটা ছোট মাংসের পিসের দাম ৮০-৯০ টাকা।
হলের ডাইনিং ও খাবার হোটেলগুলোর মতো একই দশা ক্যান্টিনগুলোরও। সেখানে খাবারের টেবিল পরিষ্কার করা হচ্ছে অপরিষ্কার ন্যাকড়া দিয়ে। রান্নাঘর খুবই নোংরা। এখানে-ওখানে ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে থাকে। রান্নাঘরের মেঝেও স্যাঁতসেতে। প্রতিবছরই খাবারের দাম বাড়ে; কিন্তু মান বাড়ে না।
শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, ডাইনিংয়ে গরুর মাংসের নামে দেয়া হয় মহিষের মাংস। দেয়া হয় নিম্নমানের মোটা চালের ভাত, ডালের নামে হলুদ মেশানো পানি। মাছের মানও ভালো নয়। পচা মাছ নিয়ে ম্যানেজারদের সঙ্গে ছাত্রদের প্রায়ই তর্কাতর্কি হয়। নষ্ট সবজিও খাওয়ানো হয় বলে অভিযোগ তাদের।
প্রতিবাদ করলে সম্যস্যা আছে
অর্থনীতি বিভাগের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী মো. শহিদুল ইসলাম থাকেন এ এফ রহমান হলের ৩১৩ নম্বর কক্ষে। তিনি বাংলামেইলকে অভিযোগ করেন, ‘এখানে যে খাবার পরিবেশন করা হয় তা একজন ছাত্রের পক্ষে পেট ভরে খাওয়া কখনো সম্ভব না। আমরা বাড়িতে গিয়ে যে মাছের টুকরা খায় তা এখানে তিনভাগ করে তিনজনকে খাওয়ানো হয়। আর ডাল তো মনে হয় গরম পানির সঙ্গে হলুদের গুঁড়া মেশানো হয়; যা উপর থেকে তলায় দেখা যায়।’
তিনি আরো বলেন, ‘সাধারণত টাকা কম থাকলে আমরা হলে খাই, না হয় পাশের হোটেলগুলোতে খাই। কিন্তু ওখানেও একই সমস্যা অপরিষ্কার খাবার। তার উপরে টাকাও বেশি।’
একই অভিযোগ শাহ আমানত হলের মেরিন সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী অভি বিশ্বাসেরও। বাংলামেইলকে তিনি বলেন, ‘কিছু করার নেই। খাচ্ছি, খেয়ে যেতে হবে। কারণ প্রতিবাদও করতে পারি না, প্রতিবাদ করলে সম্যস্যা আছে। আমরা চাই খাবারের মানটা বাড়ুক। দরকার হলে টাকা বেশি নিক, তাতে কোনো সম্যাসা নেই।’
এদিকে ছাত্রী হলের অবস্থাও একই। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক প্রীতিলতা হলের লোকপ্রশাসন বিভাগের ২য় বর্ষের এক ছাত্রী বলেন, ‘ডাইনিংয়ে খাবার খুবই নিম্নমানের। খাওয়া প্রায় অসম্ভব। তাই নিজেরা রেঁধে খায়। কিন্তু নিজেরা রান্না করে খেতে গিয়ে অনেক সময় নষ্ট হয়, যার ফলে পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে।’
শিক্ষার্থীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে শাহ আমানত হলের ম্যানেজার আব্দুল মান্নান বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যদি কিছুটা হলেও ভর্তুকি দিত তাহলে খাবারের মান বাড়ানো যেত। কিন্তু আমরা তারপরও চেষ্টা করছি খাবারের মানটা বাড়ানো জন্য।’
ডাইনিংয়ে খাবারের মান যাচাই করার এবং ব্যবস্থাপনায় নজরদারি করার জন্য আবাসিক শিক্ষক রয়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, বিভিন্ন সুবিধা নিলেও খাবারের মান নিয়ে কথা বলেন না তারা।