এখন বড় ধরনের চাপের মধ্যে রয়েছেন আওয়ামী লীগের ‘বিদ্রোহী’ পৌর মেয়র প্রার্থীরা। ‘চাপ’ ছাড়াও কিছু ক্ষেত্রে বিদ্রোহীদের ক্ষোভ প্রশমনে কৌশলও নিচ্ছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। ‘নরম-গরম’ কৌশলের আশ্রয়ে নেতারা সব পৌরসভায় জয় নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর। তাদের ধারণা, শেষ পর্যন্ত কোনো পৌরসভায়ই ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থী থাকবেন না। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একাধিক নেতা সমকালকে বলেছেন, কয়েকটি পৌরসভায় মেয়র প্রার্থী মনোনয়নে নিবেদিতপ্রাণ, যোগ্যতম, জনপ্রিয় ও পরীক্ষিত নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়ায় প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। এদের মধ্যে পরপর তিনবার নির্বাচিত মেয়রকে মনোনয়নের প্রশ্নও তৃণমূল পর্যায়ে বিবেচনায় আনা হয়নি। এই অভিযোগের সদুত্তরও কেউ দিতে পারছেন না। শেষাবধি বিদ্রোহী হিসেবে মাঠে থাকবেন, নাকি দল থেকে বহিষ্কার মেনে নেবেন- এ নিয়ে তাদের কেউ কেউ সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছেন। অবশ্য ‘বিদ্রোহ’ দমনে দায়িত্বপ্রাপ্ত দলের নেতাদের দাবি, অনেক বিদ্রোহী প্রার্থীই মনোনয়ন প্রত্যাহারে সম্মত হয়েছেন।
গত বৃহস্পতিবার মনোনয়নপত্র জমার শেষ সময় পার হওয়ার পরপরই দফায় দফায় বৈঠকও করছেন পৌর নির্বাচন পরিচালনায় দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা। শুক্র ও শনিবার বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাগে আনার ইস্যুতে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠকে এ নিয়ে নীতিনির্ধারণী বেশ কিছু সিদ্ধান্তও হয়েছে।
সূত্রমতে, এ দুই বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদকরা স্ব-স্ব বিভাগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের তালিকা তৈরি করে মাঠেও নেমেছেন। শুক্রবারই ঢাকা বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন মাদারীপুর গিয়ে ‘বিদ্রোহী’ প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। একইভাবে সিলেট বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মিসবাহউদ্দিন সিরাজ ও রংপুর বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী নিজ নিজ বিভাগে গিয়ে কথা বলেছেন বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে। অন্য সাংগঠনিক সম্পাদকদের মধ্যে বি এম মোজাম্মেল হক খুলনা, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বরিশাল, আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন রাজশাহী ও বীর বাহাদুর চট্টগ্রাম বিভাগের পৌরসভাগুলোর বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করেছেন বলেও সমকালকে জানিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে টেলিফোনেও বিদ্রোহী প্রার্থীদের ১৩ ডিসেম্বর মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ সময় পার হওয়ার আগেই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশও দেওয়া হচ্ছে। গতকাল শনিবার ঢাকার বৈঠক শেষ করে রাতেই কোনো কোনো সাংগঠনিক সম্পাদক এলাকায় ছুটে গেছেন।
সব বিদ্রোহী প্রার্থীর এলাকাগত অবস্থানসহ সার্বিক খোঁজখবর নিয়ে তাদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের সর্বাত্মক পদক্ষেপ নিতে দলের জেলা নেতাদেরও নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তারা নিজ নিজ জেলার বিদ্রোহী প্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলতে শুরু করেছেন।
অবশ্য কঠোর পদক্ষেপের পাশাপাশি ক্ষেত্রবিশেষে ‘বুঝিয়ে-শুনিয়ে’ বিদ্রোহী প্রার্থীদের বাগে আনার প্রচেষ্টাও রয়েছে দলের মধ্যে। বিশেষ করে যেসব এলাকায় বিদ্রোহী প্রার্থী অনেকটাই প্রভাবশালী কিংবা দলের জন্য অপরিহার্য, এমন প্রার্থীর বেলায় এ কৌশলের আশ্রয় নেওয়া হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে প্রার্থিতা প্রত্যাহারের বিনিময়ে দলীয় পদ-পদবি অথবা অন্য কোনো জায়গায় ‘উপযুক্ত মূল্যায়নে’র আশ্বাসও দেওয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের হিসাবে, ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠেয় ২৩৪টি পৌরসভার মধ্যে কমপক্ষে অর্ধশতে ৭১ জন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। সর্বোচ্চ তিন-চারজন বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন এমন পৌরসভার সংখ্যা ৮ থেকে ১০টি।
৯ ডিসেম্বর নির্বাচনের আনুষ্ঠানিক প্রচার কার্যক্রম শুরু হলে দলীয় প্রার্থীদের পক্ষে মাঠে নামবেন কেন্দ্রীয় নেতারা। এ ক্ষেত্রে বিধিনিষেধের আওতায় থাকা এমপিরা বাদে ক্ষমতাসীন দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সমন্বয়ে গঠিত একাধিক টিমকে মাঠে নামানো হবে। বিশেষ করে যে এলাকায় যে নেতার প্রভাব ও প্রাধান্য রয়েছে, সে এলাকায় সেই নেতাকেই প্রচারে যুক্ত করবে দলটি।
দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ১৩ ডিসেম্বরের পর কোনো পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবে না। শনিবার দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও সাংগঠনিক সম্পাদকদের বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে হানিফ আরও বলেছেন, এরই মধ্যে চার-পাঁচটি পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা সরেও দাঁড়িয়েছেন। মনোনয়ন প্রত্যাহারের শেষ দিন ১৩ ডিসেম্বরের মধ্যে বাকি সবাই প্রত্যাহার করে নেবেন বলে তার ধারণা।
দলের সাংগঠনিক সম্পাদক আহমদ হোসেন সমকালকে জানান, মাদারীপুরের কালকিনি পৌরসভায় দল মনোনীত প্রার্থী পছন্দ না হওয়ায় স্থানীয় নেতারা একযোগে গণপদত্যাগ করেছিলেন। এখানে দলীয় প্রার্থী এনায়েত হোসেন হাওলাদারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থীও হন আবুল কালাম আজাদ। আলোচনার পর স্থানীয় নেতারা গণপদত্যাগপত্র যেমন প্রত্যাহার করেছেন, তেমনি বিদ্রোহী প্রার্থীও নির্বাচনী মাঠ থেকে সরে যাওয়ার আশ্বাস দিয়েছেন।
আরেক সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেছেন, বরিশাল বিভাগের ১৭টি পৌরসভার মধ্যে সাতটিতে আট-নয়জন দলীয় বিদ্রোহী প্রার্থী রয়েছেন। একজন এমপি হিসেবে আচরণবিধি মেনে প্রায় সবার সঙ্গে এরই মধ্যে কথা বলেছেন তিনি। জেলা নেতারাও কথা বলেছেন তাদের সঙ্গে। এসব আলোচনার পর বিদ্রোহী প্রার্থীদের কেউই শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাঠে থাকবেন না বলে তার বিশ্বাস।
সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন বলেন, তার বিভাগ রাজশাহীর সব পৌরসভা থেকে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরিয়ে দেওয়ার সব রকম প্রচেষ্টা চলছে। এ কাজ বেশ এগোচ্ছেও। বিদ্রোহী প্রার্থীদের অনেকে ‘নরম’ হয়েও কথা বলতে শুরু করেছেন।
সাংগঠনিক সম্পাদক খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, ভুল বোঝাবুঝির কারণে কিছু পৌরসভায় বিদ্রোহী প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দিয়েছেন। শেষ পর্যন্ত কোনো পৌরসভায়ই বিদ্রোহী প্রার্থী থাকবেন না।
দলের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক অ্যাডভোকেট আফজাল হোসেন তার জেলা পটুয়াখালীর চিত্র তুলে ধরে বলেন, জেলার কুয়াকাটা পৌরসভায় দলীয় মনোনয়ন না পেয়ে থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মনির ভূঁইয়া তার ছেলে সাবের আহম্মেদ সোহাগকে বিদ্রোহী প্রার্থী করেছিলেন। তবে দলীয় আলোচনার পর সোহাগের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করা হবে বলে জানিয়েছেন ক্ষুব্ধ এই স্থানীয় নেতা। এখানে দলীয় প্রার্থী আবদুল বারেক মোল্লা।
অবশ্য দু-একটি ক্ষেত্রে ব্যতিক্রমও দেখা যাচ্ছে। রাজশাহীর পুঠিয়া পৌরসভায় দল মনোনীত মেয়র প্রার্থী রবিউল ইসলাম রবি। স্থানীয় এমপি আবদুল ওয়াদুদ দারার প্রভাবে দলীয় মনোনয়ন পাওয়া এই প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী হয়েছেন জি এম হীরা বাচ্চু ও আবদুল মালেক। এ দুই বিদ্রোহী প্রার্থীর মধ্যে আগে থেকে বিরোধ থাকলেও এখন দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে দু’জনই প্রার্থী একাট্টা হয়েছেন। এমনকি স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারাও দলীয় প্রার্থীর বিপক্ষে অবস্থান নিয়ে উপজেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ে তালা দিয়েছেন। এ অবস্থায় দুই বিদ্রোহী প্রার্থীকে কোনোভাবেই ‘ম্যানেজ’ করা যাবে না বলে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা জানিয়েছেন।
একইভাবে বগুড়ার ধুনট পৌরসভায় উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক শরিফুল ইসলাম খান দলীয় মনোনয়ন পেলেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করছেন বর্তমান মেয়র এ জি এম বাদশাহ ও বর্তমান কাউন্সিলর আল-আমিন তরফদার। তারা দু’জনই আওয়ামী লীগের সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচনে নেমেছেন। ফলে বহিষ্কারের হুঁশিয়ারিতে কাজ না-ও হতে পারে।
জানতে চাইলে দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ গত রাতে সমকালকে বলেছেন, বিদ্রোহী সব প্রার্থীকেই ১৩ ডিসেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহারের শেষ সময়সীমার আগেই প্রার্থিতা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর পরও কেউ প্রার্থিতা অব্যাহত রাখলে তাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের দায়ে সর্বোচ্চ শাস্তিই পেতে হবে।