মানবতার অপমৃত্যু গাজায় আর ইউক্রেনে

Slider গ্রাম বাংলা জাতীয় টপ নিউজ সারাবিশ্ব

55817_child
গ্রাম বাংলা ডেস্ক: জন ডান শেক্সপিয়রের সমসাময়িক কবি। শেক্সপিয়রের জন্ম ১৫৬৪ সালে আর জন ডানের ১৫৭১ সালে। প্রেমের কবিতাই বেশি লিখেছেন তিনি। কর্মজীবনে তিনি ছিলেন খ্রিষ্টান ধর্মযাজক। ধর্মীয় ও নৈতিক উপদেশমূলক লেখাও অনেক লিখেছেন। ডেসিডেরাটা (যে জ্ঞানের প্রয়োজন তীব্র অনুভূত হচ্ছে) নামে তার একটি ভাবনার কথা বহু বিদগ্ধ ব্যক্তির বৈঠকখানাতেই ফ্রেম করা দেখা যাবে।
ডেসিডেরাটার শুরুতেই জন ডান লিখেছেন : কোনো মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, সবাই আমরা একটা মহাদেশের অবিচ্ছেদ্য অংশ। রচনা শেষ করেছেন তিনি এভাবে : অতএব কখনো জিজ্ঞেস করো না মৃত্যুঘণ্টা কার জন্য বাজছে, সে ঘণ্টা বাজছে তোমার জন্যই।
মালয়েশিয়ার যাত্রীবিমান এমএইচ১৭ ২৯৮ জন যাত্রী ও ক্রু নিয়ে হল্যান্ডের এমস্টারডাম থেকে কুয়ালালামপুর যাচ্ছিল। যাত্রীদের বেশির ভাগ ওলন্দাজ (হল্যান্ডের অধিবাসী)। ব্রিটিশ, মার্কিন ও অস্ট্রেলিয়াসহ অন্যান্য দেশের নাগরিকও ছিলেন। ইউক্রেনের ওপর দিয়ে রাশিয়া হয়ে যাওয়ার পথ তার। রুশ সীমান্তের কাছাকাছি বিমানটি ভূপাতিত হয়। ৩৩ হাজার ফুট ওপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছিল বিমানখানি। সুতরাং অবশ্যই কেউ প্রাণে বাঁচেননি। যাত্রীদের সবারই পরিচয় এখন জানা গেছে। কারো কারো কিছু মানবিক কাহিনীও মিডিয়ায় প্রকাশিত হয়েছে। যেমনÑ ছয়জন যাত্রী ছিলেন এইডস রোগ বিশেষজ্ঞ ও গবেষক। তারা এইডসসংক্রান্ত এক আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সম্মেলনে যোগ দিতে অস্ট্রেলিয়ায় যাচ্ছিলেন। এ প্রশ্ন অবশ্যই উঠবে : এমনও কি হতে পারে যে তাদের কেউ এইডস রোগ প্রতিষেধক কিংবা চিকিৎসার উপায় আবিষ্কার করেছিলেন, সেটা নিয়ে যাচ্ছিলেন সম্মেলনে ঘোষণা করবেন বলে? তাই যদি হয় তাহলে বলতেই হবে, মানবজাতির জন্য এদের মৃত্যু সাঙ্ঘাতিক এক লোকসান। অন্য যাত্রীদেরও সবার নিজ নিজ কাহিনী আছে। সবচেয়ে বড় কথা প্রিয়জনদের কাছে তারা সবাই ছিলেন মহামূল্য প্রাণÑ যে অভাব কোনো দিনই পূরণ হবে না।
এই যে এত লোক মহাকাশে হঠাৎ ও অসহায়ভাবে মারা গেলেন বিশ্বমানবতা কি মনে করছে যে তাতে তাদের সবারই অন্তত ক্ষুদ্র অংশেরও মৃত্যু হয়েছে? অবশ্যই না। বরং দেখা যাচ্ছে গদি ও ক্ষমতাই যাদের জন্য প্রথম ও প্রধান প্রয়োজন হত্যা ও মৃত্যু তাদের কাছে দাবা খেলার ঘুঁটি চালাচালির চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ কিছু নয়। রুশ সীমান্তের লাগোয়া ইউক্রেনের আকাশে গত বৃহস্পতিবারের (১৭ জুলাই) এক থোক মৃত্যু নিয়ে অবশ্য সে রকমেরই খেলা চলছে।

চূড়ান্ত দায়ী সম্রাট পুতিন?
ইউরোপ-আমেরিকার রাষ্ট্রনায়ক এবং বিমান পরিবহন বিশেষজ্ঞরা খুবই সতর্কতার সাথে হলেও আঙুল দেখাচ্ছেন রাশিয়ার দিকে। তারা বলছেন, ইউক্রেনের এ অঞ্চলটায় যে সশস্ত্র বিচ্ছিন্নতার যুদ্ধ চলছে, সে যুদ্ধ শুরু করিয়েছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিন। প্রায় সবাই স্বীকার করবেন বিদ্রোহীদের যুদ্ধাস্ত্র এবং নৈতিক ও কূটনৈতিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছে রাশিয়া। এবং মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে একই রকম কৌশল ব্যবহার করে পুতিন ইউক্রেনের ক্রাইমিয়া উপদ্বীপটি দখল করে নিয়েছেন।
ভøাদিমির পুতিনের এসব আচরণের কার্যকারণ বুঝতে হলে আরো পেছনে যেতে হবে। তিনি সোভিয়েত কমিউনিস্ট সাম্রাজ্যের ভয়াবহ বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থা কেজিবির একজন ডাকসাইটে এবং নৃশংস কর্মকর্তা (কর্নেল) ছিলেন। বলা হয়ে থাকে, সোভিয়েত ইউনিয়নের বহু ভিন্নমতাবলম্বীর হত্যার জন্য তিনি দায়ী ছিলেন। ১৯৮৯ সালের নভেম্বরে সোভিয়েত কমিউনিজমের পতন হয় এবং ১৯৯১ সালে ইউনিয়ন ভেঙে যায়, অঙ্গ দেশগুলো বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। হয় সোভিয়েত ইউনিয়ন ও কেজিবির প্রতি তার আনুগত্য অপরিবর্তনীয় ছিল, নয়তো পুতিন অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতকের জারদের (সম্রাট) মতো নিজেকে বিশাল রুশ সাম্রাজ্যের সম্রাট রূপে কল্পনা করেন।
সে যাই হোক, রুশ প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রক্ষমতা হাতে পেয়ে পুতিন বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া অঙ্গ দেশগুলোকে আবার মস্কোর দখলে ফিরিয়ে আনা, নিদেন মস্কোর প্রভাবাধীন করার কাজে মনোনিবেশ করেন। রাশিয়ার সোভিয়েত সময়ের বিশাল সামরিক শক্তি ব্যবহার করে অত্যন্ত রক্তক্ষরা যুদ্ধে তিনি মুসলিমপ্রধান দাগেস্তান ও চেচনিয়া দেশ দু’টি দখল করে রাখছেন। বাহ্যতই একই লক্ষ্যে ২০০৮ সালে তিনি আরেকটি সাবেক অঙ্গ দেশ জর্জিয়া আক্রমণ করেন। আন্তর্জাতিক প্রতিবাদের ঝড় প্রবল হয়ে উঠলে পুতিন পিছু হঠতে বাধ্য হন, কিন্তু জর্জিয়া রাজ্যটির দক্ষিণ অসেটিয়া অংশটি তিনি দখল করে নিয়েছেন।
ইউক্রেনের রুশ সীমান্তের লাগোয়া পূর্বাংশের কয়েকটি অঞ্চলে এবং ক্রাইমিয়ায় রুশ বংশোদ্ভূত ও রুশ ভাষাভাষীরা সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিলেন। এদের অনেকেই আবার রাশিয়ার নাগরিকও বটে। ২০১০ সালের নির্বাচনে রুশপন্থী ভিক্টর ইউনোকোভিচ প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি যে সরকার গঠন করেন তাতেও রুশপন্থীরা বেশ শক্তিশালী ছিলেন। রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিন তা নিয়েই সন্তুষ্ট ছিলেন, কিন্তু গত বছরের শেষার্ধে ইউক্রেনের পার্লামেন্ট ইউরোপীয় ইউনিয়নে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। মস্কোতে সন্দেহ করা হয় যে ইউক্রেন রুশ প্রভাব কাটিয়ে বেরিয়ে যেতে চাইছে। সম্ভবত মস্কোর অসন্তুষ্টির কথা বিবেচনা করে প্রেসিডেন্ট ইউনোকোভিচ ইইউতে যোগ দেয়ার চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করেন। রাজধানী কিয়েভে ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলন শুরু হয়। বেশ কিছু প্রাণহানিও হয়েছিল সেই আন্দোলনে। কয়েক দিন আত্মগোপনে থাকার পর ইউনোকোভিচ আত্মপ্রকাশ করেন মস্কোতে এবং ঘোষণা করেনÑ তিনি পদত্যাগ করেছেন।

রুশ উসকানিতে বিদ্রোহ
প্রায় সাথে সাথেই ক্রাইমিয়ার ও পূর্ব ইউক্রেনের রুশভাষীরা কিয়েভের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। লক্ষ করা যায়, বিদ্রোহীরা হঠাৎ করে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের অধিকারী হয়েছেন। বিদেশী সংবাদদাতাদের অনেকেই বলেছেন, বিদ্রোহীদের মধ্যে বহু পরিচয় গোপনকারী পেশাদার রুশ সৈন্যও দেখা গেছে। আগেই বলেছি, পুতিন ইতোমধ্যেই ক্রাইমিয়া দখল করে নিয়েছেন। পূর্ব ইউক্রেনের বিদ্রোহীদের মধ্যে এখনো মিলিশিয়ার ছদ্মবেশে অনেক পেশাদার রুশ সৈন্য আছে বলে সন্দেহ করা হয়। এসব অঞ্চল ইউক্রেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাশিয়ার সাথে যোগ দিতে চায়।
এ সন্দেহ ক্রমেই ঘনীভূত হচ্ছে যে, রাশিয়া থেকে পাওয়া বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে এবং সম্ভবত রুশ প্রকৌশলী সহায়তায় মালয়েশিয়ার এমএইচ১৭-কে ভূপাতিত করা হয়েছে। অনেক কারণ আছে সে সন্দেহের। বিগত কিছু দিনে ইউক্রেনের সরকারি বাহিনী বিদ্রোহ দমনের অভিযান চালাচ্ছে। কতকগুলো বিদ্রোহীকবলিত এলাকা তারা ইতোমধ্যেই মুক্ত করেছে। গত দু-তিন সপ্তাহে বিদ্রোহীরা ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে কয়েকটি সরকারি সামরিক হেলিকপ্টার, জঙ্গিবিমান ও একটি সামরিক পরিবহন বিমান ভূপাতিত করেছে। সেসব ক্ষেপণাস্ত্র অপেক্ষাকৃত সহজপ্রাপ্য। তারা ১০-১২ হাজার ফুটের বেশি উঁচুতে কোনো বিমানকে আঘাত করতে পারে না।
মালয়েশিয়ার যাত্রীবিমানটি যাচ্ছিল ৩৩ হাজার ফুট উঁচুতে। সেটিতে আঘাত করতে আরো উন্নত সামরিক ক্ষেপণাস্ত্রের এবং সে ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপের জন্য সবিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত কুশলীর প্রয়োজন। পশ্চিমা ইনটেলিজেন্স রিপোর্ট অনুযায়ী, এসএ১১ ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করে বিমানখানি ভূপাতিত করা হয়েছে। সাধারণ বিদ্রোহীরা এই উন্নত সামরিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করতে পেরেছে বলে বিশ্বাস করা যায় না। মস্কোর ভাণ্ডারে সে ধরনের বহু ক্ষেপণাস্ত্র আছে। বিদ্রোহীদের টেলিফোন আলাপ থেকে ধরা পড়েছে যে, তারা গত কয়েক দিনে রাশিয়া থেকে বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্র পেয়েছে। অসমর্থিত আলোকচিত্রে আরো দেখা যায়, বিমানধ্বংসী ক্ষেপণাস্ত্রবাহী একখানি ট্রাক রাশিয়া থেকে বিদ্রোহী অধ্যুষিত ইউক্রেন এলাকায় ঢুকছে। দুই দিন পর ট্রাকখানিকে আবার রাশিয়ায় ফিরে যেতে দেখা গেছে। কিন্তু তখন তাতে কোনো ক্ষেপণাস্ত্র ছিল না। তা ছাড়া যাত্রীবিমানখানি ভূপাতিত হয়েছে বিদ্রোহী এলাকায় এবং ক্ষেপণাস্ত্রটি বিদ্রোহী এলাকা থেকেই নিক্ষিপ্ত হয়েছিল বলে কিছু প্রমাণ আছে। একজন বিদ্রোহী টেলিফোনে উল্লাস প্রকাশ করছিলেন এই বলে যে, তারা আরো একখানি বিমান গুলি করে নামিয়েছে।

মৃতদের মর্যাদার চরম অবমাননা
বিমানখানি বিধ্বস্ত হওয়ার পরের ঘটনাবলি আরো মর্মান্তিক। সেসব ঘটনায় রুশসমর্থিত বিদ্রোহী বাহিনীর অপরাধের আরো কিছু পরোক্ষ প্রমাণ পাওয়া যায়। চার দিন তারা কোনো তদন্তকারী দলকে বিধ্বস্ত বিমানের ধারেকাছে যেতে দেয়নি। ইতোমধ্যে তারা বিমানের ‘ব্ল্যাকবক্স‘ ফাইট রেকর্ডার ও ধ্বংসাবশেষগুলো সরিয়ে নিয়েছে। মনে হতে পারে, নিজেদের দুষ্কর্মের প্রমাণ নষ্ট করার জন্যই এসব কাণ্ড তারা করে যাচ্ছে। চার দিনের মাথায় প্রায় দুই শ’ লাশ তারা উদ্ধার করে কাছের এক স্টেশনে হিমায়িত মালবাহী ট্রেনের বগিতে রেখেছে। ইউরোপে এখন ভীষণ গরম পড়ছে। এই গরমে সেসব লাশের এবং বাকি আরো এক শ’ লাশের যে কী অবস্থা, সহজেই কল্পনা করা যায়। আরো বড় কথা, ট্রেনে করে এসব লাশ তারা কোথায় নিয়ে যাবে ২৪ ঘণ্টা ধরে সে সম্পর্কে স্পষ্ট কিছু জানা যায়নি।
ইউরোপ, আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ার মিডিয়ায় মালয়েশীয় বিমান বিধ্বস্ত করার ঘটনা নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হচ্ছে রাশিয়া এবং পুতিনের। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কয়েকবার টেলিফোন করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে। রাশিয়ার বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থার হুমকিও দিচ্ছেন তিনি। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন রোববার আবারো ফোন করেছেন প্রেসিডেন্ট পুতিনকে। পরিস্থিতি হচ্ছে ব্রিটেন ও আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাগুলো আরো কঠোর করতে চায় (ক্রাইমিয়ার ঘটনার পর থেকে যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপীয় ইউনিয়ন কিছু কড়াকড়ি আরোপ করেছিল)। সে সুযোগও আছে। বিশেষ করে প্রতিরক্ষা প্রযুক্তির জন্য মস্কো পশ্চিমা দেশগুলোর ওপর অনেকখানি নির্ভরশীল। রাশিয়ার ব্যাংক ইত্যাদি ব্যবসায়ের এবং অলিগার্কদের (ধনকুবের) বিপুল বিত্তসম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করার কথাও সম্ভবত ভাবছেন তারা। সমস্যা হচ্ছে ইউরোপীয় ইউনিয়নের কয়েকটি সদস্য দেশ নিজেদের অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা বিবেচনা করে আমতা আমতা করছে। যেমনÑ জার্মানি তার জ্বালানির চাহিদার ৪০ শতাংশ আমদানি করে রাশিয়া থেকে। ফ্রান্সে এখন রাশিয়ার জন্য দুইখানি অত্যন্ত দামি যুদ্ধজাহাজ তৈরি হচ্ছে। মস্কোর বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে সে জন্যই তারা কম উৎসাহী।

গাজায় প্রাগৈতিহাসিক বর্বরতা
আরেকটি মানবতাবিরোধী অপরাধ ঘটে যাচ্ছে গাজায়। ইসরাইল গত ৮ জুলাই থেকে গাজায় সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। ইসরাইলের যুক্তি হচ্ছে হামাস সংস্থা গাজা থেকে ইসরাইলের দিকে তাদের ঘরে-তৈরি রকেট ছুড়ছে। রকেট ছোড়া বন্ধ করা পর্যন্ত তারা হামাসকে শাস্তি দেবে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে ইসরাইলি লবিগুলো। সুতরাং ওয়াশিংটন ইসরাইলের সব অপকর্ম সমর্থন করে যাচ্ছে। সেই সাথে ইউরোপ-আমেরিকার জায়োনিস্ট নিয়ন্ত্রিত ও প্রভাবিত মিডিয়াও। তারা ইসরাইলের এই যুক্তি বারবার আউড়ে যাচ্ছে যে, আত্মরক্ষার অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে ইসরাইলের আছে; কিন্তু ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে দখল করা ভূমিতে ইহুদি বসতি স্থাপন যে আন্তর্জাতিক আইন অবৈধ ঘোষণা করেছে, সে কথা কেউ বলছেন না। ইসরাইল-ফিলিস্তিনি বর্তমান বিরোধের সেটিই হচ্ছে কারণ। হামাস কী কারণে রকেট ছুড়ছে, সেটি কেউ খতিয়ে দেখছেন না।
ইসরাইল অবৈধভাবে ফিলিস্তিনি ভূমি দখল করে নিচ্ছে। বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও অত্যন্ত ঘনবসতি গাজা অঞ্চলকে তারা যেন কুলুপ এঁটে রেখেছে। গাজার ১৩ লাখেরও বেশি মানুষের বাইরে যাওয়ার, বাইরে থেকে অত্যাবশ্যকীয় ওষুধপত্র ও অন্যান্য পণ্য আমদানি করার অথবা নিজেদের উৎপাদন রফতানি করার সুযোগ দিচ্ছে না ইসরাইল এবং তার মিত্র মিসরের আল সিসি সরকার। মানুষ মরিয়া হলে যা করেন, গাজার মানুষও তাই করছেন; কিন্তু দখল করা এলাকার মানুষের প্রতিরোধ করার অধিকার যে আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত, ইসরাইল কিংবা তার পৃষ্ঠপোষকেরা যেন সে কথা মনে করতে পারছেন না।
ইতোমধ্যে গাজায় মানুষ মরছে, গুরুতর জখম হচ্ছে, রক্ত ঝরছে। ইসরাইলি অভিযানের প্রথম দুই সপ্তাহে প্রায় ছয় শ’ গাজাবাসী মারা গেছেন, আহত হয়েছেন তিন হাজারেরও বেশি। গত রোববার এক দিনেই ইসরাইলিরা শতাধিক মানুষকে হত্যা করেছে। হতাহতদের প্রায় সবাই নিরীহ বেসামরিক মানুষ। ৪০ শতাংশ নারী ও শিশু। ইসরাইলিরা বাইরের বিশ্বকে বলছে গাজার বিভিন্ন এলাকার মানুষকে তারা আগে থেকেই সরে যাওয়ার নোটিশ দিচ্ছে, কিন্তু হামাসের নির্দেশে তাদের সবাই সরে যাচ্ছে না বলেই হতাহতের সংখ্যা এত বেশি হচ্ছে। সমস্যা হচ্ছে ক্ষুদ্র গাজা চাকলাটাতে এরা যাবেন কোথায়? লক্ষাধিক ইতোমধ্যেই অন্যত্র সরে গেছেন; কিন্তু যেখানে তারা যাচ্ছেন সেখানে আবারো সরে যাওয়ার নোটিশ আসছে। গত সোমবার পর্যন্ত গাজার ৪৩ শতাংশ এলাকার অধিবাসীকে নিজেদের ঘরবাড়ি ছেড়ে যাওয়ার নোটিশ দেয়া হয়েছে। ক্রমান্বয়ে ঠেলে ঠেলে এসব মানুষকে ভূমধ্যসাগরে ফেলে দেয়াই ইসরাইলের উদ্দেশ্য কি না, কে জানে?
ইউরোপ-আমেরিকায় জায়োনিস্টদের প্রভাব বেশি, স্বীকার করি; কিন্তু তার বাইরেও তো দেশ আছে, মানুষ আছে? তারা আজ নীরব কেন? জন ডান যে সাড়ে চার শ’ বছর আগে লিখে গেছেনÑ ‘কোনো মানুষ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ নয়, সব মানুষ এক অবিচ্ছিন্ন মহাদেশের অংশ’, তার কী হলো? পূর্ব ইউক্রেনে রুশ সীমান্তের কাছে মালয়েশিয়ার বিমান যে ২৯৮ জন যাত্রী নিয়ে গুলিবিদ্ধ হলো সে ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কী বলেছে, কী করেছে? গাজায় যে শ’ শ’ মানুষ মারা যাচ্ছে, হাজারে হাজারে মানুষ জখম হচ্ছে; সে ব্যাপারে মিন মিন প্রতিবাদ ছাড়া আর কিছু করেছে সরকার?
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এখন বন্ধু খুঁজছেন। অন্তত বাইরে তার বন্ধু আছে দাবি করার অজুহাত খুঁজছেন। কয়েক মাস আগে বন্ধুর সন্ধানে মস্কোতেও গিয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশের মাথা বন্ধক রেখে বেহুদা রুশ সমরাস্ত্র কিনে এসেছেন। মালয়েশীয় বিমানের ব্যাপারে পুতিনের সমালোচনা করার সাহস তার হবে কী করে? এ দিকে ইসরাইলের সাথে আওয়ামী লীগের পৃষ্ঠপোষক ভারতের গলায় গলায় বন্ধুত্ব। দিল্লির পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুষমা স্বরাজ মাত্র গত সোমবার বলেছেন, ভারত ইসরাইলের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক শিথিল হতে দেবে না। ইসরাইলিরা ফিলিস্তিনি জাতিকে ধ্বংস করে দিলেও সম্ভবত সক্রিয় কোনো প্রতিবাদ তারা করবে না।
শুনেছি ভেতরে ভেতরে ঢাকার সরকারও ইসরাইলের সাহায্য নিচ্ছে। সুতরাং গাজার ব্যাপারে কঠোর কোনো অবস্থান নেয়া সরকার কিংবা শাসক দলের পক্ষে সম্ভব নয়। তাদের ১৪ দলের জোট অবশ্য বলেছে, তারা গাজায় একটা প্রতিনিধিদল পাঠাবে। সারা পৃথিবীর মানুষ জানেন তাদের সমর্থক ছাড়া ইসরাইল আর কাউকে গাজায় প্রবেশের ভিসা দেয় না। ১৪ দল লোক হাসানোর এই ব্যর্থ চেষ্টা না করলেও পারত। অবশ্য লোক হাসানোর ও রাষ্ট্রীয় আসনকে হাস্যকর করে দেয়াই বর্তমানের মন্ত্রীদের লক্ষ্য বলে মনে হয়। হাছান মাহমুদ নামক লোকটা ইতোমধ্যেই নিজেকে দেশের সবচেয়ে বড় মূর্খ প্রমাণিত করেছেন। তিনি বলেছেন, গাজার বর্তমান যুদ্ধের জন্য নাকি দায়ী খালেদা জিয়া। আর তথ্যমন্ত্রী দেশের মানুষের বাক ও সংবাদের স্বাধীনতাকে উপেক্ষা করে এখন বিদেশী রাষ্ট্রদূতদের বাক রোধ করার চেষ্টা করছেন।
(লন্ডন, ২২.০৭.১৪)
বিবিসি বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান
[email protected]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *