বিরাজমান ‘বৈরী’ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই শিগগির পুনর্গঠন করা হবে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি। একই সঙ্গে দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং উপদেষ্টা পরিষদও পুনর্গঠন করা হবে। দলের গঠনতন্ত্রে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে পুনর্গঠিত কমিটিগুলো অনুমোদন দেবেন চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সংশোধন করা হচ্ছে দলের গঠনতন্ত্রও। ‘অনুকূল সময় ও সুযোগ’ পেলে পরে দলের বর্ধিত সভা অথবা জাতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে চেয়ারপারসন কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হবে। পুনর্গঠিত স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা কমিটি ও নির্বাহী কমিটিতে আসবে বেশকিছু নতুন মুখ। ভারমুক্ত হয়ে মহাসচিব হবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। নির্বাহী কমিটির পাশাপাশি আওয়ামী লীগের মতো গঠন করা হবে বেশ কয়েকটি উপকমিটিও।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আ স ম হান্নান শাহ গতকাল সমকালকে বলেন, কিছু দিন .আগে তৃণমূল থেকে পুনর্গঠনের মাধ্যমে বিএনপিকে সাংগঠনিকভাবে শক্তিশালী করার উদ্যোগ
নেওয়া হলেও অনেক এলাকায় মামলা, হামলাসহ নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে তা ফলপ্রসূ হয়নি। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, জাতীয় কাউন্সিল ছাড়াই নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠন করা হবে কি-না সে ব্যাপারে তিনি নিশ্চিত নন।
যোগাযোগ করলে বিএনপির মুখপাত্র ড. আসাদুজ্জামান রিপন সমকালকে বলেন, দলের চেয়ারপারসন দেশে ফেরার পর দল পুনর্গঠন প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করা হবে। জাতীয় কাউন্সিল বা বর্ধিত সভা করা বা না করার ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত তার জানা নেই।
চলতি বছরের নভেম্বর বা ডিসেম্বরে ষষ্ঠ জাতীয় কাউন্সিল করার উদ্যোগ নিয়েছিল বিএনপি। এ লক্ষ্যে ৯ আগস্ট ৭৫টি সাংগঠনিক জেলাকে ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যেই জেলা, উপজেলা, পৌরসভাসহ সর্বস্তরে সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠনের জন্য চিঠি দেওয়া হয়। তবে সময়সীমা বেঁধে চিঠি দিলেও তাতে ব্যর্থ হয় তৃণমূল। স্থানীয় অধিকাংশ শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে মামলা থাকায় কেউ কারাগারে এবং কেউ আত্মগোপনে থাকায় সম্মেলনের মাধ্যমে নতুন কমিটি গঠন বা পুনর্গঠন করা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়ে চিঠি দিয়েছে অনেক জেলা। এ পরিস্থিতিতে মৌখিকভাবে ব্যর্থ কমিটিগুলোকে সময় বাড়িয়ে দিলেও দু’মাসেও পুনর্গঠন করতে পারেনি তারা। খালেদা জিয়া লন্ডন এবং ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বিদেশে চিকিৎসাধীন ও কারাগারে থাকায় কেন্দ্রীয়ভাবেও জাতীয় কাউন্সিলের কার্যক্রম তেমন গতি পায়নি। এ পরিস্থিতিতে জাঁকজমকভাবে জাতীয় কাউন্সিল করার সিদ্ধান্ত ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে দু’মাস পর আজ দেশে ফিরে দল পুনর্গঠনে হাত দেবেন খালেদা জিয়া।
বিএনপির গঠনতন্ত্রে ‘চেয়ারম্যানের কর্তব্য, ক্ষমতা ও দায়িত্ব’ সম্পর্কিত ৭ ধারার (খ)(১) উপধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে দলের প্রধান হিসেবে চেয়ারম্যান দলের সর্বময় কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয়সাধন করবেন এবং তদুদ্দেশ্যে জাতীয় কাউন্সিল, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, জাতীয় নির্বাহী কমিটি, বিষয় কমিটিসমূহ এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত অন্যান্য কমিটির ওপর কর্তৃত্ব করবেন এবং তাদের কার্যাবলি নিয়ন্ত্রণ, তদারক ও সমন্বয়সাধন করবেন। (খ)(৪) উপধারায় চেয়ারম্যান প্রয়োজন মনে করলে জাতীয় নির্বাহী কমিটি, জাতীয় স্থায়ী কমিটি, বিষয় কমিটিসমূহ এবং চেয়ারম্যান কর্তৃক মনোনীত অন্যান্য কমিটি বাতিল করে দিতে পারেন। (খ)(৬) উপধারার ক্ষমতাবলে চেয়ারম্যান জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং জাতীয় নির্বাহী কমিটির শূন্য পদ পূরণ করতে পারবেন।
সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া লন্ডনে দলের সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে পরামর্শ করে দলের স্থায়ী কমিটি, উপদেষ্টা ও নির্বাহী কমিটি পুনর্গঠনের একটি খসড়া তৈরি করেছেন। ফেরার কয়েকদিনের মধ্যে দলীয় নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করে খসড়া কমিটি চূড়ান্ত করা হবে।
সূত্র জানায়, বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনা হবে। বিশেষ করে বয়োবৃদ্ধ, অসুস্থ, নিষ্ক্রিয় ও বিতর্কিত কয়েকজন সদস্যকে বাদ দিয়ে ১৯ সদস্যের স্থায়ী কমিটিতে কাউন্সিলে জনপ্রিয়, ক্লিন ইমেজধারী, মেধাবী, ত্যাগী ও সাহসী বেশ কিছু তরুণ নেতাকে অন্তর্ভুক্ত করা হবে বলে বিএনপির উচ্চপর্যায়ের সূত্র নিশ্চিত করেছে।
এর মধ্যে রয়েছেন_ বর্তমান চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ড. ওসমান ফারুক, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, খন্দকার মাহবুব হোসেন, ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল্লাহ আল নোমান, মেজর (অব.) হাফিজ উদ্দিন আহমেদ, বর্তমান মুখপাত্র ও আন্তর্জাতিক সম্পাদক ড. আসাদুজ্জামান রিপন। মহাসচিব হিসেবে স্থায়ী কমিটির সদস্য হবেন মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এ ছাড়া ভাইস চেয়ারম্যান সাদেক হোসেন খোকা দুদকের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের মামলায় সাজাপ্রাপ্ত হওয়ায় তার স্থায়ী কমিটির সদস্য হওয়া অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। স্থায়ী কমিটি থেকে বাদ পড়তে পারেন ড. আরএ গনি, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, শামসুল ইসলাম, বেগম সারোয়ারী রহমান প্রমুখ। স্থায়ী কমিটি থেকে যারা বাদ পড়বেন তাদের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য করা হবে। ফাঁসি কার্যকর হলে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর পদও শূন্য হবে।
গঠনতন্ত্রের বিভিন্ন ধারা ও উপধারায় আনা হবে গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন ও বিয়োজন। ইতিমধ্যে গঠনতন্ত্রে সংশোধনীর খসড়া প্রণয়নে দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সমন্বয়ে একটি উপকমিটিও গঠন করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটিকে দুটি ভাগ করে একটি কার্যকরী কমিটি এবং আরেকটি জাতীয় নির্বাহী কমিটি হিসেবে গঠনের চিন্তা-ভাবনাও চলছে। এতদিন গঠনতন্ত্রে দলের ‘চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা পরিষদ’ থাকলেও এবারই প্রথম সরাসরি ‘বিএনপির উপদেষ্টা পরিষদ’ গঠন করা হচ্ছে। তবে দলের চেয়ারপারসনকে পরামর্শ দিতে বিষয়ভিত্তিক অর্থাৎ, মন্ত্রণালয়ভিত্তিক পৃথক বেশকিছু ‘উপকমিটি’ বা ‘সেল’ গঠন করা হবে। প্রতিটি ১১ সদস্যের কমিটির সদস্য হবেন দল-সমর্থক সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিশেষজ্ঞরা। বিগত কাউন্সিলে আলোচনা হলেও কার্যকর না হওয়া ‘এক নেতার এক পদ’ নীতিও এবার গঠনতন্ত্রের সংশোধনীতে সংযোজন করা হচ্ছে।
বিগত কাউন্সিলের মাঠপর্যায়ের নেতারা ‘এক নেতার এক পদে’র নিয়ম রাখার পক্ষে জোরালো দাবি তুললেও শেষ পর্যন্ত তা কার্যকর হয়নি। প্রভাবশালী নেতাদের চাপে গঠনতন্ত্রে তা যুক্ত করা যায়নি। এবার ‘একজনের এক পদ’ নীতি গঠনতন্ত্রে সংযোজন করা হচ্ছে। কোনো ব্যক্তি জেলা, মহানগর বা থানার সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়ে আবার কেন্দ্রীয় বা অন্য কোনো স্তরের পদে থাকতে পারবেন না। বর্তমানে বিএনপির কোনো কোনো নেতা একাধারে ৩-৪টি পদেও রয়েছেন। উপজেলা, জেলা, মহানগরের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হয়ে কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির পদে এবং অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পদেও রয়েছেন। বড় দল হওয়াতে অনেক যোগ্য ও ত্যাগী নেতা হয়েও পদের অভাবে নেতৃত্বে আসার সুযোগ পাচ্ছেন না।
১৬ বছর পর ২০০৯ সালের ৮ ডিসেম্বর বিএনপির পঞ্চম জাতীয় কাউন্সিল অনুষ্ঠিত হয়।