ঢাকা: আকাশপথে হু হু করে স্বর্ণ আসছে বাংলাদেশে। এ বছরের প্রথম চার মাসে বৈধ পথে স্বর্ণ এসেছে এক হাজার ৪৬০ কেজি। আর গত ১০ মাসে ঢাকা ও চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে শুল্কায়ন করা হয়েছে এক হাজার ৬৫০ কেজি স্বর্ণের। অথচ ২০১২-১৩ অর্থবছরে মাত্র ৩২ কেজি স্বর্ণের শুল্ক আদায় করা হয়েছিল।
ঢাকা কাস্টম হাউসের হিসাবে, ব্যাগেজ নীতিতে ঘোষণা দিয়ে বিদেশ ফেরত যাত্রীরা এই স্বর্ণ দেশে এনেছেন। এ থেকে শুল্ক আদায় হয়েছে দুই কোটি ২২ লাখ টাকা।
শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, বৈধভাবে এসব স্বর্ণের বেশির ভাগই দেশে থাকছে না। ভারতে পাচার হচ্ছে।
নাম প্রকাশে ঢাকা কাস্টম হাউসের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, বিমানবন্দরগুলোয় স্বর্ণের শুল্ক দেওয়ার সময় যাত্রীদের সারি দিন দিন দীর্ঘ হচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘বছর খানেক আগেও সারা দিন এক-দুজন যাত্রীর কাছ থেকে স্বর্ণের শুল্ক আদায় করা হতো। এখন প্রতিদিন আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
এদিকে শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গত ৪ এপ্রিল মালয়েশিয়া থেকে আসা আবদুর রাজ্জাক নামের এক ব্যক্তি ছয় কেজি স্বর্ণসহ ঢাকা বিমানবন্দরে ধরা পড়েন। ওই যাত্রী গত এক বছরে ৩৪ বার মালয়েশিয়াসহ বিভিন্ন দেশে যাতায়াত করেছেন। প্রতি মাসে রাজ্জাক তিনবার বিদেশ যেতেন। কোনো কোনো যাত্রী সপ্তাহে দুইবার মালয়েশিয়া-সিঙ্গাপুর গিয়ে স্বর্ণ এনেছেন। তবে আইনানুযায়ী আমরা তো কিছু করতে পারি না।’
কাস্টম হাউসের তথ্যানুযায়ী, গত ২৬ এপ্রিল হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ১০৫ কেজি স্বর্ণ ধরা পড়ার দিনও ৫০ কেজি স্বর্ণের শুল্ক আদায় করা হয়েছে।
জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া—এ তিনটি দেশ থেকে বেশির ভাগ স্বর্ণ দেশে আসছে। এসব রুটের অনেক যাত্রীই কম-বেশি স্বর্ণ আনছেন।
ব্যাগেজ নীতি অনুযায়ী, একজন যাত্রী ২০০ গ্রাম ওজনের স্বর্ণালংকার বা স্বর্ণের বার আনতে পারেন। এক ধরনের অলংকার ১২টি আনা যায়। এ ছাড়া বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়মানুযায়ী, সর্বোচ্চ দুই কেজি স্বর্ণ আনতে পারেন। এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে মধ্যপ্রাচ্য, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর ফেরত বেশির ভাগ যাত্রী স্বর্ণের বার বেশি নিয়ে আসছেন।
কাস্টম হাউসের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সালের জুলাই মাসে দুই কেজি, আগস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে এক কেজি করে স্বর্ণের শুল্ক আদায় হয়। অক্টোবরে পাওয়া যায় ২০ কেজি স্বর্ণের শুল্ক। নভেম্বরে এর পরিমাণ দাঁড়ায় ৫০ কেজি। ডিসেম্বর মাসে তা বেড়ে হয় ১০০ কেজি।
তবে এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এক হাজার ৪৬০ কেজি স্বর্ণের শুল্ক আদায় করা হয়েছে। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ২০০, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩০০ ও মার্চ মাসে ৩০০ কেজি স্বর্ণ। কিন্তু এপ্রিল মাসে আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে ৬৬০ কেজি স্বর্ণের শুল্ক পেয়েছে কাস্টম হাউস। প্রতি কেজি স্বর্ণে সাড়ে ১৩ হাজার টাকা হারে এই শুল্ক নেওয়া হয়েছে।
গত জুলাই থেকে এ বছর এপ্রিল পর্যন্ত চট্টগ্রাম শাহ আমানত বিমানবন্দরে প্রায় ১৫ কেজি স্বর্ণের শুল্ক পাওয়া গেছে। এদিকে দেশে ২০১৩ সালের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত দুই হাজার কেজিরও বেশি স্বর্ণ আটক করা হয়েছে।
বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, স্বর্ণ ব্যবসায়ী, বিদেশ ফেরত যাত্রী, শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিশ্ব বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম ভরিপ্রতি প্রায় ছয় হাজার টাকা বেশি। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও দুবাইয়ে গত ১০ মের হিসাবে এক ভরি স্বর্ণের দাম ৪০ হাজার টাকা। সেই হিসাবে বাইরে থেকে ২০০ গ্রাম ওজনের একটি স্বর্ণের বার দেশে বিক্রি করলে একজন যাত্রী প্রায় এক লাখ টাকা লাভ করতে পারেন। তা ছাড়া বাংলাদেশকে সহজ পথ হিসেবে ব্যবহার করে ভারতে স্বর্ণ পাচার করছে একটি চক্র।
শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মইনুল খান জানান, গোয়েন্দা তত্পরতার স্বর্ণ বেশি ধরা পড়েছে। তাই এখন ব্যাগেজ রুলের আওতায় স্বর্ণ বেশি আসছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের চেয়ারম্যান গোলাম হোসেনের মতে, স্বর্ণ আসার এই প্রবণতা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তিনি বলেন, অবশ্য ঘন ঘন বিদেশ গিয়ে স্বর্ণ আনার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। এ জন্য ব্যাগেজ নীতিতে পরিবর্তন আনা হবে।
স্বর্ণ আনার এই প্রবণতা অর্থনীতির জন্য ভালো নয়—এমন মন্তব্য করেছেন অর্থনীতিবিদ এম এম আকাশ। তিনি বলেন, এর ফলে বিদেশ থেকে ডলার আসা কমে যাবে। আর স্বর্ণ এলে সেটি তো অলস হয়ে বসে থাকবে।
বাংলাদেশ পোদ্দার সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবদুল হান্নান বলেন, ‘দেশে দাম বেশি থাকায় স্বর্ণের বাজার মন্দা। বিদেশ থেকে লোকজন স্বর্ণ দিয়ে আমাদের কাছ থেকে গয়নাই বেশি বানাচ্ছেন।’
বাংলাদেশ জুয়েলার্স সমিতির সাধারণ সম্পাদক দেওয়ান আমিনুল ইসলাম বলেন, সরকারকে একটি স্বর্ণ বিপণন সংস্থা গঠনের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাহলে দেশের পাশাপাশি বিদেশেও স্বর্ণালংকার রপ্তানি করা যাবে। এর ফলে দেশের অলংকার শিল্পের মন্দা কাটবে। প্রথম আলো..