আসলেই কি কোনো তদন্ত হচ্ছে! তদন্ত হলে খুনিরা ধরা পড়ছে না কেন! একের পর এক মুক্তচিন্তক লেখক-প্রকাশক হত্যার প্রতিবাদে আয়োজিত সভা-সমাবেশে এ কথাই বারবার আলোচিত হচ্ছে। নিহত ব্যক্তিদের স্বজনেরা পর্যন্ত হতাশ হয়ে বিচারের দাবি ও আশা ছেড়ে দিচ্ছেন।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারাও বলছেন, এসব মামলা তদন্তের সক্ষমতা তাঁদের নেই। যাঁরা চোর-ডাকাত-ছিনতাইকারীদের পেছনে দৌড়াচ্ছেন, তাঁদেরই জঙ্গি মামলার তদন্তে কাজে লাগানো হচ্ছে। জঙ্গিবাদ এখন যে পর্যায়ে রয়েছে, তা মোকাবিলার জন্য বিশেষায়িত বাহিনীর প্রয়োজন। কিন্তু পুলিশের সে রকম কোনো বাহিনী নেই।
২০১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি রাতে রাজধানীর উত্তরায় ব্লগার আসিফ মহিউদ্দীনের ওপর হামলার মধ্য দিয়ে এ ধারার শুরু হয়। আসিফকে চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে আহত করে হামলাকারীরা। এর এক মাস পর ১৫ ফেব্রুয়ারি মিরপুরে বাসার সামনে ব্লগার আহমেদ রাজীব হায়দারকে একই কায়দায় কুপিয়ে হত্যা করা হয়। চলতি বছরেই পাঁচজন লেখক, প্রকাশক ও ব্লগারকে খুন করা হয়েছে। এখন পর্যন্ত লেখক, প্রকাশক ও ব্লগার হত্যায় একজন অভিযুক্তকেও শাস্তির মুখোমুখি করা সম্ভব হয়নি। এ বছর ঘটে যাওয়া চারটি খুনের কোনো আসামিই ধরা পড়েনি। ব্লগার ওয়াশিকুর রহমান (বাবু) হত্যার ঘটনায় দুই আসামিকে জনতা ধরে দিলেও তাদের কাছ থেকে পুলিশ কোনো তথ্যই বের করতে পারেনি। এই অবস্থায় কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি দমনের জন্য বিশেষ বাহিনী না থাকার কারণে এসব বিশেষায়িত অপরাধীকে ধরা যাচ্ছে না। জঙ্গিরা নতুন নতুন ছদ্মবেশ ও কৌশল বের করলেও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সেই তিমিরেই রয়ে গেছে।
কর্মকর্তারা জানান, সরকারের কয়েকটি গোয়েন্দা সংস্থার ‘জঙ্গি’ সেল থাকলেও বিশেষায়িত কোনো ইউনিট নেই। তবে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কার্যক্রম তথ্য প্রদানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। জঙ্গি দমনে পুলিশের কোনো বিশেষায়িত ইউনিট নেই। তবে পুলিশের বিশেষ শাখা র্যাবের গোয়েন্দা শাখার মধ্যে জঙ্গি দমনের একটি বিশেষায়িত সেল রয়েছে। সেই সেলেও অল্প কয়েকজন কাজ করছেন।
পুলিশ ও র্যাবের কর্মকর্তারা বলছেন, জঙ্গি মামলা তদন্ত করার সক্ষমতা একেবারেই নেই থানা-পুলিশের। অথচ থানার মাধ্যমে পুলিশের নেটওয়ার্ক দেশের সর্বত্র বিস্তৃত। পুলিশের পক্ষেই সম্ভব প্রত্যন্ত এলাকার প্রান্তিক মানুষের কাছে পর্যন্ত পৌঁছানো। কিন্তু জঙ্গি গ্রেপ্তার এবং এ-সংক্রান্ত মামলা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি তদন্ত করেছে র্যাব ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। প্রকাশক ফয়সল আরেফিন (দীপন) হত্যা মামলা ও প্রকাশক আহমেদুর রশীদ (টুটুল)সহ তিনজনকে হত্যাচেষ্টা মামলা দুটির তদন্তভারও গতকাল মঙ্গলবার ডিবিতে স্থানান্তরিত হয়েছে।
র্যাব জানিয়েছে, প্রতিষ্ঠার পরের ১১ বছরে র্যাব ১ হাজার ১৬৫ জন জঙ্গিনেতা ও সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে, যার মধ্যে ৬০৩ জনই জেএমবির সদস্য। র্যাবের দায়িত্বশীল একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এখন ধরে-মেরে তাদের দমন করা অনেক শক্ত। তাদের মগজ ধোলাই বন্ধ করতে না পারলে হানাহানি বাড়বে। এখন পর্যন্ত যা গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে, তাতে আরও বড় নাশকতার ঘটনা ঘটতে পারে। এই অবস্থায় জঙ্গিদের শিরা-উপশিরায় ঢুকতে হবে। তাদের উদ্বুদ্ধকরণ, নিয়োগ, অর্থায়ন—এগুলো বন্ধ করতে হবে। এর জন্য বিশেষায়িত ইউনিট প্রয়োজন। যাঁরা এগুলো নিয়ে কাজ করবেন তাঁদের অবশ্যই সেসব বিষয় নিয়ে পড়াশোনা, প্রশিক্ষণের সুযোগ দিতে হবে। দিতে হবে বাড়তি প্রণোদনাও।’
প্রায় অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে জঙ্গি নিয়ে কাজ করা র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গিবাদ আসলে ওদের মগজে। সেখান থেকে এটা সরাতে হলে এভাবে হবে না, সমন্বিত কৌশল প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর পুলিশের একজন কর্মকর্তা গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিবছর পুলিশের ২৫-৩০ জন কর্মকর্তা বিদেশে পড়তে যান। যাঁদের অর্ধেকেরই পড়ার বিষয় থাকে ‘কাউন্টার টেররিজম’ বা এ-সংশ্লিষ্ট বিষয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ বিষয়ে অনেকেই পিএইচডি নিয়েছেন। তবে দেশে ফিরে তাঁরা সে কাজে নিযুক্ত হচ্ছেন না। মাঠপর্যায়ে কাজে লাগছে না তাঁদের বিদ্যা। কারণ, তাঁদের সে বিদ্যা কাজে লাগানোর প্ল্যাটফর্ম নেই।
প্রায় সাত বছর ধরে জঙ্গি এবং এ-সংক্রান্ত মামলা দেখভাল করছেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (ডিবি) মনিরুল ইসলাম। গতকাল তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আর দশটা সাধারণ অপরাধ দমনের পাশাপাশি ডিবিকে জঙ্গি দমনের কাজও করতে হয়। এ পরিস্থিতিতে বিশেষায়িত ইউনিট প্রয়োজন।
ঢাকা মহানগর ডিবির একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বলেন, এখানে যাঁরা চোর-ডাকাত, ছিনতাইকারীদের নিয়ে কাজ করছেন, হরতাল ডিউটি ও নাশকতা দমনে কাজ করছেন, তাঁদেরই আবার জঙ্গি দমনের কাজে লাগানো হচ্ছে। চুরির মামলা থেকে শুরু করে রাস্তায় মিছিল করে ককটেল মারলে, গাড়ি চুরি আর জঙ্গি—সব ঘটনার তদন্ত করছেন তাঁরা। ওই কর্মকর্তা বলেন, এখন ডিবিতে যে দুজন কর্মকর্তাকে জঙ্গি দমনে সবচেয়ে বেশি কাজে লাগানো হচ্ছে, তাঁদের একজন কয়েক মাস আগেই শিল্প পুলিশ থেকে বদলি হয়ে এসেছেন। আরেকজন একাধারে বোমা অপসারণ দল, অপহরণ প্রতিরোধ দল পরিচালনার পাশাপাশি জঙ্গিদের ধরতেও কাজ করে যাচ্ছেন। আরও কয়েকজন কর্মকর্তা কাজ করে যাচ্ছেন, তবে তাঁদের কারোরই এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা বা প্রশিক্ষণ নেই। যার ফলে জঙ্গিদের শিক্ষণ, প্রশিক্ষণ সম্পর্কে জানা, তাদের জীবনাচরণ সম্পর্কে বুঝে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেওয়ার কোনো সুযোগ থাকছে না।
ওই কর্মকর্তা বলেন, জঙ্গিদের কাজ অনেক জটিল হয়েছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গে এখন অনেকগুলো বিষয় জড়িয়ে পড়ছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে, এখন জঙ্গিদের তত্ত্ব ও বার্তা প্রচার, নতুন সদস্য নিয়োগ, অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ হচ্ছে ইন্টারনেটের মাধ্যমে। এর জন্য অন্তর্জালে বিশেষ দৃষ্টি নিয়ে এগুলো নজরদারির এখন কেউ নেই। এ ছাড়া জঙ্গিদের মন ও মনন বোঝা এবং সে অনুযায়ী আগাম তৎপরতা চালাতে হবে। তিনি বলেন, গ্রেপ্তার জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদ, পাল্টা উদ্বুদ্ধকরণ ও পুনর্বাসন করতে হবে, নজরদারিতে রাখতে হবে। কারা, কেন জঙ্গিবাদে জড়াচ্ছে, সে বিষয়ে গবেষণা করতে হবে। সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে। এসবের জন্য বিশেষায়িত ইউনিট প্রয়োজন। ওই ইউনিটের যাঁরা থাকবেন, তাঁরা জঙ্গি নিয়েই লেগে থাকবেন। এ নিয়ে প্রতিনিয়ত নজরদারি ও গবেষণা করবেন।
ওই কর্মকর্তা বলেন, ইন্টারনেটে করা হচ্ছে। আর এরপরেই পাড়া-মহল্লার ক্লাব গড়ার মতো কয়েকজন ক্ষুব্ধ তরুণ একত্র হয়ে একেকটা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলছেন। এরপরে বিভিন্ন জঙ্গি নামে নিজেদের বার্তা প্রকাশ করছে। আসলে খুঁজতে হবে—এদের বিপথগামী করছে কারা।
ডিবির শীর্ষস্থানীয় ওই কর্মকর্তা বলেন, এ রকম একটি বিশেষায়িত ইউনিটে কর্মকর্তাদের ঝুঁকি থাকবে বেশি। তাঁদের সে পরিমাণে ভাতা ও প্রণোদনা দিতে হবে। প্রশিক্ষণ লাগবে। কর্মকর্তাদের মোটিভেশনও থাকতে হবে। এটা অন্য কাজের মতো না। সারা বছর ধরে লেগে থাকতে হবে। হয়তো মাঝেমধ্যে একটা অপারেশন হবে। পড়তে হবে, জানতে হবে। সে জন্যই প্রণোদনা প্রয়োজন। আবার এসব ক্ষেত্রে এখন গোয়েন্দা তথ্য কিনতে হয়। সে জন্য বিশেষ ভাতা, পর্যাপ্ত সোর্স মানিও লাগবে।
জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক নূরুল হুদা প্রথম আলোকে বলেন, জঙ্গির ব্যাপারে আগে থেকে মনোযোগ দেওয়া হয়নি। আবার কেউ কেউ এসব কাজকে উৎসাহিত করেছে। সে কারণে আজকের এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন এসব প্রতিরোধে একটি বিশেষায়িত বাহিনীর প্রয়োজনীয়তা কথা উঠছে। তবে এসব দমন করতে হলে দরকার রাজনৈতিক ঐকমত্য। আর দমন করতে না পারলে রাষ্ট্র ক্ষতিগ্রস্ত হবে।