ফাহিমা নূর/ মো: জাকারিয়া গাজীপুর: রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে কেঁচোর বিষ্ঠা থেকে তৈরী জৈব সার বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে সাড়া ফেলে দিয়েছে গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলার জাংগালিয়া ইউনিয়নের আজমতপুর গ্রাম। কম খরচে এই জৈব সার কৃষিক্ষেত্রে যেমন সহায়ক তেমনি এই সার বিক্রি করে জীবিকার সন্ধানও আবিস্কার করেছেন অনেক কৃষক।
সরেজমিন ঘুরে জানা যায়, আজমতপুর গ্রামের অনেক কৃষকের বাড়ির আঙ্গিনায় কেঁচো সার তৈরীর প্রকল্প। রাসায়নিক সারের বিকল্প হিসেবে কেঁচোর বিষ্ঠা থেকে তৈরি জৈব সার বা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদনে গ্রামটি এখন নতুন পরিচিতি পাচ্ছে। আর এই পরিবর্তনের সূচনা করেছেন স্থানীয় কৃষক কামরুজ্জামান শেখ।

কামরুজ্জামানের বাড়ির পাশে পরিত্যক্ত জায়গায় তৈরি হয়েছে ছোট্ট এক ভার্মি কম্পোস্ট কেন্দ্র্র। সেখানে ১০টি রিং ও সিমেন্টের তৈরি প্রায় ১০ ফুট লম্বা হাউজে চলে উৎপাদন কার্যক্রম। কেঁচো সার তৈরিতে মাটির তৈরি নালা বা চারি অথবা ইট দিয়ে নির্মিত চৌবাচ্চায় বাসি পচা গোবর ঢেলে ভরে দিতে হয়। অতঃপর সেখানে ২০০ থেকে ৩০০ কেঁচো ছেড়ে দিতে হয়। এই কেঁচোগুলো গোবর খেয়ে একসময় মল ত্যাগ করে। এই মলই কেঁচো সার। প্রথমে গোবর ৫-৭ দিন গ্যাসমুক্ত করে সেখানে কেঁচো ছাড়া হয়। প্রায় ৩৫ থেকে ৪০ দিনের মধ্যে তৈরি হয় পুষ্টিগুণে ভরপুর জৈব সার। শুকিয়ে তা প্যাকেটজাত করে বাজারে বিক্রি করা হয়। বর্তমানে এখান থেকে মাসে এক টনেরও বেশি ভার্মি কম্পোস্ট বাজারজাত হয়।
কামরুজ্জামানের প্রকল্প দেখভালে পাওয়া গেলো কামরুজ্জামানের ছেলে আশিকুর রহমানকে (১৪)। সে স্থানীয় আজমতপুর আদর্শ স্কুল এন্ড কলেজে ৮ম শ্রেনীতে পড়ে। বড় ভাই আতিকুর রহমান কলেজে পড়ে। বাবার এই কাজে দুই ভাই সহযোগিতা করে পড়ার ফাঁকে ফাঁকে জানাল আশিক। সে জানায়, এই কেঁচো সার বিক্রি করে তার বাবা দুই ভাইয়ের লেখাপড়ার খরচ মিটানোর পাশাপাশি সুন্দর মত সংসারও চালায়।
জানা গেছে, প্রথমে নিজের জমিতে জৈব সার ব্যবহারের প্রয়োজনে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপজেলা কৃষি অফিসের পরামর্শে কামরুজ্জামান ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন শুরু করেন। কৃষি অফিস থেকে পান ১০টি রিং, ভার্মি কম্পোস্ট হাউজ, প্রয়োজনীয় কেঁচো ও প্রশিক্ষণ। এরপর তাঁর হাতে গড়া সাফল্য দেখে আগ্রহী হন আশপাশের কৃষকরাও। বর্তমানে তাঁর পথ অনুসরণ করে একই ইউনিয়নের ফজলুল হক মোড়ল, মোতালিব ব্যাপারী, বিল্লাল হোসেন, মোস্তফা কামাল, মহসিন শেখ, মো. আঃ ছাত্তার, মো. মজিবুর মোড়ল, নিলুফা ইয়াসমিন, ফারজানা আক্তারসহ অন্তত ডজনখানেক কৃষক বাণিজ্যিকভাবে এই জৈব সার উৎপাদন করছেন। নিজেদের প্রয়োজন মিটিয়ে তারা বিক্রিও করছেন এই জৈব সার বা কেঁচো সার।
কামরুজ্জামান শেখ বলেন, শুরুতে নিজের প্রয়োজনে জৈব সার তৈরি করলেও এখন এটি আমার আয়ের অন্যতম উৎস। প্রতি কেজি সার ১৫-২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। চাহিদা এত বেশি যে বাজারজাত করতে কোনো কষ্ট হয় না। কেঁচোও এখন আলাদা করে বিক্রি হয়, প্রতি কেজির দাম দেড় থেকে দুই হাজার টাকা।
কৃষি অফিস সূত্র জানায়, প্রকল্পের আওতায় নতুন কৃষকদের জন্য দেওয়া হয়েছে ভার্মিকম্পোস্ট সেপারেটর মেশিন, পলিব্যাগ ও সিলিং মেশিন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সার স্থানীয় রাসায়নিক সারের দোকানেও বিক্রি করছেন।
স্থানীয়রা বলছেন, এখনকার আজমতপুর শুধু ফসল নয়-জৈব সারের উৎপাদনেও পরিচিতি পাচ্ছে। যদি এ ধারা অব্যাহত থাকে, তবে একদিন জাংগালিয়া ইউনিয়নের পুরো আজমতপুর গ্রামই হয়ে উঠবে ‘ভার্মি কম্পোস্টের গ্রাম’ বা কেঁচো সারের গ্রাম।
কালীগঞ্জ উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ ফারজানা তাসলিম বলেন, কামরুজ্জামানের উদ্যোগকে কেন্দ্র করে আমরা নতুন কৃষকদেরও প্রশিক্ষণ দিয়েছি। ভার্মি কম্পোস্ট মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা কমানো এবং ফসলের উৎপাদন খরচ হ্রাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। রাসায়নিক সারের তুলনায় এটি নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। বর্তমানে কালিগঞ্জ উপজেলায় ১২টি প্রদর্শনী চলছে। আজমত গ্রামের উল্লিখিত কৃষকরা ছাড়াও এই প্রকেল্পর আওতায় কালিগঞ্জের জাঙ্গালিয়ার শেফালী বেগম,শফিকুল ইসলাম, মোক্তারপুরের আমান উল্লাহ, নরুনের ফকির মো: মোস্তফা ভার্মি কম্পোস্ট উৎপাদন করছেন।
কেঁচো সারের গুণাগুণ:
কেঁচো মানুষের অন্যতম উপকারী ক্ষুদ্র প্রাণী। বিশেষ প্রজাতির কেঁচো ব্যবহার করে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর বর্জ্য ও দেহাবশেষকে প্রক্রিয়াকরণের পর যে সার পাওয়া যায় তাকেই কেঁচো সার বা ভার্মি কম্পোস্ট বলে। মূলত জৈব পদার্থ খাওয়ার পর কেঁচো যে মল ত্যাগ করে, তা-ই কেঁচো কম্পোস্ট বা ভার্মি কম্পোস্ট। কেঁচো কম্পোস্টে অন্যান্য কম্পোস্টের চেয়ে প্রায় ৭ থেকে ১০ শতাংশ পুষ্টিমান বেশি থাকে। একটি আদর্শ ভার্মি কম্পোস্টে শতকরা ১.৫৭ ভাগ নাইট্রোজেন, ১.২৬ ভাগ ফসফরাস, ২.৬০ ভাগ পটাশ, ০.৭৪ ভাগ সালফার, ০.৬৬ ভাগ ম্যাগনেসিয়াম, ০.০৬ ভাগ বোরন, ১৮ ভাগ জৈব কার্বন, ১৫ থেকে ২৫ ভাগ পানি ও সামান্য পরিমাণ হরমোন রয়েছে। ভার্মি কম্পোস্ট বা কেঁচো সার মাটির পানি ধারণ করার ক্ষমতা এবং বায়ু চলাচল বৃদ্ধি করে। ফলে মাটির উর্ববরতা শক্তি বৃদ্ধি পায়। এক মাসের বাসি গোবরে কেঁচো সার ভালো হয়।


