
গাজীপুর: বিএনপির জন্মলগ্ন থেকেই রাজনৈতিক জীবন শুরু। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই শুরু হয় রাজপথ চলা। রাজপথের ত্যাগী কর্মী অধ্যাপক এম এ মান্নান ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান থেকে হয়েছেছেন প্রতিমন্ত্রী ও মেয়র। গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের প্রথম হয়েছিলেন তিনি। সরকারের গুরুত্বপূৃ্ণ দুটি মন্ত্রনালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেন অধ্যঅপক এম এ মান্নান। গাজীপুর সিটিকরপোরেশনের মেয়র থাকা অবস্থায় ২৮ মাস মিথ্যা মামলায় কারাগারে ছিলেন তিনি। বার বার বরখাস্ত হলেও আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে চেয়ার ফিরে পান। অবশেষে কারামুক্ত হলেও রোগমুক্ত হতে পারেননি তিনি। ২০২২ সালের ২৮শে এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে গাজীপুরের এই কৃতি সন্তান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই নেতার মৃত্যুতে বিএনপি’র জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক মহলে নেমে আসে গভীর শোক। অধ্যাপক এম এ মান্নানের মৃত্যুর পর অনেকেই অভিযোগ করেছেন, কারাগারে নির্যাতনের কারণে তার মৃত্যু হয়েছে। অধ্যাপক এম এ মান্নানের মৃত্যুর পর তার ছেলে এম মঞ্জুরুল করিম রনিকে গাজীপুর মগানগর বিএনপির দায়িত্ব দেয় বিএনপি। বর্তমানের তিনি গাজীপুর মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক। গতকাল ৩ নভেম্বর বিএনপি গাজীপুর-২ আসনে তাকে দলীয় মনোনয়ন দেয়। বিএনপি থেকে মনোনয়ন পাওয়ার পর আজ তার বাবার কবর জিয়ারতের মাধ্যমে শুরু হয় একজন জনপ্রতিনিধি প্রার্থী হিসেবে রনির পথচলা। তৃনমূল থেকে জাতীয় পর্যায়ে সম্মানজনক স্থানের অধিকারী বাবা অধ্যাপক এম এ মান্নানের পথেই শুরু হলো ছেলের যাত্রা। আজ আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের হাত ধরে চূড়ান্তভাবে রাজনীতির পথে উঠলেন রনি। বাবার দেখানো পথে তিনিও কাংখিত স্থান লাভ করতে পারবেন এমন আশাই মান্নান ভক্তসহ গাজীপুরবাসীর।
মরহুম অধ্যাপক এম এ মান্নানের বর্ণাঢ্য জীবন:
১৯৫০ সালে ৭ই এপ্রিল গাজীপুর জেলা সদরের দক্ষিণ সালনায় জন্মগ্রহণ করেন মোহাম্মদ আব্দুল মান্নান। তাঁর পিতার নাম কছিমউদ্দিন আকন্দ ও মায়ের নাম আতরজান বিবি। তিনি সালনা প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি, জয়দেবপুর রাণী বিলাসমনি সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি, ময়মনসিংহ মুসলিম হাই স্কুল থেকে সপ্তম ও অষ্টম শ্রেণি পাস করেন। পরে ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে এসএসসি পাস করেন। তিনি ময়মনসিংহ আনন্দমোহন কলেজ থেকে এইচএসসি ও স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। লেখাপড়ার খরচ মেটাতে কৃষক পিতার কাছ থেকে টাকা নিতেন, পাশাপাশি নিজেও ছাত্রাবস্থায় টিউশনি করেছেন। এভাবেই ময়মনসিংহের শিক্ষাজীবন শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফলিত রসায়নে এমএসসিতে ভর্তি হন। পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে লেখাপড়া শেষ করে টঙ্গী কলেজে শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। তখন থেকেই শিক্ষকতার পাশাপাশি রাজনৈতিক ও বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডে নিজেকে সক্রিয় রেখেছেন। টঙ্গী কলেজ ছেড়ে পরে তিনি গাজীপুর কাজী আজিম উদ্দিন কলেজে যোগদান করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র থাকাকালীন জিয়াউর রহমানের একটি বক্ততায় অনুপ্রাণিত হয়ে এম এ মান্নান রাজনৈতিক অঙ্গনে পদার্পণে আগ্রহ প্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিএনপি প্রতিষ্ঠা হলে টঙ্গী কলেজে শিক্ষকতার পাশাপাশি জিয়াউর রহমানের হাত ধরেই সূচনা হয় রাজনৈতিক যাত্রা। তিনি জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক দলে (জাগদল) যোগদান করেন, যা পরবর্তীতে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৮১ সালে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে মেজর জিয়ার মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের পর বাংলাদেশের মাটিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা শুরু হয়। এরশাদ জোর করে ক্ষমতা দখল করেন, জনগণের উপর চালায় নৃশংস সৈরাচারী শাসন। সে সময় এম এ মান্নান যুক্ত হয় সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণ আন্দোলনে। ১৯৯০ সালে স্বৈরাচার এরশাদ সরকার পতনের আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন সক্রিয় সংগঠক। তাঁর রাজনৈতিক জীবনের উত্থান শুরু হয় ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন থেকে। অবশ্য এর আগে শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের আমলে তিনি দলীয়ভাবে সালনা গ্রাম সরকার প্রধানের দায়িত্ব পান। পরে জাতীয় গ্রাম সরকারের কেন্দ্রীয় সদস্য সচিবেরও দায়িত্বে ছিলেন। অধ্যাপক এম এ মান্নান প্রথম ১৯৮৪ সালে অনুষ্ঠিত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে কাউলতিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। পরে তিনি আরও দুই মেয়াদে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান নির্বাচন করেও বিজয়ী হন। এই রাজনীতি বদলে দেয় তাঁর জীবনের গতিপথ, হয়ে উঠেন গাজীপুরের মাটি ও মানুষের প্রিয় নেতা, প্রাণের স্পন্দন, একজন নিবেদিত প্রাণ।
১৯৯১ সালে গাজীপুর-২ আসন থেকে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের পক্ষ থেকে প্রার্থী হিসেবে মনোনিত হন। সেই নির্বাচনে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। উল্লেখ্য, সারা দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হয়েছিলেন এম. এ মান্নান। গাজীপুরবাসীর প্রতি সম্মান দেখিয়ে দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়া তৎকালীন মন্ত্রীসভায় তাঁকে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব প্রদান করেন। পরবর্তীতে তিনি নবগঠিত বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় রাজনীতিতেও তাঁর প্রভাব ছিল শক্তিশালী। তিনি দলের যুগ্ম মহাসচিব, পরে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা এবং শেষপর্যন্ত দলের ভাইস চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্বে থাকাকালে গাজীপুর মহিলা কলেজ, কোনাবাড়ি ডিগ্রি কলেজ, পুবাইল আদর্শ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ প্রতিষ্ঠাসহ জেলার বিভিন্ন স্থানে স্কুল, কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দিরসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ ও গাজীপুরের উন্নয়ন অগ্রগতিতে অসামান্য অবদান রেখেছেন।
অধ্যাপক এম. এ. মান্নান যৌবন থেকে আমৃত্যু পর্যন্ত বিএনপি’র সাথে রাজনীতি করেছেন। দলীয় রাজনীতি করলেও তার উদার চিন্তা-চেতনা ও সংবেদনশীল মনোভাবের কারণে দলমত নির্বিশেষে সব মানুষের কাছে তার অসামান্য গ্রহণযোগ্যতা ছিল। তার জীবন ছিল কর্মময়, ধ্যান ধারণা ছিল অত্যন্ত সুন্দর, ব্যক্তিগত চরিত্র ছিল সচ্ছল ও সততা সৌরভে উজ্জ্বল। একজন জনপ্রিয় রাজনৈতিক নেতা ‘নগর পিতা’ খ্যাত যিনি গাজীপুরবাসীর প্রত্যক্ষ লক্ষাধিক ভোটে নির্বাচিত প্রথম মেয়র। নিজ বিশ্বাসে অটল থেকে তা অকপটে প্রকাশ করতে পারা একজন ব্যক্তিত্ব।
২০১৩ সালে নবগঠিত গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ১৮ দলীয় জোটের প্রার্থী হিসেবে গাজীপুরের এই প্রাণপুরুষ অধ্যাপক এম. এ. মান্নান টেলিভিশন প্রতীকে বিপুল ভোটে জয়লাভ করেন এবং মেয়র হিসেবে নির্বাচিত হন। নির্বাচনে তাঁর এই বিজয় ছিল গাজীপুরের অপামার জনসাধারনের ভালোবাসার পূর্ণপ্রতিফলন। কিন্তু তাঁর এই বিজয় সৈরাচার হাসিনা ও তার দোসররা মেনে নিতে পারেনি, তাঁর বিরুদ্ধে শুরু হয় রাজনৈতিক নিপীড়ন ও ষড়যন্ত্র। ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠির নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্মম নির্যাতনের প্রতীকে পরিণত হন তিনি।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র হিসেবে দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথম বছর নগর উন্নয়নের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মহাপরিকল্পনায় ঈর্ষান্বিত হয়ে কিছুদিন পরই ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর একটি মহল ব্যাপক ষড়যন্ত্র শুরু করে। এতে তার উন্নয়ন পরিকল্পনায় চরমভাবে বিঘ্ন ঘটে। মেয়র থাকাকালে ২০১৫ সালে বারিধারা ডিওএইচএস এর বাসা থেকে গ্রেফতার করা হয়। এরপর জামিনে মুক্তি পেলেও মিথ্যা মামলা সাজিয়ে পুনরায় গ্রেফতার করে। চলতে তাকে নির্মম ও পাশবিক নির্যাতন। তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করে ৩৪টি মিথ্যা ও সাজানো মামলা দিয়ে তাকে প্রায় তিন বছর কারাবাস ও জনবিচ্ছিন্ন করে রাখে। ৩৪টি মামলা করা হলেও সব মামলায় তিনি জামিন লাভ করেন।
গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রথম মেয়র থাকাকালীন তাঁকে তিন বার বরখাস্ত করা হয়। ২০১৫ সালের ১৯শে আগস্ট প্রথম দফায় বরখাস্ত করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। পরে ১৮ই এপ্রিল তাকে দ্বিতীয় দফায় সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশে ২৮ মাস পর মেয়রের দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র ১১ কার্য দিবসের মাথায় তৃতীয় দফায় আবারও বরখাস্ত করা হয়। তাঁর বিরুদ্ধে সকল মামলা মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এছাড়াও তাঁর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের ষড়যন্ত্র হয়। তারপরও তাকে দাবিয়ে রাখতে পারেনি। প্রতিপক্ষ যতই ষড়যন্ত্র করছিল গাজীপুর সিটি কর্রপোরেশনের জনগণের আস্থা ও ভালবাসা তাঁর প্রতি ততই বাড়ছিল। সকল নিপীড়নের মুখে শহিদ জিয়ার আদর্শের প্রশ্নে আমৃত্যু আপসহীন ভূমিকা পালন করে গেছেন।
ফ্যাসিবাদী শাসকগোষ্ঠীর দীর্ঘ জেল জুলুমের কারণে অনেকটাই অসুস্থ হয়ে গিয়েছিল এম. এ. মান্নান। তিনি কিডনি জটিলতাসহ নানা সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২২ সালের ২৮শে এপ্রিল বিকাল সাড়ে চারটায় রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে গাজীপুরের এই কৃতি সন্তান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। এই নেতার মৃত্যুতে বিএনপি’র জাতীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক মহলে নেমে আসে গভীর শোক।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপিতে গাজীপুরের ইতিহাসে এম. এ. মান্নান একটি উজ্জ্বল নাম। একজন কলেজ শিক্ষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে জাতীয় সংসদ সদস্য, মন্ত্রী, দলের নীতিনির্ধারক এবং শেষ পর্যন্ত একটি শহরের প্রথম নগরপিতা। তাঁর জীবন যেন এক অনন্য অনুপ্রেরণা। তিনি ছিলেন সাধারণের নেতা, সংগ্রামের প্রতীক। তাঁর অবদান আজও এই শহরের ইট-পাথরে গেঁথে আছে। তার মৃত্যুতে সৃষ্ট শূন্যতা কখনো পূরণ হওয়ার নয়। বিএনপি’র রাজনীতিতে গাজীপুরের মাটিতে তার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণীয়। একজন সফল রাজনৈতিক ও মানবিক গুণাবলী সম্পন্ন আলহাজ্ব অধ্যাপক এম. এ. মান্নান তার কর্মের মাধ্যমে আমাদের হৃদয়ে বেঁচে আছেন এবং বেঁচে থাকবেন আজীবন। আমরা তাঁর বিদেহী আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।
