ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র আগেই দেয়ার কথা বলে প্রতারণায় জড়িত থাকার দায়ে গ্রেফতার করা হয়েছে এদের। এদিকে গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পাওয়া গেছে প্রশ্ন ফাঁসের ভয়াবহ ও চাঞ্চল্যকর তথ্য। গ্রেফতার হওয়া অপরাধীরাই বলছেন, প্রশ্নের বিনিময়ে তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। শিক্ষার্থীদের মূল সনদ নিজেদের জিম্মায় রাখতেন। টাকা পাওয়ার পর সনদ ফিরিয়ে দেয়া হতো। হোয়াটস অ্যাপে পাঠিয়ে দেয়া হতো প্রশ্নপত্রের লিঙ্ক। ‘এমএলএম পদ্ধতি’তে চালানো হয়েছে প্রতারণা। এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডকে বানানো হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের অস্ত্র!
এদিকে পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস যেন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস না হলেও ভুয়া প্রশ্নের বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে, সকল নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা কোনটিই এখন সঙ্কটমুক্ত নয়। পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস, না হয় প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে প্রতারণা। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতাও। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, কয়েক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এখন এই আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াতে প্রশ্ন ফাঁস ও প্রতারণার অন্যতম কারণ অভিহিত করে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার অব্যাহত ঘটনা জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেবে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে? এখন প্রশ্ন ফাঁস না হলেও পরীক্ষায় মানুষের আস্থা নেই। তাই পরীক্ষার বিষয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার পর থেকেই কিছু শিক্ষার্থী প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তুলে আন্দোলন করে আসছে। তাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও। যদিও প্রশ্ন ফাঁসের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই। তবু চলছে আন্দোলন। এরই মধ্যে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমে পড়ে প্রতারক চক্র। শুক্রবার ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি করার অভিযোগে এক ভর্তিচ্ছুকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর শুক্রবার ভোর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। এ সময় প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছে, প্রশ্নপত্রের বিনিময়ে তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। শিক্ষার্থীদের মূল সনদ নিজেদের জিম্মায় রাখতেন। শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম এসব কথা বলেন।
পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দেয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ২২ জনকে আটক করা হয় তাদের মধ্য থেকে ১৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয় বলে জানা গেছে।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলো জোবায়ের হোসেন, মোঃ আকিব বিন বারী, নাহিদুল হক, সাজু আহমেদ, মাহমুদুল হাসান, সামিউল ইসলাম, সাব্বির হোসেন, হাসানুর রশিদ, মোঃ মেহেদী হাসান, হৃদয় ইসলাম, রায়হান রাব্বী, আকাশ আহমেদ, মোঃ তানভীর, সবুজ খান, মোঃ সোহাগ, মেহেদী হাসান ও মানিক মিয়া।
ডিবি বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সামনে থেকে জোবায়ের হোসেনকে আটক করেন। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী অন্যদের আটক করা হয়। এ ঘটনার হোতা জোবায়ের, আকিব ও নাহিদুল। আকিব ও নাহিদুলের কাছ থেকে ১০টি সনদপত্র পাওয়া গেছে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট, মোবাইল ফোন, হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও ফেসবুকে যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।
উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তারা তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তিতে প্রশ্ন বিক্রির কাজ করে আসছিল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মূল সনদপত্র নিজেদের জিম্মায় রাখেন। টাকা নেয়ার পর সনদপত্র ফিরিয়ে দেন। হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্নপত্রের লিঙ্ক দিয়ে দেয়া হয়। তবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গতকালের ‘ক’ ইউনিট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্রের মিল পাওয়া যায়নি। ডিবির একটি সূত্র বলছে, ডিবির অভিযানের কারণে তাদের মূল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাদের কাছে যে প্রশ্নপত্র ছিল, তা তারা দিতে পারেনি। এ ঘটনায় তেজগাঁও মডেল থানায় মামলা হয়েছে বলে ডিবি জানিয়েছে।
এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণা! ॥ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রতারকরা শর্ত দিয়েছিল, কেউ যদি প্রশ্ন কেনার জন্য আরও পাঁচ জনকে এনে দিতে পারে তাহলে তাকে টাকা ছাড়াই প্রশ্ন দেয়া হবে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোঃ শাহজাহান জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নাহিদুল ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের, আকিব বিন বারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আকাশ আহম্মেদ পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। এই তিনজন প্রতারণা চক্রের হোতা দাবি করে তিনি বলেন, তাদের মোবাইল ফোন থেকে যেসব প্রশ্ন পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মিল নেই। এই চক্রে জড়িত অন্যদের বিষয়ে জানতে তাদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে বলেও জানান অতিরিক্ত উপকমিশনার।
এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডও প্রশ্ন ফাঁসের অস্ত্র! ॥ কেবল এমএলএম পদ্ধতিতেই জালিয়াতি নয়। এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডকেও বানানো হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের অস্ত্র! দেখে মনে হবে ক্রেডিট কার্ড। মানিব্যাগে ভরে পরীক্ষার হলে ঢুকে পড়লে হয়ত সন্দেহই করবে না কেউ। কিন্তু এর সঙ্গে যখন যুক্ত হবে এয়ারপিস, ওই কার্ডই তখন কানে কানে বলে দেবে প্রশ্নের উত্তর। এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ইদানীং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসছে প্রতারক শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ওই যন্ত্রসহ আটকের পর এক পরীক্ষার্থীকে দুই বছরের কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। দ-প্রাপ্ত হাসিবুল হাসান শামু এবার নীলফামারী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে বসে প্রথম এক ঘণ্টা পরীক্ষকদের ফাঁকিও দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা পড়তে হয় ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে। অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা। এক ঘণ্টার মাথায় সন্দেহ হয়। হাসিবুলকে তল্লাশি করে পাওয়া যায় ওই ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। ওই যন্ত্রের সাহায্যে উত্তর জেনে নিয়ে সে পরীক্ষার হলে উত্তরপত্রে বৃত্ত ভরাটের চেষ্টা করছিল। ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো দেখতে ওই যন্ত্রের সঙ্গে এই জালিয়াতিতে ব্যবহার করা হয় তারবিহীন ‘ব্লু টুথ’ এয়ারপিস। আকারে ছোট হওয়ায় পরীক্ষার্থী অন্য কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সহজেই তা কানের সঙ্গে আটকে রাখতে পারে।
ওই যন্ত্রসহ আটকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় হাসিবুলকে। সে জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফর্মেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ফরহাদ মাহমুদ ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শুভ নামের দুই ছাত্রের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় ওই যন্ত্র পেয়েছে সে। হাসিবুলের দাবি, ফরহাদের কাছে সে প্রাইভেট পড়ত। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহের জন্য তাদের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষা চলাকালে প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যদের সহায়তা নেয়ার অপরাধে পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইনের ১৯৮০-এর ৯ (খ) ধারা অনুযায়ী হাসিবুলকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দেয়া হয়।
প্রশ্ন ফাঁসে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কিছুটা কমতে শুরু করলেও এ সঙ্কট এবার নতুন মোড় নিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসে গত এক বছরে দেখা গেছে, অপকর্মে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন খোদ অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকও। পরীক্ষার শুরুর দুই-তিন ঘণ্টা আগেই বান্ডিল খুলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে শিক্ষকরাই পৌঁছে দিচ্ছেন পরীক্ষার্থীদের কাছে! এক বছরে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় রাজধানীতে এমন ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কেলেঙ্কারিতে সম্প্রতি ফেঁসে গেছে রাজধানীর ডেমরার গোলাম মোস্তফা মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। টানা তিন বছর পাবলিক পরীক্ষায় একই অপকর্ম করে প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি প্রায় শতভাগ নিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত প্রমাণসহ ধরা খেল গবর্র্নিং বডির সভাপতি, সদস্য, অধ্যক্ষসহ পুরো চক্র। এইচএসসিতেও নির্দিষ্ট সময়ের তিন ঘণ্টা আগেই এখানে পরীক্ষা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পরীক্ষার দিন ভল্ট থেকে প্রশ্ন বের করে সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের হলরুমে একত্র করে প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। প্রমাণ মিলেছে গত বছরও নির্ধারিত সময়ের আগে পরীক্ষা নিয়ে ৬০ জনের মধ্যে ৫৯ জন, অর্থাৎ ৯৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
শাস্তিহীনতাই প্রশ্ন ফাঁসের বড় কারণ ॥ ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি ন্যূনতম তিন থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-।’ পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে এই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইন প্রণয়নের পর পাবলিক, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শতাধিক বার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও এক মাস শাস্তিরও নজির নেই কোন অপরাধীর। কেলেঙ্কারির পর পরীক্ষা স্থগিত করে অন্তত ৩৪ বার তদন্ত কমিটি গঠন করে সঙ্কট সমাধানের সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি একটি সুপারিশও। ফলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থীর জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ম্লান হতে বসেছে সরকারের অনেক অর্জন।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ॥ সরকারের সাফল্যকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত অন্ধকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, যে কোন পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আজ যেসব শিক্ষার্থী ভাল রেজাল্ট করল তাদেরও মন ভার কেন? কারণ অনেকেই তাদের টিপ্পনী কেটে বলবে, তোমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফল করেছ! কিন্তু আসলে সব শিক্ষার্থী তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়নি। তাহলে তাদের কেন এমন কথা শুনতে হবে? তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, যা একটা জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেবে।
দেখা যাচ্ছে এখন পরীক্ষা হলেই চলে একই কর্মকা-। অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ভবিষ্যতে মনে হয় পরীক্ষাই নেয়া যাবে না। কিন্তু এই অবস্থার সমাধানের পথ কী? জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ একরামূল কবীর বলছিলেন, আসলে শিশুদের পরীক্ষা নিয়েও এখন একটি মহল ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্য করে। তারপরও বিভিন্ন সময় কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে আস্থা হারিয়েছে বলে সকল পরীক্ষা নিয়েই গুজবে কান দেয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো প্রক্রিয়াকে মানুষের কাছে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। একটি জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে। যে কমিটি করলে মানুষ আরও আস্থা রাখতে পারবে। তবে এই কমিটি কোন প্রশ্ন দেখতে পারবে না। তারা পরীক্ষা মনিটরিং করবে। –
এদিকে পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস যেন একটি নিয়মে পরিণত হয়েছে। অনেকক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস না হলেও ভুয়া প্রশ্নের বিনিময়ে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে প্রতারকরা। পঞ্চম শ্রেণীর সমাপনী পরীক্ষা থেকে শুরু করে, সকল নিয়োগ পরীক্ষা, বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিক্যাল ভর্তি পরীক্ষা কোনটিই এখন সঙ্কটমুক্ত নয়। পরীক্ষা হলেই প্রশ্ন ফাঁস, না হয় প্রশ্ন ফাঁসের গুজব ছড়িয়ে দেশজুড়ে প্রতারণা। যার ফলে সৃষ্টি হচ্ছে অস্থিরতাও। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা সার্বিক পরিস্থিতিতে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলছেন, কয়েক ক্ষেত্রে প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এখন এই আস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করতে হবে। আইনের যথাযথ প্রয়োগ না হওয়াতে প্রশ্ন ফাঁস ও প্রতারণার অন্যতম কারণ অভিহিত করে শিক্ষাবিদরা বলছেন, প্রশ্ন ফাঁস ও পরীক্ষা নিয়ে প্রতারণার অব্যাহত ঘটনা জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেবে। এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ব্যবস্থাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে যাবে? এখন প্রশ্ন ফাঁস না হলেও পরীক্ষায় মানুষের আস্থা নেই। তাই পরীক্ষার বিষয়ে মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদরা। এবার মেডিক্যাল কলেজে ভর্তি পরীক্ষার পর থেকেই কিছু শিক্ষার্থী প্রশ্ন ফাঁসের অভিযোগ তুলে আন্দোলন করে আসছে। তাদের আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিও। যদিও প্রশ্ন ফাঁসের সুনির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ নেই। তবু চলছে আন্দোলন। এরই মধ্যে ঢাকা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাকে কেন্দ্র করে মাঠে নেমে পড়ে প্রতারক চক্র। শুক্রবার ভর্তি পরীক্ষা চলাকালে ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জালিয়াতি করার অভিযোগে এক ভর্তিচ্ছুকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। এরপর শুক্রবার ভোর থেকে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালায় ঢাকা মহানগর পুলিশের গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) সদস্যরা। এ সময় প্রশ্ন ফাঁসে জড়িত সন্দেহে ১৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা জানিয়েছে, প্রশ্নপত্রের বিনিময়ে তারা প্রত্যেক শিক্ষার্থীর কাছে তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকা নিতেন। শিক্ষার্থীদের মূল সনদ নিজেদের জিম্মায় রাখতেন। শনিবার দুপুরে রাজধানীর মিন্টো রোডে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া সেন্টারে অনুষ্ঠিত সংবাদ ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) শেখ নাজমুল আলম এসব কথা বলেন।
পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন দেয়ার কথা বলে প্রতারণার অভিযোগে বৃহস্পতিবার রাত থেকে শুক্রবার পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন জায়গা থেকে যে ২২ জনকে আটক করা হয় তাদের মধ্য থেকে ১৭ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয় বলে জানা গেছে।
গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিরা হলো জোবায়ের হোসেন, মোঃ আকিব বিন বারী, নাহিদুল হক, সাজু আহমেদ, মাহমুদুল হাসান, সামিউল ইসলাম, সাব্বির হোসেন, হাসানুর রশিদ, মোঃ মেহেদী হাসান, হৃদয় ইসলাম, রায়হান রাব্বী, আকাশ আহমেদ, মোঃ তানভীর, সবুজ খান, মোঃ সোহাগ, মেহেদী হাসান ও মানিক মিয়া।
ডিবি বলছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়ে তারা প্রথমে মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান হলের সামনে থেকে জোবায়ের হোসেনকে আটক করেন। পরে তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী অন্যদের আটক করা হয়। এ ঘটনার হোতা জোবায়ের, আকিব ও নাহিদুল। আকিব ও নাহিদুলের কাছ থেকে ১০টি সনদপত্র পাওয়া গেছে। গ্রেফতার হওয়া ব্যক্তিদের কাছ থেকে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষার সনদপত্র, ট্রান্সক্রিপ্ট, মোবাইল ফোন, হোয়াটস অ্যাপে পাঠানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ও ফেসবুকে যোগাযোগের তথ্য পাওয়া গেছে।
উপকমিশনার শেখ নাজমুল আলম বলেন, জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানিয়েছে, তারা তিন থেকে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তিতে প্রশ্ন বিক্রির কাজ করে আসছিল। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে মূল সনদপত্র নিজেদের জিম্মায় রাখেন। টাকা নেয়ার পর সনদপত্র ফিরিয়ে দেন। হোয়াটস অ্যাপে প্রশ্নপত্রের লিঙ্ক দিয়ে দেয়া হয়। তবে ফাঁস হওয়া প্রশ্নের সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গতকালের ‘ক’ ইউনিট ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘এ’ ইউনিটের প্রশ্নপত্রের মিল পাওয়া যায়নি। ডিবির একটি সূত্র বলছে, ডিবির অভিযানের কারণে তাদের মূল পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। তাদের কাছে যে প্রশ্নপত্র ছিল, তা তারা দিতে পারেনি। এ ঘটনায় তেজগাঁও মডেল থানায় মামলা হয়েছে বলে ডিবি জানিয়েছে।
এমএলএম পদ্ধতিতে প্রতারণা! ॥ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশ জানতে পেরেছে, ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের প্রতারকরা শর্ত দিয়েছিল, কেউ যদি প্রশ্ন কেনার জন্য আরও পাঁচ জনকে এনে দিতে পারে তাহলে তাকে টাকা ছাড়াই প্রশ্ন দেয়া হবে। গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার মোঃ শাহজাহান জানান, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে নাহিদুল ফরিদপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের, আকিব বিন বারি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং আকাশ আহম্মেদ পাবনা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী। এই তিনজন প্রতারণা চক্রের হোতা দাবি করে তিনি বলেন, তাদের মোবাইল ফোন থেকে যেসব প্রশ্ন পাওয়া গেছে তার সঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নের মিল নেই। এই চক্রে জড়িত অন্যদের বিষয়ে জানতে তাদের রিমান্ডে নেয়ার আবেদন করা হবে বলেও জানান অতিরিক্ত উপকমিশনার।
এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডও প্রশ্ন ফাঁসের অস্ত্র! ॥ কেবল এমএলএম পদ্ধতিতেই জালিয়াতি নয়। এটিএম কার্ড ও ক্রেডিট কার্ডকেও বানানো হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসের অস্ত্র! দেখে মনে হবে ক্রেডিট কার্ড। মানিব্যাগে ভরে পরীক্ষার হলে ঢুকে পড়লে হয়ত সন্দেহই করবে না কেউ। কিন্তু এর সঙ্গে যখন যুক্ত হবে এয়ারপিস, ওই কার্ডই তখন কানে কানে বলে দেবে প্রশ্নের উত্তর। এমন অত্যাধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে ইদানীং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় বসছে প্রতারক শিক্ষার্থীরা। শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের ভর্তি পরীক্ষায় ওই যন্ত্রসহ আটকের পর এক পরীক্ষার্থীকে দুই বছরের কারাদ- দিয়েছে ভ্রাম্যমাণ আদালত। দ-প্রাপ্ত হাসিবুল হাসান শামু এবার নীলফামারী সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর মডেল স্কুল এ্যান্ড কলেজ কেন্দ্রে পরীক্ষা দিতে বসে প্রথম এক ঘণ্টা পরীক্ষকদের ফাঁকিও দিয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তাকে ধরা পড়তে হয় ওই কেন্দ্রে দায়িত্বরত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিসাববিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মিজানুর রহমানের কাছে। অধ্যাপক মিজানুর রহমান বলেন, দেড় ঘণ্টার পরীক্ষা। এক ঘণ্টার মাথায় সন্দেহ হয়। হাসিবুলকে তল্লাশি করে পাওয়া যায় ওই ইলেক্ট্রনিক ডিভাইস। ওই যন্ত্রের সাহায্যে উত্তর জেনে নিয়ে সে পরীক্ষার হলে উত্তরপত্রে বৃত্ত ভরাটের চেষ্টা করছিল। ব্যাংকের এটিএম কার্ডের মতো দেখতে ওই যন্ত্রের সঙ্গে এই জালিয়াতিতে ব্যবহার করা হয় তারবিহীন ‘ব্লু টুথ’ এয়ারপিস। আকারে ছোট হওয়ায় পরীক্ষার্থী অন্য কারও দৃষ্টি আকর্ষণ না করে সহজেই তা কানের সঙ্গে আটকে রাখতে পারে।
ওই যন্ত্রসহ আটকের পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর কার্যালয়ে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয় হাসিবুলকে। সে জানায়, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ইনফর্মেশন টেকনোলজির (আইআইটি) ফরহাদ মাহমুদ ও পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের শুভ নামের দুই ছাত্রের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকায় ওই যন্ত্র পেয়েছে সে। হাসিবুলের দাবি, ফরহাদের কাছে সে প্রাইভেট পড়ত। পরীক্ষার হলে প্রশ্নের উত্তর সরবরাহের জন্য তাদের মধ্যে পাঁচ লাখ টাকার চুক্তি হয়েছিল।
ম্যাজিস্ট্রেট মৌসুমী মাহবুব সাংবাদিকদের বলেন, পরীক্ষা চলাকালে প্রযুক্তির মাধ্যমে অন্যদের সহায়তা নেয়ার অপরাধে পাবলিক পরীক্ষা অপরাধ আইনের ১৯৮০-এর ৯ (খ) ধারা অনুযায়ী হাসিবুলকে দুই বছরের বিনাশ্রম কারাদ- দেয়া হয়।
প্রশ্ন ফাঁসে শিক্ষকরাও জড়িয়ে পড়ছেন ॥ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরদারির কারণে ফেসবুকসহ অন্যান্য মাধ্যমে প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা কিছুটা কমতে শুরু করলেও এ সঙ্কট এবার নতুন মোড় নিয়েছে। প্রশ্ন ফাঁসে গত এক বছরে দেখা গেছে, অপকর্মে সরাসরি জড়িয়ে পড়েছেন খোদ অধ্যক্ষ, প্রধান শিক্ষকসহ অন্যান্য শিক্ষকও। পরীক্ষার শুরুর দুই-তিন ঘণ্টা আগেই বান্ডিল খুলে প্রশ্নের উত্তর ঠিক করে শিক্ষকরাই পৌঁছে দিচ্ছেন পরীক্ষার্থীদের কাছে! এক বছরে এসএসসি, এইচএসসি পরীক্ষায় রাজধানীতে এমন ঘটনায় হাতেনাতে ধরা পড়েছেন নামী-দামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা। পরীক্ষার আগেই প্রশ্ন ফাঁস করে শিক্ষার্থীদের হাতে পৌঁছে দেয়ার কেলেঙ্কারিতে সম্প্রতি ফেঁসে গেছে রাজধানীর ডেমরার গোলাম মোস্তফা মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ। টানা তিন বছর পাবলিক পরীক্ষায় একই অপকর্ম করে প্রতিষ্ঠানের পাসের হার ও জিপিএ ৫ প্রাপ্তি প্রায় শতভাগ নিয়ে এলেও শেষ পর্যন্ত প্রমাণসহ ধরা খেল গবর্র্নিং বডির সভাপতি, সদস্য, অধ্যক্ষসহ পুরো চক্র। এইচএসসিতেও নির্দিষ্ট সময়ের তিন ঘণ্টা আগেই এখানে পরীক্ষা নেয়ার প্রমাণ পেয়েছে গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। পরীক্ষার দিন ভল্ট থেকে প্রশ্ন বের করে সকাল সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত পরীক্ষার্থীদের হলরুমে একত্র করে প্রশ্নের সমাধান করা হয়েছে। প্রমাণ মিলেছে গত বছরও নির্ধারিত সময়ের আগে পরীক্ষা নিয়ে ৬০ জনের মধ্যে ৫৯ জন, অর্থাৎ ৯৮ দশমিক ৩৩ শতাংশ শিক্ষার্থীই জিপিএ-৫ পেয়েছিল।
শাস্তিহীনতাই প্রশ্ন ফাঁসের বড় কারণ ॥ ‘প্রশ্নপত্র ফাঁস, প্রকাশ বা বিতরণের সঙ্গে জড়িত থাকলে শাস্তি ন্যূনতম তিন থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের কারাদ-সহ অর্থদ-।’ পাবলিক পরীক্ষাসমূহ (অপরাধ) আইন ১৯৮০ এবং সংশোধনী ১৯৯২-এর চার নম্বর ধারায় স্পষ্ট করে এই শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো আইন প্রণয়নের পর পাবলিক, বিসিএসসহ বিভিন্ন পরীক্ষায় শতাধিক বার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনা ঘটলেও এক মাস শাস্তিরও নজির নেই কোন অপরাধীর। কেলেঙ্কারির পর পরীক্ষা স্থগিত করে অন্তত ৩৪ বার তদন্ত কমিটি গঠন করে সঙ্কট সমাধানের সুপারিশ করা হলেও আজ পর্যন্ত কার্যকর হয়নি একটি সুপারিশও। ফলে একের পর এক প্রশ্নপত্র ফাঁস শিক্ষার্থী, চাকরিপ্রার্থীর জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। লাগাতার প্রশ্ন ফাঁসের ঘটনায় ম্লান হতে বসেছে সরকারের অনেক অর্জন।
শিক্ষাবিদদের পরামর্শ ॥ সরকারের সাফল্যকে অনেকটাই প্রশ্নবিদ্ধ করেছে ‘প্রশ্ন ফাঁস’। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এই অবস্থা অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যত অন্ধকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, যে কোন পরীক্ষাতেই প্রশ্ন ফাঁস কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না। আজ যেসব শিক্ষার্থী ভাল রেজাল্ট করল তাদেরও মন ভার কেন? কারণ অনেকেই তাদের টিপ্পনী কেটে বলবে, তোমরা ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দিয়ে ভাল ফল করেছ! কিন্তু আসলে সব শিক্ষার্থী তো ফাঁস হওয়া প্রশ্নে পরীক্ষা দেয়নি। তাহলে তাদের কেন এমন কথা শুনতে হবে? তিনি বলেন, প্রশ্ন ফাঁসের ফলে শিক্ষার্থীরা লেখাপড়ার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে, যা একটা জাতিকে মেরুদ-হীন করে দেবে।
দেখা যাচ্ছে এখন পরীক্ষা হলেই চলে একই কর্মকা-। অনেকে হতাশা প্রকাশ করে বলছেন, ভবিষ্যতে মনে হয় পরীক্ষাই নেয়া যাবে না। কিন্তু এই অবস্থার সমাধানের পথ কী? জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব শিক্ষাবিদ অধ্যাপক শেখ একরামূল কবীর বলছিলেন, আসলে শিশুদের পরীক্ষা নিয়েও এখন একটি মহল ভুয়া প্রশ্ন ছেড়ে দিয়ে বাণিজ্য করে। তারপরও বিভিন্ন সময় কিছু পরীক্ষায় প্রশ্ন ফাঁস হওয়ায় মানুষ আস্থা হারিয়েছে। এই আস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তবে আস্থা হারিয়েছে বলে সকল পরীক্ষা নিয়েই গুজবে কান দেয়া ঠিক নয়। তিনি বলেন, আস্থা ফিরিয়ে আনতে পুরো প্রক্রিয়াকে মানুষের কাছে আরও স্বচ্ছ করতে হবে। একটি জাতীয় কমিটি করা যেতে পারে। যে কমিটি করলে মানুষ আরও আস্থা রাখতে পারবে। তবে এই কমিটি কোন প্রশ্ন দেখতে পারবে না। তারা পরীক্ষা মনিটরিং করবে। –