
ফাহিমা নুর, টঙ্গী থেকে ফিরে: শিল্পশহর টঙ্গীতে আবাসিক এলাকা, বাসা বাড়ি, অলিগলি,বিপনীবিতান এমনকি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেও রাসায়নিক গুদাম করে বিপদজনক ব্যবসা চলছে। অথচ সরকারীভাবে প্রায় একশ কোটি টাকা ব্যায়ে নির্মিত ৫৩টি রাসায়কি গুদাম পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও কেমিক্যাল মালিকদের চিঠি দিয়েও ভাড়ার দিতে পারছে না। ফলে আবাসিক ও জনবহুল এলাকায় বিপদজনক রাসায়কি দাহ্য পদার্থ সহজেই পাওয়া যাওয়ায় আতঙ্গে পরেছে টঙ্গীর লাখ লাখ মানুষ। এক অজানা আতঙ্গে ভুগছেন সাধারণ মানুষ।
সরেজমিন অনুসন্ধান করে টঙ্গীর কাাঁঠালদিয়া এলাকায় এই সরকারী প্রকল্পের সন্ধান পাওয়া গেছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, ২০১৯ সালে ঢাকার চুরিহাট্রা অগ্নিকান্ডের পর সরকার শিল্পমন্ত্রালয়ের অধীন বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের(বিএসইসি) নিয়ন্ত্রনাধীন দুটি কেমিক্যাল ওয়্যারহাউজ নির্মমানের উদ্যোগ নেয়। এর একটি ঢাকার শ্যামপুরে ও আরেকটি গাজীপুরের টঙ্গীতে। টঙ্গীর কাঁঠালদিয়া এলাকায় ৬ একর জায়গার উপর ইতোমধ্যে একশ কোটি ৬৮ লাখ টাকার মধ্যে ৯৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা ব্যায়ে ৫৩টি ওয়্যারহাউজ নির্মান সম্পন্ন হয়। ২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর এই প্রকল্পের কাজ পুরোপুরি শেষ হয়। চলতি ২০২৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এই সকল ওয়্যারহাউজ ভাড়া দেয়ার জন্য পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেয়ার পাশাপাশি কেমিক্যাল কোম্পানীর মালিকদেরকে গুদাম ভাড়া নেয়ার জন্য চিঠিও দেয় সরকার। বিজ্ঞপিতে আকর্ষণীয় জায়গায় পরিচ্ছন্ন পরিবেশে কেমিক্যাল ব্যবসা ও সংরক্ষণের সকল সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত নব-নির্মিত রাসায়নিক গুদাম ও সংশ্লিষ্ট অফিস কক্ষসমূহ ভাড়া প্রদানের নিমিত্ত আগ্রহী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নিকট থেকে নির্ধারিত ফর্মে আবেদনপত্র আহবান করা হয়। গুদামের প্রতিটি প্যাকেজ (গুদাম ও অফিস) ২০৭২ হতে ৩৪১০ বর্গফুট জায়গা (ভ্যাট ব্যতীত) প্রতি বর্গফুট ২৬ টাকা হারে ভাড়া প্রদান করার কথা বলা হয়েছে। এই সব সুযোগ সুবিধা দেয়ার পরও বিজ্ঞপ্তি ও কেমিক্যাল গুদামের মালিকদের চিঠি দেয়ার পরও এখনো কেউ রাসায়নিক গুদামের জন্য আবেদন করেনি।
এ বিষয়ে প্রকল্পের উপ-পরিচালক মো: সালমান মাহমুদ খান বলেন, প্রকল্পের কাজ ৭ কোটি টাকা সাশ্রয়ে শেষ হয়েছে। আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দিয়ে ও রাসায়নিক ব্যবসার মালিকদের চিঠি দিয়েছি। এখনো কেউ আবেদন করেনি। বিচ্ছিন্নভাবে রাসায়নিক গুদাম মারাত্বক ঝুঁকিপূর্ণ। তাই সকল রসায়নিক গুদাম এখানে চলে আসলে বড় ধরণের দূর্ঘটনার আশংকা থাকবে না।
এদিকে টঙ্গীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় অবৈধভাবে কেমিক্যালের ব্যবসা করে আসছে এক শ্রেণীর ব্যবসায়ীরা। এসব ব্যবসায়ীদের নেই সরকারী অনুমোদন। কেমিক্যাল বিস্ফোরনে ইতি পূর্বে দূর্ঘটনা ও প্রাণহানী ঘটলেও টনক নড়ছেনা অবৈধ কেমিক্যাল ব্যবসায়ীদের। স্থানীয় ভাবে ম্যানেজ করে তারা চালাচ্ছে এ অবৈধ ব্যবসা। আবাসিক এলাকায় গড়ে উঠা কেমিক্যাল ব্যবসার কারণে যেকোন মুহুর্তে ঘটে যেতে পারে ভয়াবহ দুর্ঘটনা। কেমিক্যাল ব্যবসায়ীরা যে যার মত যত পারছে দেদারসে কেমিক্যাল দিয়ে সয়লাব করে রেখেছে। কেউ কেউ প্রশাসনকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে ক্ষমতার জোর দেখাচ্ছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, টঙ্গীর বিভিন্ন বাসাবাড়ি, কিন্ডার গার্ডেন, মাকের্ট ও জনবহুল আবাসিক এলাকাসহ আনাচে-কানাচে শতাধিক ব্যাবসায়ী কেমিক্যালের ব্যবসায় করে আসছেন। এলাকার গাজীবাড়ি, চম্পকালি সিনেমা হল রোড, ক্যাপরি সিনেমা হল, তিতাস গ্যাস রোড, মাত্তাব্বর বাড়ি রোড, সমবায় কমপ্লেক্স মার্কেট, আমতলী, মরকুন টেকপাড়া এলাকায় কেমিক্যালের ব্যবসা করে এলাকাবাসিকে ঝুকির মুখে ফেলে রেখেছে ওই ব্যবসায়ীরা। এসব কেমিক্যাল ব্যবসায়ী মধ্যে রয়েছে সমবায় কমপ্লেক্সে এমএস কর্পোরেশন, যমুনা কেমিক্যাল, নিউ পদ্মা কেমিক্যাল, মিতালী কেমিক্যাল আল-মদিনা কেমিক্যাল, শাহ্ আলী কেমিক্যাল, ফারিয়া ট্রেডার্স, উর্মি ট্রেডার্স, জেটেক্স কর্পোরেশন, ইঞ্জিঃ জিদ বাবু,নিশি এন্টারপ্রাইজ, পূবালী কেমিকেল, খাঁন এন্টারপ্রইজ, ডি/এ কর্পোরেশন, জিহাদ কালার, আমানত ট্রেডার্স,নজরুল এন্ড ব্রাদার্স, সেভেনস স্টার কর্পোরেশন, সাদ ট্রেডিং, ফারিয়া এন্টারপ্রাইজ, সাহারা মার্কেট ফেমাস ক্যামিকেল, ব্যাংকের মাঠ বস্তিতে ক্যাপরি সিনেমা হলের ভিতরে বাসু এন্টারপ্রাইজসহ বিভিন্নগুদামে রাসায়নিক ও অনুমোদনহীন রাসায়নিক যেমন পটাশিয়াম, সালফিউরিক ক্যামিকেল বাজারজাত করছে। টঙ্গী-ঘোড়াাশাল সড়কের ফুটপাত দখল করে ড্রামভর্তি কেমিক্যাল জনসাধারণের চলাচলের জায়গায় রেখে দিয়েছে। আবার অনেক গুদামে কোন সাইনবোর্ড নেই। এতে করে সড়কে চলাচলরত পথচারীর সিগারেটের আগুনেও বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে। ফলে পুরো এলাকায় কেমিক্যালের উৎকটগন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এতে করে শিশু থেকে নানা বয়সের মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।
এ বিষয়ে গাজীপুর সদর উপজেলা সমবায় কর্মকর্তা সৈয়দ মেহেদী মাসুদ কালের কন্ঠ কে বলেন, একটি সমিতি দ্বারা টঙ্গীর সমবায় কমপ্লেক্স পরিচালিত হয়। প্রতি তিন বছর পর পর সমিতির নির্বাচন করার কথা থাকলেও রাজনৈতিক কারণে কোন নির্বাচন হয় না। যখন যারা ক্ষমতায় থাকে, তারাই কমিটি করে চালায়। তাই দোকান মনিটরিং করা হয় না।
এ বিষয়ে সমবায় কমপ্লেক্স মার্কেটের ব্যাবস্থা কমিটির চেয়ারম্যান ও টঙ্গী পূর্ব থানা যুবদলের আহবায়ক আকবর হোসেন ফারুক বলেন, আওয়ামীলীগ সব শেষ করে গেছে। আমি ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের দায়িত্ব নিয়েছি। এখন খোঁজ নিয়ে দেখব।
গাজীপুর সিটিকরপোরেশন টঙ্গী অঞ্চলের নির্বাহী কর্মকর্তা জহিরুল ইসলাম বলেন, আমরা কেমিক্যালের লাইসেন্স দেই না। ট্রেড লাইসেন্স দেয়া হয়েছে কি না খোঁজ নিতে হবে।
গাজীপুর পরিবেশ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আরেফিন বাদল বলেন, আমরা কেমিক্যালের কোন লাইসেন্স দেই না।
এ ব্যাপারে বিস্ফোরক অধিদপ্তরের বিস্ফোরক পরিদর্শক ড. মো: আসাদুল ইসলাম কালের কন্ঠ কে বলেন, আজ শনিবার বন্ধের দিন কোন বক্তব্য দিব না।
টঙ্গী পূর্ব থানার অফিসার ইনচাজর্ (ওসি) মো. ওয়াহিদুজ্জামান কালের কন্ঠ কে বলেন, অভিযোগ পেলে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।
২২ সেপ্টেম্বর টঙ্গীর সাহারা মার্কেটে ফেমাস কেমিক্যাল লিমিটেডের গুদামে অগ্নিকান্ডের ঘটনায় টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ৪ জন সহ ৫ জন অগ্নিদ্বগ্ধ হয়ে ৮ জন আহত হয়। গতকাল বেলা ১২ টা পর্যন্ত টঙ্গী ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যারহাউজ পরিদর্শক খন্দকার জান্নাতুল নাঈম, ফায়ার ফাইটার শামীম আহমেদ ও ফায়ার ফাইটার নুরুল হুদা এবং দোকান কর্মচারী আল আমিন উরফে বাবু হাওলাদার চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায়। বর্তমানে ফায়ার সার্ভিসের অগ্নিদ্বগ্ধ ফায়ার ফাইটার জয় হাসান চিকিৎসাধীন। বাকী ৩ জন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। এই ঘটনায় এখনো কোন মামলা বা কেউ আটক হয়নি।
