সাইবার নিরাপত্তার বড় ঝুঁকির মুখে রয়েছে বাংলাদেশ। সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে আন্তর্জাতিক গবেষণা রিপোর্টে বাংলাদেশকে অত্যধিক ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রাখা হয়েছে। মস্কোভিত্তিক অ্যান্টি ভাইরাস গ্রুপ ক্যাসপার্স্কি ল্যাবের চলতি বছরের দ্বিতীয় প্রান্তিকের রিপোর্টে বিভিন্ন ভাইরাসে কম্পিউটার আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশ রয়েছে ১ নম্বরে। আর স্মার্টফোনে ম্যালওয়্যার আক্রান্ত হওয়ার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান চতুর্থ।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, পাইরেটেড বা অননুমোদিত সফটওয়্যারের বিপুল ব্যবহার এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে অসচেতনতার কারণে বাংলাদেশ এই মুহূর্তে বড় ঝুঁকির সামনে দাঁড়িয়ে আছে। ম্যালওয়্যারের মাধ্যমে প্রতিদিন কী পরিমাণ তথ্য কম্পিউটার এবং স্মার্টফোন থেকে ‘কপি’ হয়ে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে কেউ খোঁজ রাখার প্রয়োজনও অনুভব করছেন না। এর ফলে বিশেষভাবে মোবাইল ব্যাংকিং এবং অনলাইনে অর্থ লেনদেনের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি দ্রুত প্রকট হচ্ছে।
দেশের প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরাও সাইবার নিরাপত্তার দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান অত্যন্ত নাজুক বলে উল্লেখ করেছেন। প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, বাংলাদেশ সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারে চরম উদাসীন। শুধু আইন করে কিংবা কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে এ ঝুঁকি এড়ানো যাবে না। পাইরেটেড সফটওয়্যারের বিরুদ্ধে জাতীয় সচেতনতা ছাড়া নিরাপত্তার ঝুঁকির চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা সম্ভব নয়। অন্যদিকে প্রযুক্তিবিদ সুমন সাবির সমকালকে বলেন, বাংলাদেশে সাইবার নিরাপত্তা বলতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কে কী মন্তব্য করল_ তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া বোঝানো
হচ্ছে। কিন্তু বড় বিপদ অপেক্ষা করছে অনলাইন ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ঘিরে; সেদিকে নজরই দেওয়া হচ্ছে না। বিটিআরসির বিদায়ী চেয়ারম্যান সুনীল কান্তি বোস তার সর্বশেষ সংবাদ সম্মেলনেও সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে এই মুহূর্তে সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলাকেই তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ বলে উল্লেখ করেন।
এ ব্যাপারে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী তারানা হালিম সমকালকে জানান, সাইবার নিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবেলার জন্য সাইবার সিকিউরিটি আইন হচ্ছে। এ ছাড়া নবগঠিত টেলিযোগাযোগ অধিদপ্তরেও একটি বিশেষজ্ঞ দল থাকবে, যারা সাইবার নিরাপত্তার বিষয়ে সার্বক্ষণিক নজর রাখবে এবং সমাধান দেবে।
ক্যাসপার্স্কি ল্যাবের রিপোর্টে যা আছে :বছরের শুরুতে ক্যাসপার্স্কি ল্যাবের প্রথম প্রান্তিকের রিপোর্টে কম্পিউটারে ভাইরাস আক্রান্ত হওয়ার পরিসংখ্যানে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল দ্বিতীয়। ১ নম্বরে ছিল ভিয়েতনাম। কিন্তু দ্বিতীয় প্রান্তিকের রিপোর্টে বাংলাদেশের অবস্থান ১ নম্বরে চলে এসেছে। আগের প্রান্তিকে ১ নম্বরে থাকা ভিয়েতনাম দ্বিতীয় স্থানে চলে গেছে। দ্বিতীয় প্রান্তিকের পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে ব্যবহৃত ৬০ দশমিক ৫৩ শতাংশ কম্পিউটার প্রায় ২০ ধরনের বিপজ্জনক ভাইরাসে আক্রান্ত। প্রথম প্রান্তিকের রিপোর্টে চিত্র ছিল ৬০ দশমিক ২০ শতাংশ। অন্যদিকে ভিয়েতনামে বছরের শুরুতে কম্পিউটার ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার হার ছিল ৬০ দশমিক ৬৮ শতাংশ, দ্বিতীয় প্রান্তিকে এসে হার দাঁড়িয়েছে ৫৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ।
এ ছাড়া স্মার্টফোনে ম্যালওয়্যারের আক্রমণের পরিসংখ্যানে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় বাংলাদেশ তৃতীয় স্থানে। প্রথম স্থানে রয়েছে চীন। বাংলাদেশে প্রতি ১শ’ জন ব্যবহারকারীর মধ্যে ১০ জন স্মার্টফোন গ্রাহক নীরবেই ম্যালওয়্যারের আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। আর চীনে আক্রমণের শিকার প্রতি ১শ জনে ১৬ জন।
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশ কিংবা ভিয়েতনামের মতো দেশে কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে ব্যবহৃত প্রায় সব ধরনের সফটওয়্যারই পাইরেটেড। এসব সফটওয়্যারের বেশিরভাগেই থাকছে নানা ধরনের ম্যালওয়্যার, স্পাইওয়্যার কিংবা বটনেট। এর ফলে পুরো কম্পিউটারই আক্রান্ত থাকছে। এসব কম্পিউটার অনলাইনে যুক্ত হওয়ার পর ব্যবহারকারীর অজান্তেই ম্যালওয়্যার, স্পামওয়্যারের মাধ্যমে পাচার হয়ে যাচ্ছে তথ্য। শুধু কম্পিউটারে নয়; এসব দেশের নিজস্ব ওয়েবসাইটগুলোতেও পাইরেটেড প্লাগ ইনসহ অন্য টুলস ব্যবহার করা হচ্ছে। ফলে স্প্যাম, স্ক্যামে পরিপূর্ণ থাকছে ওয়েবসাইটগুলো। অনেক ক্ষেত্রে ওয়েবসাইটটি আক্রান্ত কি-না তাও বুঝতে পারছেন না ব্যবহারকারী। ওয়েবসাইট ব্যবস্থাপনাও বেশিরভাগ ক্ষেত্রে নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে দুর্বল।
রিপোর্টে বলা হয়, বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় দ্রুত স্মার্টফোন এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু স্মার্টফোনে ইন্টারনেট ব্যবহারে কী ধরনের ঝুঁকি থাকতে পারে_ অধিকাংশ গ্রাহকই সে ব্যাপারে সচেতন নন। এর ফলে স্মার্টফোন ব্যবহার করে অর্থনৈতিক লেনদেন ও ব্যাংকিং কার্যক্রমের ক্ষেত্রেও পাসওয়ার্ড চুরি যাওয়াসহ তথ্য চুরি হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি প্রবলতর হচ্ছে। সামাজিক যোগাযোগ সাইটগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির কারণ হতে পারে ফেসবুক।
আর্থিক লেনদেনে ঝুঁকি তীব্র হচ্ছে :সাইবার নিরাপত্তার ক্ষেত্রে বিশ্বজুড়ে এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে মোবাইল ব্যাংকিং এবং আর্থিক লেনদেনে ঝুঁকির বিষয়টি। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে বর্তমানে মাসে মোবাইলভিত্তিক অর্থনৈতিক লেনদেন হয় প্রায় ৩৩৩ কোটি টাকা। এর পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাইবার ভেনচারসের তৃতীয় প্রান্তিকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ মুহূর্তে বিশ্বে ৭৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ব্যয় হচ্ছে সাইবার নিরাপত্তায়। ২০২০ সালের মধ্যে এই বাজার ১১৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার হতে পারে। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, উন্নত দেশগুলো মোবাইল ব্যাংকিং এবং অনলআইনে আর্থিক লেনদেনের নিরাপত্তা নিয়ে যতটা উদ্বিগ্ন; স্বল্পোন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশ ততটা চিন্তিত মনে হয় না। এর ফলে খুব কম সময়ের মধ্যেই ওইসব দেশে মোবাইল ব্যাংকিং কার্যক্রম বড় বিপদের মধ্যে পড়তে পারে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানায়, বেসরকারি ছয়টি ব্যাংকের ক্ষেত্রে অনলাইন কার্যক্রমে অর্থ চুরি হয়ে যাওয়ার মতো ঘটনার তথ্য পাওয়া গেছে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপে গ্রাহক প্রতিকার পেয়েছেন। দু’একটি ক্ষেত্রে সমাধান হয়নি। কিন্তু যারা বাংলাদেশ ব্যাংকে প্রতিকার চাচ্ছেন না, সে ধরনের অনেক ঘটনা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।
প্রযুক্তিবিদ সুমন সাবির বলেন, মোবাইলভিত্তিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম দিন দিন বাড়ছে। এ কার্যক্রমে প্রতারণার অভিযোগও বাড়ছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে বড় ঝুঁকি হচ্ছে, যে কোনো সময় বড় ধরনের সংকটের সৃষ্টি হবে। তখন বিষয়টি সামাল দেওয়ার প্রস্তুতি থাকবে না। অনেক দেশই সংকটে পড়েছে এবং মূল্যও দিতে হয়েছে। তিনি বলেন, কঠোর আইনের প্রয়োজন আছে, কিন্তু তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন সরকারি উদ্যোগে অর্থনৈতিক লেনদেনে প্রতারণা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য ব্যাপক প্রচার এবং প্রতিকারের জন্য দক্ষ রেসপন্স টিম প্রস্তুত রাখা, যেটা বাংলাদেশে অনুপস্থিত।
সাইবার নিরাপত্তার আরও যত ঝুঁকি :সাইবার নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করা গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাইবার ভেনচারস, কম্পিউটার উইকলিসহ একাধিক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের রিপোর্টে উঠে এসেছে গা শিউরে ওঠা আরও তথ্য। বিশেষ করে স্মার্টফোনের ক্ষেত্রে এই ঝুঁকি অনেক বেশি বিপজ্জনক। এসব গবেষণায় বলা হয়, একাধিক কোম্পানির স্মার্টফোনে বিশেষ ধরনের চিপ যুক্ত করছে নির্মাতা প্রতিষ্ঠান। এটা করা হচ্ছে ব্যবহারকারীর তথ্য ‘কপি’ করার জন্য। এমনকি ব্যবহারকারীর কল রেকর্ড হয়েও চলে যেতে পারে নির্মাতার সার্ভারে। ফেসবুকে, ই-মেইলে কী ধরনের তথ্য পাঠানো হচ্ছে তাও চলে যেতে পারে। এমনকি অ্যান্টি ভাইরাস কিংবা নিরাপত্তামূলক অন্যান্য সফটওয়্যার ব্যবহার করেও এই ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব নয়। এ ধরনের কৌশলে তথ্য চুরির জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীন একে অপরের বিরুদ্ধে অভিযোগ করে আসছে। তথ্য চুরির অভিযোগ ফেসবুক, টুইটারের মতো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বিরুদ্ধেও রয়েছে।
প্রযুক্তিবিদ মোস্তাফা জব্বার সমকালকে বলেন, বর্তমান বিশ্বে বড় শক্তি তথ্য। এ কারণে বড় বড় বিশ্বশক্তি তথ্য চুরির বিষয়ে তৎপর। বাংলাদেশে বিপদের বড় কারণ পাইরেসির সংস্কৃতি। শুধু সফটওয়্যার নয়; পাইরেটেড ভিডিও ফাইল, অডিও ফাইল সমানে ডাউনলোড করা হচ্ছে, যেখানে ম্যালওয়্যার থাকবেই। তিনি বলেন, বিজয় সফটওয়্যারের দাম মাত্র ৫০ টাকা করার পরও অনেকে পাইরেটেড কপি ব্যবহার করছেন। ১ হাজার ৮০০ টাকায় লাইসেন্স করা উইন্ডোজ অপারেটিং সিস্টেম ব্যবহার করা গেলে পাঁচ বছরের জন্য কোনো অ্যান্টি ভাইরাস প্রয়োজন হয় না। অথচ এই পাঁচ বছরে লাইসেন্স করা অ্যান্টি ভাইরাস ব্যবহার করলে কমপক্ষে খরচ পড়ে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু অধিকাংশই একবারে মাত্র ১ হাজার ৮০০ টাকা খরচ করতে চান না। তিনি বলেন, আইনের চেয়েও বেশি জরুরি হচ্ছে জাতীয়ভাবে সাইবার নিরাপত্তার ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা।