চারপাশে অস্থিরতার আগুন, ভারতের জন্য কি বিপদসংকেত?

Slider সারাবিশ্ব


গত তিন বছরে ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোতে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকট, পাকিস্তানে ইমরান খানের ক্ষমতাচ্যুতি থেকে শুরু করে বাংলাদেশের সরকার পরিবর্তন। প্রায় প্রতিটি ঘটনায় ব্যাপক জনবিক্ষোভের মাধ্যমে সরকার পতনের দৃশ্য দেখা গেছে।

এবার সেই তালিকায় যুক্ত হলো নেপাল। দেশটিতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সরকারের সিদ্ধান্তকে কেন্দ্র করে ব্যাপক বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দুদিনের এই বিক্ষোভে অন্তত ২২ জনের প্রাণহানি ও শত শত মানুষ আহত হয়েছেন।

নেপালের ঘটনাপ্রবাহও ছিল প্রায় একই ধাঁচের। প্রথমে কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধের বিরুদ্ধে ক্ষোভ থেকে আন্দোলন শুরু হলেও পরে তা দ্রুত দুর্নীতিবিরোধী বিক্ষোভে রূপ নেয়। এতে বাধ্য হয়ে মঙ্গলবার দেশটির প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি পদত্যাগ করেন। অলি দুবাই পালিয়ে গেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে।

প্রশ্ন উঠছে—কেবল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অ্যাপ নিষিদ্ধ করার ঘটনাই কি এত রক্তপাতের কারণ, নাকি নেপালও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বনাম চীনের আড়ালে চলা প্রক্সি যুদ্ধের নতুন ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে? সরকার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার পরও নেপালে বিক্ষোভ থামেনি। রাজধানী কাঠমান্ডুসহ দেশজুড়ে ‘কেপি চোর, দেশ ছাড়’ স্লোগান শোনা গেছে।

মঙ্গলবার বিক্ষোভকারীরা প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাউডেল, অলি এবং অন্যান্য মন্ত্রীর ব্যক্তিগত বাসভবনে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। কাঠমান্ডুর বিখ্যাত স্থাপনা হিলটন হোটেলও পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। হোটেলটি ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল নেপালি কংগ্রেসের এক নেতার মালিকানাধীন।

এ ধরনের দৃশ্য গত বছর বাংলাদেশে এবং ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় দেখা গেছে। দুই দেশেই স্থানীয় ইস্যু থেকে বিক্ষোভ শুরু হলেও পরে তা সরকার-বিরোধী গণআন্দোলনে রূপ নেয়। তরুণদের নেতৃত্বে আকস্মিকভাবে গড়ে ওঠা আন্দোলনে নেতাদের বাড়িঘরে ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করা হয়।

এমনকি বিক্ষোভকারীদের লুটপাট, আসবাবপত্র ভাঙচুর, শোবার ঘরে বিশ্রাম এবং সুইমিং পুলে গোসল করার দৃশ্যও দুই দেশেই দেখা গেছে। পরবর্তীতে শেখ হাসিনা ভারতে এবং শ্রীলঙ্কার গোটাবায়া রাজাপাকসে মালদ্বীপে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন।
• নেপালে আন্দোলনের নেপথ্যে কারা?

প্রশ্ন হলো, এই ক্ষমতার পরিবর্তনের পেছনে চালিকা শক্তি? নেপালে গত কয়েক মাস ধরে উত্তেজনা ধীরে ধীরে বাড়ছিল। ২০০৮ সালে প্রজাতন্ত্র ঘোষণার পর থেকে দেশটিতে বার বার ক্ষমতা ঘুরে ফিরে এসেছে তিন নেতার হাতে। তারা হলেন চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত কেপি শর্মা অলি, মাওবাদী নেতা পুষ্প কমল দহল ওরফে প্রচণ্ড ও পাঁচবারের প্রধানমন্ত্রী শের বাহাদুর দেউবা।

এই তিন নেতার বিরুদ্ধেই দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে। অর্থনৈতিক স্থবিরতা ও বেকারত্ব দেশটির পরিস্থিতিকে আরও জটিল করেছে। এর ফলে তরুণ প্রজন্মের হতাশা ক্রমেই বাড়ছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বিক্ষোভের কয়েক সপ্তাহ আগে বিক্ষোভকারীদের অনলাইনে শুরু করা ‘নেপো কিড’ নামের এক ক্যাম্পেইন ব্যাপক ভাইরাল হয়। যেখানে রাজনীতিবিদদের সন্তানদের বিলাসবহুল জীবনযাপন এবং দুর্নীতির অভিযোগ তুলে ধরা হয়।

গত ১৭ বছরে নেপালে ১৪টি সরকার ক্ষমতায় এসেছে, যার বেশিরভাগই জোট সরকার। এ বছরের শুরুতে রাজতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দোলন হয়েছিল। ওই সময় অনেকে বলেছিলেন, নেপালকে ধর্মনিরপেক্ষ প্রজাতন্ত্র বানানোর পরীক্ষা ব্যর্থ হয়েছে।
• চীনের সঙ্গে নেপালের সম্পর্ক

২০২৪ সালের জুলাইয়ে কেপি শর্মা অলি প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকেই চীনের সঙ্গে সম্পর্ক জোরদারে কাজ শুরু করেন। দেশটির ঐতিহ্যগত মিত্র ভারতকে দূরে সরিয়ে দেন তিনি। প্রথা ভেঙে অলি তার প্রথম বিদেশ সফর হিসেবে চীনকে বেছে নেন। যদিও নেপালের নেতাদের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতায় আসার পর প্রথম বিদেশ সফরে ভারতে যাওয়ার ঐতিহ্য ছিল।

চীন সফরে অলি প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তির পরপরই ঋণে জর্জরিত নেপাল ৪১ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের আর্থিক সহায়তা পায়।

২০২২ সালের মে মাসে শ্রীলঙ্কা বৈদেশিক ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়; যা শেষ পর্যন্ত গোটাবায়া সরকারের পতনের অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব সবসময়ই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উদ্বেগের অন্যতম প্রধান কারণ।
• যুক্তরাষ্ট্রের কোনও ভূমিকা আছে?

চলতি বছরের শুরুর দিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প নেতৃত্বাধীন প্রশাসন নেপালের জন্য অতীতে পাস হওয়া ‘মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ নেপাল কমপ্যাক্ট’ নামের প্রকল্পের আওতায় একটি প্যাকেজ পুনরায় চালু করেন। এই প্রকল্পের আওতায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সহায়তা দেওয়ার কথা রয়েছে দেশটিকে। যুক্তরাষ্ট্রের এই অর্থ নেপালের জ্বালানি ও সড়ক উন্নয়ন খাতে ব্যয় হবে।

ওয়াশিংটনের এই সহযোগিতাকে নেপালে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক হিসেবে হয়। চীনের বিজয় দিবস প্যারেডে অলির অংশগ্রহণ নেপালকে কট্টর মার্কিন-বিরোধী শিবিরে থাকার ইঙ্গিত হিসেবে দেখেন পর্যবেক্ষকরা।

নেপালের অস্থিরতার নেপথ্যে মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থার ভূমিকা থাকতে পারে বলে ধারণা করছেন অনেক বিশ্লেষক। ভূরাজনৈতিক বিশ্লেষক এসএল কান্থন বলেন, ‘‘নেপালে শতভাগ মার্কিন প্রভাবিত বিপ্লব ঘটেছে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনি বলেছেন, বিশ্বের বহু জায়গায় একই ধারা দেখা গেছে—তরুণদের ব্যবহার করে সংসদ ভবন ও শীর্ষ নেতাদের বাড়িঘরে অগ্নিসংযোগ এবং নেতাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। নেপালে এখন পাকিস্তানের মতো একজন মার্কিনপন্থী নেতা ক্ষমতায় আসবেন।

অপর এক বিশেষজ্ঞ বলেছেন, চলতি বছরে নেপালে বিক্ষোভ ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। শিগগিরই দেশটিতে মার্কিনপন্থী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে; যা চীনপন্থী সরকারকে অপসারণ করবে। ঠিক যেমনটি হয়েছে শ্রীলঙ্কায়।

সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *