প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কোন স্থান হবে না। আর কয়েকটি বোমা মেরে ও ঢিল ছুঁড়ে বর্তমান সরকারের উন্নয়নের গতি রোধ করা সম্ভব নয়। অন্যায়কে কখনও প্রশ্রয় দেইনি, ভবিষ্যতেও দেব না। আন্দোলনের নামে ‘মানুষ পুড়িয়ে সরকার উৎখাতে ব্যর্থরাই’ বিদেশী নাগরিক হত্যা এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে হামলা চালিয়ে দেশ ও সরকারের ভাবমূর্তি নষ্টের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। তবে বিদেশী হত্যা ও ইমামবাড়ায় তাজিয়া মিছিলে বোমা হামলার পেছনে কারা ছিল- তা ধীরে ধীরে বেরিয়ে আসছে।
বুধবার রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার নির্মাণ (ফেজ-১) প্রকল্পের ভিত্তিফলক উন্মোচনকালে প্রধানমন্ত্রী বছরের শুরুতে বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা অবরোধ-হরতালে নাশকতার কথা মনে করিয়ে দিয়ে বলেন, দেশের ভেতর মানুষ পুড়িয়ে যখন দেখল যে, সরকার উৎখাত করা যাচ্ছে না। এখন বিদেশীদের পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে তারা। প্রধানমন্ত্রী ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও মুন্সীগঞ্জ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলেন।
প্রধানমন্ত্রী দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, দুটো বোমা আর পাঁচটা ডিম মেরে সরকারের উন্নয়নের গতিধারা বন্ধ করা যাবে না। যারা এটা চিন্তা করছেন, তারা ভুল। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সরকারের দৃঢ় অবস্থানের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, একটা কথা স্পষ্ট বলতে চাই- বাংলাদেশে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের কোন স্থান হবে না, সরকার কঠোরভাবে তা দমন করবে।
সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বস্তরের জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বার্থান্বেষী একটি মহল আমাদের উন্নয়ন কর্মকা- ও দেশের অগ্রগতি পছন্দ করে না। জনগণ যখন সুখে-শান্তিতে বসবাস করছে তখন তারা উন্নয়নের প্রয়াস নস্যাতের অপচেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে। দেশে কোন অস্থিরতা সৃষ্টি করে আমাদের সরকারের নেয়া উন্নয়ন কর্মকা- স্থবির করে দেয়া যাবে না।
ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের জন্য বিএনপি-জামায়াত জোটকে দায়ী করে শেখ হাসিনা বলেন, জনগণের দুঃসহ ভোগান্তির কারণে যাত্রীদের স্বস্তির জন্য ক্রয়কৃত অধিকাংশ সরকারী ও বেসরকারী বাস তারা জ্বালিয়ে দিয়েছে। পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করতে তারা এখনও পরিকল্পিতভাবে বিদেশী নাগরিক হত্যা এবং স্থানীয় লোকজনকে খুন করে দেশকে পঙ্গু করার ব্যর্থ তৎপরতা চালাচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোর হোতাদের সম্পর্কে মানুষ এখন সম্পূর্ণ অবগত রয়েছেন। তিনি বলেন, উন্নয়নের গতি অব্যাহত রাখতে এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জনের কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জনে অশুভ শক্তির প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে সরকারকে প্রত্যেক মানুষের সহযোগিতা প্রয়োজন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যখন আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত হচ্ছে, তখনই দেশের ভাবমূর্তি নষ্ট করতে বিদেশী খুন ও তাজিয়া মিছিলে হামলার মতো নাশকতা ঘটানো হচ্ছে। ইমামবাড়ায় বোমা হামলায় কারা আহত হয়েছে? কে মারা গেছে? যে ছেলেটা মারা গেছে সে কিন্তু শিয়া না, সে সুন্নি। যে কয়জন আহত, তারা প্রত্যেকে কিন্তু সুন্নি মুসলমান। যে অনুষ্ঠানটি সবাই মিলিতভাবে করে, তাতে এই হামলার কী অর্থ থাকতে পারে? কারা করল? এটা ধীরে ধীরে মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের সরকার শহর ও গ্রামের উন্নয়নে সমতা বিধানের পাশাপাশি ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে অর্থনৈতিক বৈষম্যও হ্রাস করেছে এবং এটি হচ্ছে দেশের চলমান উন্নয়নের মূলভিত্তি। ওয়াসার পানির অপচয়রোধে সবাইকে সতর্ক হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, পানি পরিশোধন একটি ব্যয়বহুল কাজ। তাছাড়া ভূগর্ভস্থ থেকে পানি তুলতে থাকলে পানির স্তর নিচে নেমে যায়। এতে ভূমিকম্পের আশঙ্কাও বাড়ে।
ঢাকার চারপাশে বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, শীতলক্ষ্যা ও বংশী নদীর করুণ অবস্থার কথা তুলে ধরে এসব নদীর সংস্কারে সরকারের বিভিন্ন পরিকল্পনার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বুড়িগঙ্গায় কয়টি স্যুয়ারেজ লাইন যুক্ত হয়েছে তার খবর নিতে আমি নির্দেশ দিয়েছি। প্রতিটি স্যুয়ারেজ লাইনে একটি পানি শোধনাগার নির্মাণ করা হবে। নতুন স্থাপনা নির্মাণের সময় কোন জলাধার যাতে ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকেও খেয়াল রাখার তাগিদ দিয়ে তিনি বলেন, খাল, নদী, জলাধার ভরাট করে বাড়ি-ঘর-স্থাপনা নির্মাণ করা চলবে না।
পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার নির্মাণ প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ঢাকার জনসংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ঢাকার পানির সমস্যা সমাধানে এ প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। পদ্মা পানি শোধনাগারের প্রথম পর্যায়ের কাজ সম্পন্ন হলে ঢাকা শহরে প্রতিদিন ৪৫ কোটি লিটার বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পদ্মা পানি শোধনাগার প্রকল্পে অর্থায়নের জন্য চীন সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়ে তিনি বলেন, যশলদিয়ায় এখন যেটা নির্মিত হচ্ছে, সেটা প্রথম পর্যায়। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়টি নির্মাণ করা হবে। দ্বিতীয় পর্যায়টি নির্মিত হলে আরও ৪৫ কোটি লিটার পানি পাওয়া যাবে। বিএনপির সরকারের সমালোচনা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে ঢাকায় পানির জন্য হাহাকার ছিল। তখন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সায়েদাবাদ পানি শোধনাগার প্রকল্প (প্রথম পর্যায়) চালু করা হয়। পরবর্তী সময়ে ২০০৯ সালে চালু করা হয় দ্বিতীয় পর্যায় প্রকল্প।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সালে ঢাকায় পানির চাহিদা ছিল ২১২ কোটি লিটার। তার বিপরীতে আমরা পেতাম ৮৮ কোটি লিটার। এখন ২০১৫ সালে আমরা ২২০ থেকে ২২৫ কোটি লিটার পানি পাচ্ছি। তিনি বলেন, আরও তিনটি ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্লান্ট নির্মাণের অপেক্ষায় রয়েছে। নগরীর ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে ধলপুর (সায়েদাবাদ ৩য় পর্যায়), নারায়ণগঞ্জের চর গন্ধপপুর এবং সাভারের তেঁতুলঝরায় এসব প্লান্ট নির্মিত হবে। তিনি বলেন, প্রকল্পগুলো সম্পন্ন হলে ঢাকা মহানগরীর ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীলতা ৮০ ভাগ কমবে এবং পরিবেশগত দিক থেকে ঢাকা শহর আরও নিরাপদ ও টেকসই হবে। বর্তমানে ওয়াসার ৭২ শতাংশ সরবরাহ আসে ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে।
বুড়িগঙ্গাসহ ঢাকা মহানগরীর চারপাশের নদীগুলো দূষণ মুক্ত করতে তার সরকারের প্রচেষ্টার কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, নদীর দূষণ যদি বন্ধ করা যায়, তাহলে রাজধানীর পরিবেশ আরও উন্নত হবে। তবে বুড়িগঙ্গার কাদা-আবর্জনা সরাতে আরও পদক্ষেপ নিতে এবং নদীতে শিল্পবর্জ্য নিষ্কাশন বন্ধ করতে হবে। এ সময় প্রধানমন্ত্রী বৃষ্টির পানি ব্যবহারের নানা উপকারী দিকের ওপর আলোকপাত করে বলেন, কোটি কোটি টাকা খরচ করে পানি শোধন করা হয়। আর সেই পানি গাড়ি পরিষ্কার, ইট ধোঁয়ার কাজসহ বাড়ির গৃহস্থালির কাজে অপচয় করা হচ্ছে। পানির অপচয় কমালে পানির বিলও কম আসবে। তাই পানির অপচয়ের ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকার পরামর্শ দেন তিনি।
স্থানীয় সরকার ও সমবায় মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তৃতা রাখেন ঢাকা ওয়াসার ব্যবস্থাপনা পরিচালক তাকসিম এ খান। চীনের রাষ্ট্রদূত ম্যা মিংকিয়াং, প্রকল্পটির নির্মাণকারী প্রতিষ্ঠান চীনের সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং কোম্পানি লিমিটেডের চেয়ারম্যান লু ইয়ান ও স্থানীয় সরকার বিভাগের সচিব এ মালেক অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগারের ভিত্তিফলক উন্মোচন ॥ মুন্সীগঞ্জ থেকে আমাদের স্টাফ রিপোর্টার জানান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে মুন্সীগঞ্জে ‘পদ্মা-যশলদিয়া পানি শোধনাগার’র ভিত্তিফলক উন্মোচন করেছেন। ঢাকাবাসীর বিশুদ্ধ খাবার পানির চাহিদা পূরণে বুধবার হোটেল সোনারগাঁ থেকে সুইচ টিপতেই ফলক উন্মোচন হয় প্রকল্প স্থল পদ্মা পারের যশলদিয়ায়। সরাসরি ভিডিও কনফারেন্স চলাকালে প্রকল্পস্থলে ছিলেন সাবেক হুইপ অধ্যাপিকা সাগুফতা ইয়াসমিন এমিলি এমপি, সুকুমার রঞ্জন ঘোষ এমপি, জেলা পরিষদ প্রশাসক আলহাজ মোঃ মহিউদ্দিন। মুন্সীগঞ্জে অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক ছিলেন জেলা প্রশাসক মোঃ সাইফুল হাসান বাদল। এছাড়া পুলিশ সুপার বিপ্লব বিজয়, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ লুৎফর রহমান, লৌহজং উপজেলা চেয়ারম্যান ওসমান গনি তালুকদার, সিরাজদিখান উপজেলা চেয়ারম্যান মহিউদ্দিন আহম্মেদ, প্রকল্পটির পরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোঃ বজলুর রহমান, ফকির আবদুল হামিদ, জগলুল হালদার ভুতু, রশিদ শিকদার, আমিরুল ইসলাম আশরাফ হোসেন খান, তোফাজ্জল হোসেন তপন প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।
ভিডিও কনফারেন্সে প্রধানমন্ত্রীর কাছে সুকুমার রঞ্জন ঘোষ এমপি সিরাজদিখানের বালুচর ইউনিয়নে ধলেশ্বরীর ওপর একটি ব্রিজ নির্মাণের দাবি জানান। প্রধানমন্ত্রী ব্রিজ নির্মাণের অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। জেলা পরিষদ প্রশাসক ও বঙ্গবন্ধুর চীফ সিকিউরিটি গার্ড আলহাজ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন গজারিয়ার সঙ্গে দ্রুত যোগাযোগের ক্ষেত্রে মেঘনা নদীতে কয়েকটি ফেরি দেয়ার কথা বললে প্রধানমন্ত্রী সঙ্গে সঙ্গে হোটেল সোনারগাঁওয়ে উপস্থিত নৌমন্ত্রী শাজাহান খানকে তা বাস্তবায়নের নির্দেশ দেন।