ইতালির নাগরিক সিজার তাভেলা হত্যা পরিকল্পনার অন্যতম সন্দেহভাজন ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক ও সাবেক কমিশনার এম এ কাইয়ুম ওরফে কাইয়ুম কমিশনারের সঙ্গে বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের মোবাইলে কথোপকথনের তথ্য পেয়েছেন গোয়েন্দারা। একই সময় কাইয়ুম বিদেশে অবস্থানরত বিএনপির অন্যতম এক শীর্ষ নেতার সঙ্গে জিসানের যোগাযোগ করিয়ে দেন। গোয়েন্দা সূত্র দাবি করেছে, কাইয়ুমের সঙ্গে জিসান ও বিএনপির ওই শীর্ষ নেতার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ঢাকায় বিদেশি হত্যার নকশা করা হয়। বিষয়টি নিয়ে আরও নিবিড়ভাবে অনুসন্ধান চলছে। ঢাকার আন্ডারওয়ার্ল্ডের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জিসান দীর্ঘদিন ধরে দুবাইয়ে পলাতক রয়েছেন। মাঝেমধ্যে তিনি মালয়েশিয়াও যাতায়াত করেন। এ ছাড়া সাত/আট মাস ধরে দেশের বাইরে রয়েছেন আলোচিত সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর এম এ কাইয়ুম। বর্তমানে তিনি অবস্থান করছেন মালয়েশিয়ায়। সূত্রগুলো বলছে, জিসানের সঙ্গে কথোপকথনের সময় কাইয়ুম সৌদি আরবে অবস্থান করছিলেন। বিএনপির ওই নেতাও একই সময় সৌদি আরব ছিলেন।
তবে এ অভিযোগের ব্যাপারে জানতে চাইলে গতকাল রাতে টেলিফোনে মালয়েশিয়া থেকে কাইয়ুম কমিশনার সমকালকে বলেন, জিসানের সঙ্গে কথোপকথনের যে অভিযোগ আনা হয়েছে, তা মিথ্যা. বানোয়াট ও সাজানো নাটক। তাভেলা হত্যার সঙ্গে তার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই দাবি করে তিনি আরও বলেন, এ ঘটনায় আমাকে বলির পাঁঠা বানানোর চেষ্টা করা হচ্ছে।
যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, তাভেলা হত্যার ঘটনায় কাইয়ুম কমিশনার সন্দেহের তালিকায় রয়েছেন। এ ছাড়া এই হত্যাকাণ্ডে আরও কয়েকজন রাজনীতিকের সম্পৃক্ততা আছে কি-না, তা তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
তাভেলা হত্যার ঘটনায় পুলিশের বিশেষ তদন্ত কমিটির প্রধান ডিবির যুগ্ম কমিশনার মনিরুল ইসলাম সমকালকে বলেন, তাভেলা হত্যায় একজনের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও তিনজনকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে কিছু তথ্য পাওয়া গেছে। সুনির্দিষ্ট গোয়েন্দা তথ্য ও প্রযুক্তিগত তদন্তে কোন কোন ধাপে কারা পরিকল্পনায় জড়িত ছিল, তা বের করা হবে। এতে এক এক করে পরিকল্পনার সর্বশেষ ব্যক্তি চিহ্নিতের চেষ্টা করা হচ্ছে।
গ্রেফতারকৃতদের পরিবারের অভিযোগ, তাদের স্বজনরা হত্যায় জড়িত ছিল না_ এমন প্রশ্নের জবাবে মনিরুল ইসলাম বলেন, অনেক ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে অপরাধ করলেও তাদের স্বজনরা তা বিশ্বাস বা স্বীকার করতে চান না। পুলিশ পেশাদারিত্বের সঙ্গে তথ্য-প্রমাণ পেয়ে কথা বলে।
গত রোববার রাতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাভেলা হত্যায় জড়িত চারজনকে গ্রেফতার করা হয় বলে দাবি করছে পুলিশ। তারা হলেন রাসেল চৌধুরী ওরফে চাক্কি রাসেল ওরফে বিদ্যুৎ রাসেল (৩৪), মিনহাজুল আরিফিন রাসেল ওরফে ভাগ্নে রাসেল ওরফে কালা রাসেল, তামজিদ আহম্মেদ রুবেল ওরফে শুটার রুবেল (২৮) ও শাখাওয়াত হোসেন ওরফে শরীফ (২৯)। তাদের মধ্যে তাভেলাকে গুলি করেছিল শুটার রুবেল। তবে অভিযুক্তদের পরিবারের দাবি, তাভেলা হত্যার সঙ্গে গ্রেফতারকৃতরা জড়িত নন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, মিনহাজুল এর আগেও রাজধানীকেন্দ্রিক অনেক অপরাধের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। শুটার রুবেল তার ‘ডানহাত’ হিসেবে পরিচিত। ২০০৮ সালে পল্টনে বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের এক ব্যক্তিকে গুলি করে হত্যার অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি রাজধানীর বাড্ডায় ‘ফোর মার্ডারের’ ঘটনায়ও মিনহাজুলের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য রয়েছে। গোয়েন্দারা বলছেন, শান্তিনগরে পানকৌড়ি অ্যাপার্টমেন্টে গুলির ঘটনায় মিনহাজুল জড়িত ছিল।
সংশ্লিষ্ট সূত্রের দাবি, কাইয়ুম কমিশনারের সঙ্গে জিসানের বিদেশে বসেই যোগাযোগ হয়। সেখানে ঠিক করা হয়, কীভাবে বিদেশিকে হত্যা করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে হবে। এমনকি ‘আইএস’ নাটক সাজিয়ে তা ভিন্ন খাতে নেওয়া হবে। এর আগেও জিসান বিভিন্ন সময় বিদেশে বসে ঢাকায় লাশ ফেলার নির্দেশ দিয়েছেন। সম্প্রতি এক শিষ্যকে বাড্ডার বাসিন্দা ডালিমকে হত্যার নির্দেশ দেন তিনি।
এদিকে, গুলশানে তাভেলাকে হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত গুলির ব্যালাস্টিক পরীক্ষার প্রতিবেদন পেয়েছে মামলার তদন্ত সংস্থা ডিবি। সেখানে বলা হয়, তাভেলাকে হত্যা করতে পয়েন্ট ৩২ ব্যারেলের আগ্নেয়াস্ত্র বা ৭.৬৫ বোরের পিস্তল ব্যবহার করা হয়েছে। আগ্নেয়াস্ত্রটি স্থানীয়ভাবে তৈরি। খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। এ ছাড়া তাভেলা হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার চারজনের বাসায় গতকাল রাতে তল্লাশি চালিয়েছে ডিবি।
গোয়েন্দা সূত্র বলছে, তাভেলা হত্যার ঘটনার তদন্ত করতে গিয়ে তারা অনেকের মোবাইল কথোপকথনে সরকারবিরোধী ষড়যন্ত্রের তথ্য পান। সেখানে উঠে আসে, ২০১৬ সালের জানুয়ারির মধ্যে সরকারকে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য করা হবে। এর পর মধ্যবর্তী নির্বাচন আদায় করা হবে। চলতি বছর নভেম্বরের দিকে বড় ধরনের নাশকতা ঘটানোরও পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
সূত্র জানায়, তাভেলা হত্যায় অস্ত্র সরবরাহকারী বাড্ডার ভাঙাড়ি সোহেলকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। তবে একটি সূত্র বলছে, তিনি ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন। এ ছাড়া সিসিটিভির ফুটেজে সন্দেহভাজন যে তিন খুনিকে দেখা গেছে, তাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে সিআইডিতে পাঠানো হচ্ছে। তাভেলা হত্যায় অর্থদাতাদের পরিচয় নিশ্চিত করতে একাধিক টিম কাজ করছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, এর আগে কাইয়ুম কমিশনারের বাসা থেকে রকেট লঞ্চার ও একে-৪৭ রাইফেল উদ্ধার করা হয়েছিল। বাড্ডা এলাকায় তিনি জমিজমা ব্যবসার সঙ্গেও সম্পৃক্ত। ঢাকা সিটি করপোরেশনের সাবেক মেয়র ও বিএনপি নেতা সাদেক হোসেন খোকা ও হাওয়া ভবনের ‘আশীর্বাদ’ ছিল এম এ কাইয়ুমের ওপর। ঢাকা মহানগর বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হওয়ার আগে দলের সমর্থনেই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ নিয়ে ওয়ার্ড কমিশনার নির্বাচিত হন তিনি। ২০০৮ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুলশান-বাড্ডার আসনে দলের প্রার্থিতা চেয়েও পাননি। তবে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত মহাজোট সরকারের আমলে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি ভেঙে ফেলার পর আলোচনায় আসেন কাইয়ুম। ওই সময় খালেদার বাসার মালপত্র তার গুলশানের বাসায় রাখা হয়। একপর্যায়ে কাইয়ুমের বাড়িতেই খালেদা জিয়া থাকবেন বলে শোনা যায়। পরে অবশ্য খালেদা জিয়া গুলশানের আরেকটি বাড়িতে ওঠেন। অন্যদিকে মালিবাগে সানরাইজ হোটেলে ডিবির দুই সদস্যকে হত্যার পর থেকেই পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। বিদেশে পলাতক জিসানের সঙ্গে অনেকেই গোপনে যোগাযোগ করে থাকেন। বাড্ডা, রামপুরা-খিলগাঁও ও বনশ্রী এলাকায় অপরাধের নিয়ন্ত্রণ রয়েছে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের হাতে। ঢাকা সিটি করপোরেশন (উত্তর) এবং ওয়াসা, সড়ক ও জনপথ বিভাগের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করছেন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান।
গত ২৮ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় গুলশান ২ নম্বরের ৯০ নম্বর সড়কের গভর্নর হাউসের দক্ষিণ পাশের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষে ফুটপাতে সিজারকে (৫০) গুলি করে হত্যা করা হয়। তিনি নেদারল্যান্ডসভিত্তিক আইসিসিও নামের একটি প্রতিষ্ঠানের প্রুপ (প্রফিটেবল অপরচুনিটিজ ফর ফুড সিকিউরিটি) কর্মসূচির প্রকল্প ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। এর পাঁচ দিন পর ৩ অক্টোবর রংপুর সদরের আলুটারী গ্রামে একই কায়দায় জাপানের নাগরিক হোশি কোনিওকে গুলি করে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা।